রবিবার , ২২শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ , ৭ই আশ্বিন, ১৪৩১ , ১৮ই রবিউল আউয়াল, ১৪৪৬

হোম > Uncategorized > বরাদ্দের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কমছে স্বাস্থ্য সেবার মান

বরাদ্দের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কমছে স্বাস্থ্য সেবার মান

শেয়ার করুন

বাংলাভূমি২৪ ডেস্ক ॥
বাজেটে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দের হার ক্রমাগতভাবে হ্রাস পাচ্ছে। একই সঙ্গে প্রতি বছর দেশে ২০ লাখ মানুষ বাড়লেও আনুপাতিক হারে বাড়ছে না বরাদ্দের পরিমাণ। ফলে এ খাতে বাড়ছে ব্যক্তিগত ব্যয়। মানা সম্ভব হচ্ছে না বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরামর্শ। এমনটিই জানালেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। স্বাস্থ্যখাত নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করে আসা বেসরকারী সংস্থা সুশাসনের জন্য প্রচারাভিযান- সুপ্র।

সংশ্লিষ্টদের স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞগণদের মতে, এ খাতে বরাদ্দের অর্ধেকই খরচ হয় বেতন-ভাতায়। অবশিষ্ট বরাদ্দ যায় ক্রয় ও অবকাঠামো উন্নয়নে। জাতীয় বাজেটে বরাদ্দ কমার পাশাপাশি দাতা সংস্থাগুলোর অর্থায়নও ক্রমাগত হারে হ্রাস পাচ্ছে। ফলে সংবিধানে জনগণের স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিতের বিষয়টি ক্রমাগতভাবে দূরে সরে যাচ্ছে।
স্বাস্থ্য খাতে ৫ বছরের জাতীয় বাজেটের চিত্রে দেখা যায়, ২০০৯-১০ অর্থবছরে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ ছিল মোট বাজেটের ৬ দশমিক ৩৩, ২০১০-১১ অর্থবছরে ৬ দশমিক ১৯, ২০১১-১২ অর্থবছরে ৫ দশমিক ৬৪, ২০১২-১৩ অর্থবছরে ৫ দশমিক ৫১, ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ৪ দশমিক ২৭, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ৪ দশমিক ৪ এবং ২০১৫-১৬ অর্থবছরে তা নেমে দাঁড়িয়েছে ৪ দশমিক ৩ শতাংশে। অন্যদিকে দাতা সংস্থার অর্থায়নও কমে যাচ্ছে। যেমন স্বাস্থ্য, পুষ্টি ও জনসংখ্যা সেক্টর কর্মসূচি ২০০৩-২০১১-এর শুরুতে বৈদেশিক সহায়তা ছিল এক-তৃতীয়াংশ (মোট বাজেট ছিল ৪.৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার)। অথচ তৃতীয় সেক্টর কর্মসূচি স্বাস্থ্য, জনসংখ্যা ও পুষ্টি সেক্টর উন্নয়ন কর্মসূচি ২০১১-২০১৬-তে কমে হয়েছে এক-চতুর্থাংশ (মোট বাজেট ছিল ৭.৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার)। ক্রমাগতভাবে সরকারের খরচ কমে যাওয়ার কারণে স্বাস্থ্য খাতে সাধারণ মানুষের ব্যক্তিগত খরচ বৃদ্ধি পাচ্ছে।

হরৎধসড়ু২৪-যবধষঃয-ংবপঃড়ৎ-নফ.লঢ়ম
১৯৯৭ সালে স্বাস্থ্য খাতে ব্যক্তিগত বরাদ্দ ছিল ৫৬ দশমিক ৯ শতাংশ। ২০০৭ সালে তা বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ৬৪ দশমিক ৭ শতাংশ। ব্যক্তিগতভাবে খরচ মেটানোর পরিমাণ বিশ্বে প্রায় ৩২ শতাংশ হলেও বাংলাদেশে বর্তমানে এ হার ৬৫ শতাংশ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, একটি দেশের বাজেটের ন্যূনতম ১৫ শতাংশ বরাদ্দ দেয়া উচিত স্বাস্থ্য খাতে।

