সোমবার , ১১ই নভেম্বর, ২০২৪ , ২৬শে কার্তিক, ১৪৩১ , ৮ই জমাদিউল আউয়াল, ১৪৪৬

হোম > Uncategorized > বন্দি মানুষ বিপর্যস্ত অর্থনীতি

বন্দি মানুষ বিপর্যস্ত অর্থনীতি

শেয়ার করুন

বাংলাভূমি২৪ ডেস্ক ॥ অবরোধের পর অবরোধ। রাজধানী ঢাকা কার্যত বিচ্ছিন্ন। ভয় আর আতঙ্কে বন্দি জীবন কাটাচ্ছে মানুষ। ২৬শে নভেম্বর থেকে ৫ দফায় ২০ দিনের অবরোধ কর্মসূচি পালন করছে বিরোধী জোট। এ অবরোধে ভেঙে পড়েছে দেশের পণ্য পরিবহন ব্যবস্থা। বিপর্যস্ত অর্থনীতি। সবচেয়ে বড় হুমকির মুখে গার্মেন্ট খাত। ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই, ঢাকা চেম্বার এবং গার্মেন্ট মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ’র হিসাব অনুযায়ী, হরতাল-অবরোধে প্রতিদিন অর্থনীতির ক্ষতি হয় ১৫০০ কোটি টাকা। সে হিসাবে চলতি অবরোধ কর্মসূচিতে দেশের ক্ষতি হয়েছে ৩০ হাজার কোটি টাকা।

নির্বাচনী তফসিল ঘোষণার পর থেকে চলা সহিংসতায় এ পর্যন্ত প্রাণ হারিয়েছেন কমপক্ষে ১১৭ জন। রাজনৈতিক সহিংসতায় অগ্নিদগ্ধ হয়ে মারা গেছেন ১৫ জন। একই ধরনের ঘটনায় আহত প্রায় ১০০ জন শুধু ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিট থেকেই চিকিৎসা নিয়েছেন। পেট্রল বোমা আর ককটেল বিস্ফোরণ এখন একেবারেই নিয়মিত ঘটনা।

নিরীহ অনেক মানুষই শিকার হচ্ছেন বিস্ফোরণের। পুলিশের ওপর হামলা এবং প্রতিপক্ষের রাজনৈতিক কর্মীদের বাড়িতে ভাঙচুর আর অগ্নিসংযোগের ঘটনাও ঘটেছে। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছেন, অবরোধের কারণে দেশের অর্থনীতির যে ক্ষতি হচ্ছে তা কাটিয়ে ওঠা কষ্টসাধ্য ব্যাপার। তিনি বলেন, উপরে ওঠা কঠিন, কিন্তু নিচে নামা সহজ।

বাংলাদেশে অর্থনীতি নাজুক অবস্থায় পড়েছে বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদ ও সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ-সিপিডি’র ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য্য। তিনি বলেন, বিদেশীরা এখন সবচেয়ে বেশি দুশ্চিন্তায় রয়েছেন বাংলাদেশে তাদের ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগ নিয়ে। সহিংস পরিস্থিতিতে কর আরোহন সীমিত হয়ে পড়েছে। যেসব বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ক্ষুদ্র ঋণ দিচ্ছিলো তাদের কার্যক্রমও ব্যাহত হচ্ছে। বাংলাদেশে এই মুহূর্তে যা ঘটছে অনেকে শুধু তার স্বল্পমেয়াদি প্রতিক্রিয়ার কথা ভাবছেন, কিন্তু মধ্য মেয়াদি প্রতিক্রিয়ার কথা ভাবছেন না।

অর্থনীতিতে ধস: টানা অবরোধে অচল হয়ে পড়েছে পণ্য পরিবহন ব্যবস্থা। আমদানি-রপ্তানি বন্ধ স্থল বন্দরে।

বিদেশে যাচ্ছে না পণ্য। অলস বসে আছে শ্রমিকেরা। ভাল ফসল ফলিয়েও দাম পাচ্ছে না কৃষক। বন্ধ হয়ে গেছে মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি। কমে গেছে ব্যাংক ঋণ। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) সামপ্রতিক এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, হরতাল ও অবরোধের কারণে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বড় ধরনের ক্ষতি হচ্ছে। সরবরাহ ব্যবস্থা বিঘ্ন ঘটছে।

এতে এবার বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি কমে হবে সাড়ে ৫ শতাংশ। গত অর্থবছরে এই প্রবৃদ্ধি ছিল ৬ দশমিক ২ শতাংশ। বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস এসোসিয়েশনের হিসাব অনুযায়ী, প্রতি মাসে বস্ত্রখাতের তুলা ও সুতা পরিবহনে ১২ হাজার ট্রাক লাগে। কিন্তু অবরোধের কারণে এবার এ ট্রাক পাওয়া যাচ্ছে না। ঋণদাতা না পাওয়ায় ব্যাংকে অলস পড়ে আছে ২৮ হাজার কোটি টাকা। বিদেশী বিনিয়োগও কমে গেছে আশঙ্কাজনকভাবে।

