আন্তর্জাতিক ডেস্ক ॥
এ বছর আসামে ও বাংলাদেশে ভয়াবহ বন্যার পেছনে চীনের ঠিক কতটা ভূমিকা আছে, তথ্য আদান প্রদান না করার পেছনে দেশটির কোনও অভিসন্ধি ছিল কিনা এ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে ভারতে। ডোকলাম ইস্যু নিয়ে ইদানিং চীন ও ভারতের মধ্যে যে বনিবনা হচ্ছে না তারই প্রভাব বন্যা সম্পর্কিত আগাম তথ্য দুটি দেশের মধ্যে আদান প্রদানে বাঁধার সৃষ্টি করছে কি না সে প্রশ্ন রয়েই যাচ্ছে। এ কারণেই ভারতীয় কর্তৃপক্ষ বেইজিংয়ের দিকেই আঙুল তুলতে চাইছেন, সে ইঙ্গিত স্পষ্ট।
ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য আসামে ও প্রতিবেশী বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে এবছর যে ব্যাপক ও দীর্ঘস্থায়ী বন্যা পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, সাম্প্রতিককালের মধ্যে তার কোনও নজির নেই। বাংলাদেশ ও আসাম উভয় স্থানেই বন্যাকবলিতরা প্রায় একবাক্যে বলছেন বহু বছরের মধ্যে এমন খারাপ অবস্থা তারা আর দেখেননি। আসামের বিস্তীর্ণ অংশ গত এক মাসের ওপর ধরে জলের তলায়, কাজিরাঙা অভয়ারণ্য থেকে গন্ডার ও হাতির মতো বহু বন্য প্রাণীও আশ্রয়চ্যুত। বহু মানুষ বানভাসি হয়ে ভারত থেকে আশ্রয় নিয়ে বাংলাদেশেও।
তাই আসামের ব্রহ্মপুত্র অববাহিকা এবং বাংলাদেশে যমুনা (বাংলাদেশে ঢোকার পর ব্রহ্মপুত্রর নাম) অববাহিকায় এই ধরনের অভূতপূর্ব বন্যার জন্য কি চীন দায়ী এমন প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক।
প্রশ্নটা এই জন্যই উঠছে, কারণ ভারত সরাসরি অভিযোগ করেছে যে বহু বছরের পরম্পরা ভেঙে চীন এবার ভারতকে ব্রহ্মপুত্র নিয়ে কোনও হাইড্রোলজিক্যাল তথ্য দেয়নি। অর্থাৎ এবারের বর্ষা মওসুমে ব্রহ্মপুত্র দিয়ে কতটা পানি আসছে তার কোনও আগাম তথ্য ভারতের হাতে আদৌ ছিল না এবং সে কারণেই বন্যা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে বলে মনে করা হচ্ছে। আসামের এই বন্যার পানিই আবার ভাটিতে বাংলাদেশে নেমে কুড়িগ্রাম-দিনাজপুরের মতো জেলাগুলোকে প্লাবিত করেছে। অর্থাৎ বিশাল প্রতিবেশী দেশ ভারত ও চীনের বন্যার পানির ধকল সইতে হচ্ছে অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র বাংলাদেশকে। এ নিয়ে এ তিনটি দেশই আঞ্চলিক সহযোগিতার কথা ও নদী ব্যবস্থাপনার তাগিদ বহুকাল ধরে দিয়ে আসলেও কাজের কাজ কিছুই হয়নি। বরং বন্যার্তরা ফি বছর অর্থনৈতিক বৈষম্যের কবলে পড়ে আর উঠে আসতে পারছে না। গ্রামীণ অর্থনীতি মার খাচ্ছে নিদারুণভাবে। কৃষিতে ভর্তুকি অনুপস্থিত বলে কৃষককে ফসলহানির ভার নিতে হচ্ছে একা।
২০০৬ সালে স্বাক্ষরিত এক দ্বিপাক্ষিক সমঝোতায় চীন প্রতি বছর বর্ষা মওসুমে ব্রহ্মপুত্র ও শতদ্রু নদীর পানিপ্রবাহের বিষয়ে তথ্য (হাইড্রোলজিক্যাল ডেটা) ভারতকে দিয়ে থাকে। এই দুটি নদীরই উৎপত্তি চীনে, পরে তারা ভারতে প্রবেশ করেছে। ব্রহ্মপুত্র আবার ভারত থেকে বাংলাদেশে, আর শতদ্রু ভারত থেকে পাকিস্তানে প্রবাহিত হয়েছে।