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, দেশের সামগ্রিক স্বাস্থ্য সেবার মান বাড়াতে জিডিপির কমপক্ষে ৩ শতাংশ এবং জাতীয় বাজেটের ৭ থেকে ৮ শতাংশ বরাদ্দ থাকা উচিত। অথচ স্বাস্থ্য খাতের জন্য যে বরাদ্দ দেয়া হয়, তা মোট উৎপাদনের (জিডিপি) মাত্র ১ শতাংশ।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, জনগণের স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করতে হলে বাজেটে বরাদ্দ হতে হবে জিডিপির কমপক্ষে ৩ শতাংশ। বরাদ্দের পরিমাণ ৩ শতাংশে উন্নীত করতে হলে বাড়তি বরাদ্দ দিতে হবে ১৫ হাজার কোটি টাকা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সুপারিশ অনুযায়ী, একটি দেশের স্বাস্থ্য খাতে সরকারিভাবে মাথাপিছু ন্যূনতম ব্যয় বরাদ্দ ৪৪ মার্কিন ডলারের সমান হওয়া উচিত, যা বাংলাদেশে মাত্র ২৭ ডলার। এ বরাদ্দের হার আমাদের প্রতিবেশী ভারতে ৫৯ ডলার নেপালে ৩৩ ডলার, শ্রীলংকায় ৯৭ ডলার, পাকিস্তানে ৩০ ডলার, ইন্দোনেশিয়ায় ৯৫ ডলার এবং ভিয়েতনামে ৯৬ ডলার।

অর্থমন্ত্রী ঘোষিত ২০১৫-১৬ অর্থবছরের বাজেটে স্বাস্থ্য খাতে মোট বরাদ্দের পরিমাণ ১২ হাজার ৭২৬ কোটি টাকা- যা মোট বাজেটের ৪ দশমিক ৩ শতাংশ। গত অর্থবছরে এ খাতে বাজেটে বরাদ্দ ছিল ১১ হাজার কোটি টাকা, যা গত বাজেটের ৪ দশমিক ৪ শতাংশ। অর্থাৎ আপাত দৃষ্টিতে এবারের বাজেটে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ বেশি দেখালেও প্রকৃত পক্ষে তা কমেছে।
বাজেটের আকার বাড়লেও অবকাঠামো উন্নয়ন ও সেবাখাতে বরাদ্দ অপ্রতুল। সেই সাথে বিশাল অঙ্কের বাজেটের ব্যয়, ঘাটতি পূরণ ও গুণগত বাস্তবায়নই প্রধান চ্যালেঞ্জ বলে মনে করছে সুশাসনের জন্য প্রচারাভিযান (সুপ্র)।

