বাংলাভূমি ডেস্ক ॥
যাচ্ছো যখন যাও, কবে ফিরে আসবে আবার? তোমার কাছে কি কিছুই নয় আমার হাহাকার? কেন দিলে আমায় ব্যথা? এই কি ছিল তোমার কথা? বুঝিলে না আমায় তুমি মাত্র একটিও বার! যাচ্ছো যখন যাও, কবে ফিরে আসবে আবার? আজ শুধুই হাহাকার! বন্যা এতই নিষ্ঠুর। কত আপন যে তাতে হারিয়ে যায়! নদ-নদীর পানি বাড়া-কমার সন্ধিক্ষণে দুর্গত এলাকার হাজার হাজার মানুষের কাছে বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে শুধুই হাহাকার আর হাহকার! আশ্রয়, খাদ্য, পানীয় জল, চিকিৎসা, পোষা পশু-পাখি সংরক্ষণের অভাবে চলছে এই হাহাকার । এ ছাড়া বন্যাজনিত ভাঙন, প্লাবিত হওয়া এবং বিভিন্ন স্থানে ধসের ঘটনা ঘটেই চলেছে। প্রকৃতির নিয়মে পৃথিবীর যে কোনো দেশে প্রাকৃতিক বিপর্যয় আসতেই পারে। বাংলাদেশ ভূখণ্ড সাগরঘেঁষা নিচু জায়গা। স্বাভাবিক নিয়মে এটি দুর্যোগপ্রবণ। ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, বন্যা, কালবৈশাখী আমাদের নিত্যদিনের সঙ্গী। হাওর-বাঁওড়ে আগাম বন্যা নতুন কিছু নয়। বন্যা নিয়ন্ত্রণে রূপকল্প কোথায়?
হওরাঞ্চলের দুর্গতদের সেবায় এগিয়ে যাওয়া প্রত্যেক মানুষের নৈতিক দায়িত্ব। কিন্তু এখানে অনেককেই লোক দেখানো ত্রাণ দিতে দেখা গেছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, তাদের মূল উদ্দেশ্যই ছিল ফটোসেশন আর পাবলিসিটি।
পবিত্র আল কুরআনের সুরও অভিন্ন। ধর্মীয় ও নৈতিক অবক্ষয়ে পৃথিবী ভারাক্রান্ত হলেই আল্লাহ বন্যার মতো মুসিবত পাঠান। তিনি বলেন, ‘যখন তোমাদের ওপর মুসিবত এলো, যার দ্বিগুণ তোমরা ঘটিয়েছ, তখন তোমরা বললে, এটা কোত্থেকে এলো! (হে নবী) আপনি বলে দিন, এ তো তোমাদের পাপ থেকেই; নিশ্চয় আল্লাহ সব বিষয়েই সর্বশক্তিমান।’ (সুরা আল ইমরান: ১৬৫; মারেফুল কুরআন: ৬৭৫৩)।
চলমান বন্যায় দেশের এক-তৃতীয়াংশ এলাকা প্লাবিত হয়ে অর্ধকোটি মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে; এক সপ্তাহে মৃত্যু হয়েছে ৭৭ জনের। চলতি মৌসুমের দ্বিতীয় দফার এ বন্যায় এ পর্যন্ত ছয় লাখ ১৮ হাজার ৭০৯ হেক্টর জমির ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এতে কোথাও কোথাও অবর্ণনীয় পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। অনেক এলাকায় আশ্রয় নেয়ার মতো জায়গাও নেই। তাই কারও কারও আশ্রয় হয়েছে ঘরের চালা ও মাচায়। এখন পর্যন্ত তাদের খোঁজ কেউ নেয়নি। আবার যারা সব হারিয়ে উঁচু রাস্তায় আশ্রয় নিয়েছেন তারাও পাচ্ছেন না পর্যাপ্ত ত্রাণ। সরকার ও বেসরকারি পর্যায়ে যে সহায়তা দেয়া হচ্ছে তা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই সামান্য। তাই দেশের বানভাসি এলাকায় ত্রাণের জন্য হাহাকার চলছে।
নতুন কোনো মানচিত্র করা গেলে সেখানে এই এলাকাটার কোনো নাম থাকবে না। নামহীন, জনপদহীন, বৃক্ষহীন এক ধু ধু শূন্যতা। পুরো শূন্যতা এ নয়। আকাশের তলায় এর অর্ধেকটা জলে ভরা, আর বাকি অর্ধেকটা ফাঁপা-ফাঁকা, যা দিয়ে বয়ে যায় হাহাকারের বাতাস। আশাবাদী বলবেন, অর্ধেকটা তো ভরা। অবশ্যই, তবে জলে ভরা।