বিদেশী বিনিয়োগ প্রস্তাব নিবন্ধনের হার চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে মাত্র ৩৫টি। গত অর্থবছরে এ সংখ্যা ছিল ২১৯। চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসে (জুলাই-অক্টোবর) বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন হয়েছে ১৫ শতাংশ, যা গত অর্থবছরের তুলনায় ৫ শতাংশ কম। শুধু তাই নয়, উৎপাদিত পণ্যের সরবরাহ ব্যবস্থা ভেঙে পড়ায় একদিকে উৎপাদন যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, তেমনি চাপ বাড়ছে ভোক্তাদের ওপর। বাণিজ্য কমেছে উত্তর-পূর্ব ভারতের রাজ্যগুলোর সঙ্গে। আখাউড়া স্থল বন্দর দিয়ে গত বছর ত্রিপুরার সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য হয় ২৫৪ কোটি রুপি।

এ বছরের প্রথম সাত মাসে মাত্র ৭৫ কোটি রুপি বাণিজ্য হয়েছে। ব্যবসায়ীদের দাবি, রাজনৈতিক অচলাবস্থার কারণে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত পোশাক খাতে পণ্য সরবরাহে ৪০০০ কোটি টাকার বেশি ক্ষতি হয়েছে। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের কাছে পাঠানো এক চিঠিতে বিজিএমইএ সভাপতি আতিকুল ইসলাম, বিকেএমইএ সভাপতি সেলিম ওসমান এবং বিটিএমএ সভাপতি জাহাঙ্গীর আলামিন এমন দাবি করেন।

চিঠিতে তারা জানান, চলমান পরিস্থিতিতে পোশাক খাতে উৎপাদন ১০ শতাংশ কমে গেছে। অক্টোবরে পোশাক খাতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে মাত্র ২ শতাংশ। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদনে দেখা গেছে, বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোয় অলস টাকার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৮২ হাজার ৩৪৪ কোটি টাকা। এক বছর আগে ছিল ৪০ হাজার কোটি টাকার নিচে। রাজনৈতিক অস্থিরতায় বিনিয়োগ না হওয়ায় অলস টাকা বাড়ছে। ব্যাংকগুলোর মুনাফায় ধস নেমেছে।

আতঙ্ক সর্বত্র: অবরোধে সবকিছু স্বাভাবিক দেখানোর প্রাণান্তকর চেষ্টা চলছে সরকারের পক্ষ থেকে। পুলিশ পাহারায় সরকারি-বেসরকারি বাস চালানোরও উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। কিন্তু সুফল তেমন মিলছে না। দেশের বিভিন্ন স্থানেই এসব বাস আক্রমণের শিকার হচ্ছে। যে অল্প কয়েকটি দূরপাল্লার বাস চলছে এসব বাসও যাত্রী পাচ্ছে না। সরকারি ঘোষণার কারণে অনেকটা বাধ্য হয়েই কিছু বাস চলছে। ট্রেন যোগাযোগও বিঘ্নিত হচ্ছে নিয়মিত।

অনেক সাধারণ মানুষও শিকার হচ্ছেন রাজনৈতিক সহিংসতার। রূপগঞ্জ আগারপাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তৃতীয় শ্রেণীর ছাত্র শান্ত। খালার বাসায় বেড়াতে এসেছিল ঢাকায়। গত ১৩ই ডিসেম্বর আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের সামনে জামায়াত-শিবিরের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষের মাঝে পড়ে যায় সে। পুলিশের গুলিতে ক্ষত-বিক্ষত হয় ছোট্ট শিশুটি। গত ২৮শে নভেম্বর শাহবাগে গাড়িতে পেট্রল বোমা নিক্ষেপ করে অগ্নিসংযোগের ঘটনায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্র। ১৯ জন যাত্রী অগ্নিদগ্ধ হন এতে। মারা যান চার জন। বার্ন ইউনিটে অগ্নিদগ্ধদের দেখতে গেলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে লক্ষ্য করে গীতা সেন নামে আহত একজন বলেন, আমরা অসুস্থ রাজনীতি চাই না। এই নারী এখনও চিকিৎসাধীন রয়েছেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে। শাহবাগ ছাড়াও দেশের বিভিন্নস্থানে গাড়িতে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটছে। ককটেল বিস্ফোরণে অনেক শিশুও আহত হয়। সর্বশেষ রোববার রাজশাহীতে স্থানীয় আওয়ামী লীগ কার্যালয় থেকে কুড়িয়ে পাওয়া ককটেল বিস্ফোরণে উড়ে গেছে এক শিশুর কবজি। সামপ্রতিক আন্দোলনে ককটেল বিস্ফোরণে ঠিক কত সংখ্যক মানুষ আহত হয়েছেন তা নিশ্চিত করা না গেলেও কয়েক শ’ মানুষ এতে আহত হয়েছেন বলে জানা গেছে।