চুক্তি অনুযায়ী চীনে প্রতি বছর ১৫ মে থেকে ১৫ অক্টোবর পর্যন্ত সময়কালের ভেতর ব্রহ্মপুত্র ও শতদ্রু নদীতে পানির পরিমাণ ভারতকে জানানোর কথা। এই চুক্তি নিয়ে গত বছরের জুনেও দু’দেশের মধ্যে বৈঠক হয়েছে এবং সমঝোতা নবায়নও হয়েছে। দিল্লির প্রখ্যাত সাংবাদিক রঞ্জন বসু জানিয়েছেন, ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নতুন মুখপাত্র রবীশ কুমার বলেছেন, ‘আশ্চর্যজনকভাবে চীন এ বছর আমাদের কোনও তথ্যই দেয়নি, কোনও ডেটাই শেয়ার করেনি। অথচ এই মওসুমে তাদের নিয়মিত ডেটা দেওয়ার কথা–এমনকি বন্যার সময় তো দৈনিক ভিত্তিতে তথ্য শেয়ার করার কথা।’
এই মুহুর্তে ভারত-চীন-ভুটানের সীমানায় বিতর্কিত ডোকলাম উপত্যকাতে চীন ও ভারতের মধ্যে যে সামরিক সংঘাত চলছে, তার সঙ্গে অবশ্য এখনই এই ঘটনার কোনও সম্পর্ক টানতে চাননি রবীশ কুমার। বরং তিনি বলেছেন, ‘হয়তো কোনও টেকনিক্যাল কারণেই তারা ডেটা দিয়ে উঠতে পারেনি’। এখানে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক ভারতও কি সময় মত বন্যার তথ্য বাংলাদেশকে সরবরাহ করে বা এবার করেছে। তিস্তা বাঁধের সবগুলো গেট দিয়ে প্রবল বেগে পানি ছুটছে, ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে ঘর বাড়ি, তলিয়ে গেছে ফসলের মাঠ। যদিও শুকনা মৌসুমে তিস্তায় কোনো পানি গড়ায় না।
অনেকেই মনে করছেন, ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এই মন্তব্যের মাধ্যমে আসামের ভয়াবহ বন্যার জন্য পরোক্ষভাবে চীনকেই দায়ী করতে চাইছে। পাশাপাশি বন্ধুপ্রতীম প্রতিবেশী বাংলাদেশকেও এই বার্তা দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে যে আমাদের ভুল বুঝবেন না চীনের অসহযোগিতার কারণেই পরিস্থিতি আমাদের হাতের বাইরে বেরিয়ে গেছে, কারণ তারা ব্রহ্মপুত্র দিয়ে কবে কতটা পানি আসছে সে সব কিছুই আমাদের জানায়নি।
প্রসঙ্গত: ব্রহ্মপুত্র তথা যমুনার হাইড্রোলজিক্যাল ডেটা বিনিময় নিয়ে বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যে কোনও সমঝোতা নেই, এ ব্যাপারে ঢাকা পুরোপুরি দিল্লির দেওয়া তথ্যের ওপরেই নির্ভরশীল।
ভারতেই আবার একদল বিশেষজ্ঞ মনে করছেন এখানে চীনকে পুরোপুরি দায়ী করাটা ঠিক হবে না, কারণ আসামে এবার রেকর্ড পরিমাণ মৌসুমি বৃষ্টিপাতও হয়েছে।
ভারতের আবহাওয়া বিভাগের দেওয়া তথ্য উদ্ধৃত করেই গৌহাটি বিশ্ববিদ্যালয়ের হাইড্রোলজি বিষেয়ক বিশেষজ্ঞ মীনাক্ষি বোরা বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় অনলাইন মিডিয়া বাংলা ট্রিবিউনকে বলছিলেন, ‘১লা জুন থেকে ১৬ আগস্টের মধ্যে আপার আসামের অন্তত পাঁচটি জেলায় স্বাভাবিকের চেয়ে যে অনেক বেশি বৃষ্টি হয়েছে সেটা তো সরকারের দেওয়া তথ্যেই দেখা যাচ্ছে। এই জেলাগুলো হল চিরাং, লখিমপুর, শোণিতপুর, নর্থ কাছাড় হিলস ও করিমগঞ্জ। বিশেষ করে চিরাং জেলায় এই মওসুমে স্বাভাবিকের দেড়গুণেরও বেশি বৃষ্টিপাত হয়েছে আর নিঃসন্দেহে এটা রাজ্যে নজিরবিহীন বন্যার পেছনে একটা বড় কারণ।’