শনিবার , ২১শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ , ৬ই আশ্বিন, ১৪৩১ , ১৭ই রবিউল আউয়াল, ১৪৪৬

হোম > গ্যালারীর খবর > ফের রগকাটার রাজনীতিতে শিবির

ফের রগকাটার রাজনীতিতে শিবির

শেয়ার করুন

স্টাফ রিপোর্টার ॥ সরকারের শেষ সমযে ফের বেপরোয়া হয়ে উঠেছে উগ্র মৌলবাদী ছাত্রসংগঠন ছাত্রশিবির।

গত দুই মাসে দেশের বিভিন্ন ক্যাম্পাসে অন্তত ছয়জন ছাত্রলীগ নেতার হাত ও পায়ের রগ কেটেছে শিবির ক্যাডাররা। তবে এসব ঘটনার প্রত্যেকটিকেই ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দল দাবি করে পার পেয়ে যাচ্ছে সংগঠনটি।

সর্বশেষ মঙ্গলবার, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় (রাবি) ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক শরিফুল ইসলাম সাদ্দামের (২৬) পায়ের রগ কেটেছে শিবির ক্যাডারা। এ সময় গোলাম রব্বানী তুফান নামে ছাত্রলীগের এক সাবেক কর্মী গুলিবিদ্ধ হন। মঙ্গলবার দুপুর ১২টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের পার্শ্ববর্তী বিনোদপুর এলাকায় ঘটে এ ঘটনা।

ছাত্রলীগ দাবি করেছে, শিবির ক্যাডাররাই এ ঘটনা ঘটিয়েছে। গুরুতর আহত অবস্থায় সাদ্দাম ও তুফানকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।

এর আগে গত মাসে রংপুর কারমাইকেল কলেজে মোশারফ হোসেন নামে এক ছাত্রলীগ নেতার পায়ের রগ কাটে শিবির ক্যাডারা। তার কিছু দিন আগে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক এসএম তৌহিদ আল হোসেন ওরফে তুহিনের হাত ও পায়ের রগ কেটে দেয় শিবির ক্যাডাররা। এখনও রাজধানীর পঙ্গু হাসপাতালে ভর্তি আছেন তুহিন।

শিবির সূত্রে জানা গেছে, সরকারের শেষ সময় এসে ক্যাম্পাসকে অস্থিতিশীল ও নিজেদের আধিপত্য বিস্তার করতেই পরিকল্পিভাবে এসব সন্ত্রাসী ঘটনা ঘটানো হচ্ছে। উদ্দেশ্য প্রতিপক্ষকে ঘায়েলের পাশাপাশি মানসিকভাবে তাদের ভেঙ্গে দেওয়া। কেন্দ্রীয় নির্দেশেই এ সব করা হচ্ছে বলে জানা গেছে।

রাবির তুহিনের রগকাটার পর ২৪ আগস্ট সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (শাবি) ছাত্রলীগ কর্মী রুহল আমিনের পায়ের রগ কেটে দেয় শিবির ক্যাডাররা। রাত ৯টার দিকে ক্যাম্পাসের ভেতর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ছাত্র রুহুল আমিনের ওপর হামলা চালায় ৮-১০ জন মুখোশধারী শিবির ক্যাডার। এ সময় এলোপাতাড়ি কুপিয়ে তার পায়ের রগ কেটে দেওয়া হয়। তবে এসব ঘটনার সঙ্গেও ছাত্রলীগ জড়িত বলে নিজেদের আড়াল করার চেষ্টা করে শিবির।

কারমাইকেলে কলেজের ঘটনাতেও একইরকমভাবে প্রতিবাদ করে নিজেদের সম্পৃক্ততা অস্বীকার করে শিবির। এ ঘটনার পিছনে ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলকে দায়ী করে ঘটনার রাতেই একটি বিবৃতি পাঠায় শিবির। বিবৃতিতে জানানো হয় কারমাইকেলের ঘটনার সঙ্গে শিবিরের সম্পৃক্ততা নেই।