এ বিষয়ে সুশাসনের জন্য প্রচারাভিযান-সুপ্র’র পরিচালক এলিসন সুব্রত বাড়ৈ বেঙ্গলিনিউজকে বলেন, সুপ্র সকল সময়েই বলে আসছে যে, স্বাস্থ্য ও শিক্ষাখাতে বাণিজ্যিকরণ না করে স্বল্প আয় ও দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে বেশি সুবিধা পেতে পারে সেই ব্যবস্থা করা। তিনি আরো বলেন, আমাদের দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোতে সাধারণ মানুষ স্থানীয় স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের উপর নির্ভরশীল।কিন্তু বাস্তবে অবকাঠামো ও জনবল সঙ্কটের কারণে সেই স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে পর্যাপ্ত সেবা পাওয়া যাচ্ছে না। তাই বাজেটে এই বিষয়ে একটি প্রস্তাবনা থাকা প্রয়োজন।
এছাড়াও আমরা স্বাস্থ্যখাতে একটি বিষয়ে সরকারের কাছে জোড় দাবি জানিয়েছি যে, বর্তমানে ঔষধের জন্য বাজেট বরাদ্ধতে একই হারে সকল জেলা, উপজেলায় দেয়া হচ্ছে। আমাদের একটি সোশ্যাল অডিট এ দেখা গেছে যে, নির্দিষ্ট একটি উপজেলায় প্রচুর ঔষধ পড়ে আছে যা হয়তো অন্য একটি উপজেলায় সেই ঔষধের সঙ্কট রয়েছে।
একটি উপজেলায় যে ঔষধের চাহিদা বেশি সেই উপজেলায় সেই ঔষধ বরাদ্ধ বেশি করে অন্য ঔষধ কমিয়ে দিলে আমাদের দেশের সকল উপজেলায় ঔষধ সঙ্কট অনেকটাই কমে আসবে। আমরা জানি যে সরকারের অর্থের অপ্রতুলতা রয়েছে সেই কারণেই ঔষধের সুষ্ঠ বণ্টন আমাদের তৃণমূলে ঔষধ সঙ্কটের সমাধান ঘটবে।

গ্রামীণ পর্যায়ে কমিউনিটি ক্লিনিক এ যে গঠন প্রণালী রয়েছে তা যদি বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয় তাহলে দরিদ্র মানুষের উপকার হবে। এ বিষয়টি নিয়ে সরকারকে আমরা সাদুবাদ জানিয়েছি। কমিউনিটি ক্লিনিক ব্যবস্থায় সরকারের আরও কঠোর তদারকি দরকার। এছাড়াও স্থানীয়দের ও মিডিয়াদেরও একটি তদারকি থাকলে অবশ্যই এর সফলতা পাওয়া যাবে।
তৃণমূল থেকে আসা কয়েকটি প্রস্তাব তুলে ধরে এলিসন সুব্রত বাড়ৈ বলেন, আমাদের উল্লেখ যোগ্য প্রস্তাবের মধ্যে রয়েছে,
১- দরিদ্র মানুষের জন্য স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করা।
২- স্বাস্থ্য কেন্দ্র গুলোতে যে শূন্য পদ আছে সে গুলো অভিলম্বে পূরণ করে স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করা।
৩- ঔষধ বরাদ্ধের সময় যে উপজেলায় যে ঔষধের চাহিদা বিবেচনা করে যেন জেলা, উপজেলায় ঔষধ বরাদ্ধ করা হয়।
৪- কমিউনিটি ক্লিনিক এর গঠন প্রণালী অনুযায়ী জনগণ, সিভিল সার্জন ও সরকার তিনটি পক্ষের অংশ গ্রহণ জোড়দার করার জন্য নিয়মিত মিটিং ও মনিটরিং করা প্রয়োজন।