প্রতি বছর আমাদের দেশে বর্ষাকাল এলেই প্রাকৃতিক দুর্যোগ হিসেবে বন্যা দেখা দেয়। এমন হয়ে গিয়েছে যে, দেশে বৃষ্টিপাত হোক আর না হোক বর্ষা মৌসুমে বাংলাদেশে বন্যা অপরিহার্য। কেন না পানির প্রক্রিয়া, জলবায়ুর প্রভাব আর ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে বাংলাদেশ প্রাকৃতিকভাবে বন্যাপ্রবণ দেশ। আর এ কারণেই পাশ্চাত্যের গণমাধ্যমগুলো বাংলাদেশ আর বন্যা এই দুটি শব্দকে সমার্থক মনে করেন। বাংলাদেশ ভাটির দেশ হওয়ায় তারা এমনটি মনে করেন। তবে এবার অতিবৃষ্টির ফলে বন্যা হওয়ার চেয়ে ভারতের উজানের পানিই এই বন্যার জন্য দায়ী বলে প্রমাণ পাওয়া যায়। আর তাই অনেকে বাংলাদেশের বিদ্যমান বন্যাকে মানবসৃষ্ট বন্যা বলে অভিহিত করছেন। এই উজানের পানির ফলে উত্তরাঞ্চলসহ অনেক স্থানে এর প্রভাব লক্ষ করা গেছে। এবারের পাহাড়ি ঢল, অতিবৃষ্টিপাত আর ভারতের উজানের পানির প্রভাব এতই বেশি যে, প্রতিদিনই নিত্য-নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে আর পানিবন্দি হচ্ছে লাখ লাখ মানুষ। এসব মানুষ তাদের বসতবাড়ি আর সম্পদ হারিয়ে তারা আশ্রয় নিচ্ছে বাঁধের ওপর উঁচু স্থানে কিংবা খোলা আকাশের নিচে কোনো সড়কের পাশে। সবকিছু হারিয়ে এসব বানভাসি মানুষ এখন অসহায় হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছে। গত এক সপ্তাহ পানির প্রভাব বাড়ছে আর একেকটি করে বাঁধ ভাঙছে।
এবারের তিস্তাতে রেড অ্যালার্ট জারি ও বন্যার ভয়াবহতা দেখে কেউ কেউ ১৯৮৮ সালের বন্যার চেয়ে ভয়াবহ বন্যার আশঙ্কা করেছেন। আর এর কারণ দুটি প্রথমত, ১৯৮৭, ১৯৮৮ ও ১৯৯৮ সালে যে ধরনের বায়ু কিংবা মৌসুমি বায়ু ও গতিপ্রকৃতি দেখা গিয়েছিল এ বছর সেই একই রকম মৌসুমি বায়ু পরিলক্ষিত হচ্ছে। দ্বিতীয়ত, ১৯৮৮ সালের বন্যার সময় কুড়িগ্রাম ও রংপুর সড়কে পানি দেখা যায়নি। কিন্তু এ বছর এসব সড়ক পানিতে ডুবে গিয়ে খালে পরিণত হয়েছে। এ থেকে বুঝা যায় যে, এবারের বন্যার ভয়াবহতা কেমন? আর এ বন্যার ভয়াবহতায় গতকাল দুর্যোগ মন্ত্রণালয় যে হিসাব দিয়েছে তাতে ২৬টি জেলার ৯৬টি উপজেলা প্লাবিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে প্রায় ৩২ লাখ মানুষ। এ পরিসংখ্যান অনুসারে প্রায় ৭ লাখ ৫২ হাজার ৩৪৯টি পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, ১ লাখ ৬০ হাজার ৫৪৫টি ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, ৪ লাখ হেক্টর কৃষি জমি নষ্ট হওয়ার কথা কৃষি মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়। ৮ লাখ গরু, ৫৩ হাজার মহিষ, ২ লাখ ৩৭ হাজার ছাগল, ১ লাখ ৯ হাজার ভেড়া, ২৪ লাখ মুরগি ও ৬ লাখ হাঁস মারা যায় বলে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের মাধ্যমে জানা যায়। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে জানা যায়, ২ হাজার ৫০০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়েছে, ৪৭টি ব্রিজ, কালভার্ট ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে পানিবন্দি হওয়া মানুষের এই পরিসংখ্যান আরো ২৫ লাখ বেশি হবে। কেননা যারা একেবারে ঘরবাড়ি হারিয়ে অন্যত্র আশ্রয় নিয়েছে কেবল তাদের এই পরিসংখ্যানের আওতায় নিয়ে আসা হয়েছে। এ ছাড়াও শরীয়তপুর, মাদারীপুর, হবিগঞ্জ, সিলেট, সুনামগঞ্জ, কুমিল্লা, ফেনী, নোয়াখালী প্রভৃতি অঞ্চলের মানুষের দুর্দশার কথা এ পরিসংখ্যানে আনা হয়নি। এসব মানুষের দুর্দশার চিত্র যখন মানব সমাজে ভেসে আসছে তখন সবাই ত্রাণের জন্য চিৎকার করে নিজেকে মানবতাবাদী হিসেবে পরিচয় দিচ্ছে কিন্তু ত্রাণই এ অঞ্চলের একমাত্র সমাধান নয়। এসব অঞ্চলের লোকদের ভাগ্য উন্নয়নে ও বন্যা নিয়ন্ত্রণে রূপকল্প ঘোষণা করা জরুরি। বাংলাদেশ প্রতিদিন, যায়যায়দিন, প্রথম আলো, ভোরের কাগজ,