ঔগঝথঐবধষঃযথ১৭৭

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সুত্র মতে, সাধারণ মানুষের হাতের নাগালের মধ্যে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছানোর লক্ষ্যে ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার পরিচালনার দায়িত্ব নিয়ে কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপনের কাজ শুরু করে।
সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর পাঁচ বছর মেয়াদে ১৮ হাজার ক্লিনিক স্থাপনের লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে আওয়ামী লীগ সরকার কাজ শুরু করলেও ১০ হাজার ৭২৩টি ক্লিনিক চালু হয়।
অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ক্ষমতায় এসে ক্লিনিকগুলো বন্ধ করে দেয়।
আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার ২০০৯ সালে ক্ষমতা নিয়ে বন্ধ কমিউনিটি ক্লিনিকগুলো চালুর উদ্যোগ নেয়। এ পর্যন্ত ১৩ হাজার ৫০০ ক্লিনিক স্থাপিত হয়েছে, এর ১২ হাজার ৯০৬টি পুরোদমে চালু।
প্রতিটি কমিউনিটি ক্লিনিক থেকে ৩০ ধরণের জরুরি ওষুধ বিনামূল্যে দেওয়া হয়। একেকটি ক্লিনিকের জন্য বছরে ওষুধের বাজেট ১ লাখ ১০ হাজার টাকা।
কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপনের জন্য স্থানীয় জনগণ এ পর্যন্ত প্রায় ৮০০ একরের বেশি জমি দান করেছেন। এখন পর্যন্ত ১৩ হাজার ৭৮৪ জন হেলথকেয়ার প্রোভাইডার নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, স্বাস্থ্য খাতে বাংলাদেশের অর্জন মোটামুটিভাবে সাফল্যজনক। বিশেষ করে স্বাধীনতার পর থেকে সাম্প্রতিক সময়ে স্বাস্থ্য খাতের অগ্রগতি জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবেও স্বীকৃত হয়েছে। কিন্তু এই অর্জন আরো ভালো হতে পারত। যদি স্বাস্থ্য খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠা আর দুর্নীতি কমানো যায়, তাহলে স্বাস্থ্য খাতের অগ্রগতি উচ্চতর পর্যায়ে যাবে। উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ করা যাচ্ছে , স্বাস্থ্য খাতে যে বাজেট, তা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক অনেক কম। বাজেট বরাদ্দের গ্লোবাল যে স্ট্যান্ডার্ড তা বিবেচনা করলে দেখতেপাওয়া যায়, জাতীয় আয়ের ৫ শতাংশ বাজেট স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় করতে হবে। আমাদের দেশে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দের পরিমাণ জাতীয় আয়ের ০.৮ শতাংশ।
রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ এ খাতে অর্থ বরাদ্দ কম থাকায় তার নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে বিভিন্ন অবকাঠামো, স্বাস্থ্যসেবা আর ব্যবস্থাপনায়। অব্যবস্থাপনা থাকায় এ খাতে সৃষ্টি হচ্ছে নানা অনিয়ম। নিয়োগের ব্যাপারে প্রশাসনিক লোকেরা অনিয়ম, দুর্নীতি করেন। নিয়োগে থাকে রাজনৈতিক প্রভাব। যোগ্যতা, দক্ষতা থাকার পরও অনেকের চাকরি হয় না। বাংলাদেশের রোগীর তুলনায় চিকিৎসক কম। চিকিৎসকদের বেশ চাপের মধ্যে থেকে কাজ করতে হয়; ফলে চাপ মোকাবিলা করে সেবার মান বজায় রাখা তাঁদের পক্ষে সব সময় সম্ভব হয় না।
বিশেষজ্ঞদের মতে, সরকার স্বাস্থ্যসেবা গ্রামীণ পর্যায়ে পৌঁছে দিতে চেষ্টা করছে। গ্রামীণ পর্যায়ে কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপন অবশ্যই ভালো একটি অর্জন। স্বাস্থ্যসেবা মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেওয়ার জন্য এটি একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ। কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোর মাধ্যমে ইতিবাচক ফলাফল আসতে শুরু করেছে। তবে গ্রামীণ এ সেবাকে আরো উন্নত করতে হবে। তবে স্বাস্থ্য খাতে আরেকটি সমস্যা হলো, গ্রামাঞ্চলে চিকিৎসকরা থাকতে চান না। চিকিৎসকদের ধরে রাখার বিষয়টি সরকারের পক্ষ সম্ভব হচ্ছে না; এটা তো সরকারের পক্ষ থেকেই অনেকবার বলা হয়েছে। তবে গ্রামীণ স্বাস্থ্য খাতে অবকাঠামোর উন্নয়ন জরুরি। চিকিৎসকদের বেতন-ভাতাসহ অন্য সুবিধাদি বৃদ্ধি করতে হবে। গ্রামপর্যায়ে চিকিৎসকদের আগ্রহী করে তুলতে সরকারকে প্রণোদনা দিতে হবে। পাশাপাশি সহায়ক অবকাঠামোও নিশ্চিত করতে হবে।