কারমাইকেল কলেজ শাখা শিবিরের সভাপতি আরিফুল ইসলাম বিবৃতিতে দাবি করেন, দীর্ঘদিন ধরে কারমাইকেল কলেজ ছাত্রলীগের দু‘গ্রুপের অন্তর্কোন্দল চলে আসছিলো। এরই ধারাবাহিকতায় এমন ঘটনা ঘটতে পারে । তাছাড়া মোশাররফ নিজেও একজন চিহ্নিত সন্ত্রাসী। তার অত্যাচারে কারমাইকেল কলেজ সংলগ্ন কলেজপাড়া সহ ক্যাম্পাসের আশেপাশের এলাকাবাসী অতিষ্ঠ।

এভাবেই একই পদ্ধতিতে গত বছরের ২২ নভেম্বর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি আখেরুজ্জামান তাকিমের রগ কেটে দেয় শিবির।

যেভাবে শুরু শিবিরের রগ কাটার রাজনীতি: আশির দশকের গোড়ার দিকে রাবিতে শিবির তাদের জাল বিস্তার করতে শুরু করে। ওই সময় ক্যাম্পাস প্রভাবশালী ছাত্রসংগঠন ছাত্রমৈত্রীর দখলে থাকলেও গোপনে মসজিদভিত্তিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা শুরু করে শিবির। ধীরে ধীরে ক্যাম্পাস পার্শ্ববর্তী এলাকায় ছাত্রাবাসগুলো ঘিরে নিজেদের জাল জোরদার করতে শুরু করে শিবির। পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মেয়েদের বিয়ে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি নিয়ে ক্যাম্পাসে নিজেদের অবস্থান শক্তিশালী করে তারা।

পরবর্তীতে ক্যাম্পাসে সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী হয়েই অন্যান্য ছাত্রসংগঠনের উপর হামলা চালাতে শুরু করে তারা। হামলায় কাজ না হলে হাত ও পায়ের রগ কেটে দেওয়ার কৌশল নেয়। উপরের নির্দেশে এভাবেই রগ কাটার রাজনীতি শুরু করে শিবির।

শুধু রাজশাহীই নয়, শিবির নিয়ন্ত্রিত প্রত্যেকটি ক্যাম্পাসেই িিশ্বরের এমন রগ কাটার ইতিহাস অসংখ্য।

এ সরকারের সময়ই নৃশংসভাবে খুন করা হয় রাবি ছাত্রলীগ কর্মী ফারুককে। ২০১০ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি রাতে রাবির এসএম হলে খুন করে ম্যানহোলে ফেলে রাখা হয় তার লাশ। এ সময় চার ছাত্রলীগ কর্মীরও হাত-পায়ের রগ কাটে শিবির। তারা এখনও সুস্থ জীবনে ফিরতে পারেননি।

২০০৬ সালে রাবি ক্যাম্পাসে প্রাণীবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. তাহেরকে খুন করে দুর্র্ধষ শিবির ক্যাডাররা। বাসার পেছনের সেফটি ট্যাংক থেকে তার লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। এ খুনের মামলারও প্রধান আসামি ছিলেন তৎকালীন রাবি শিবির সভাপতি মাহবুবুল আলম সালেহী। কিন্তু পরবর্তীতে আদালত থেকে বেকসুর খালাস পান তিনি।

২০০৪ সালে ২৪ ডিসেম্বর একই বিশ্ববিদ্যালয় অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ ইউনুস হত্যাকাণ্ডেও শিবিরের সম্পৃক্ততার অভিযোগ ওঠে।

এভাবেই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর কারমাইকেল কলেজ, বরিশালে বিএম কলেজসহ দেশের প্রধান উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠাগুলোতে রগ কাটার সংস্কৃতি শুরু করে শিবির।

বর্তমান সরকারের শুরুর দিকে ২০১০ সালে ৮ ফেব্রুয়ারি রাজশাহীতে মহানগরীতে জামায়াতের বর্তমান আমীর (বর্তমানে যুদ্ধাপরাধ মামলায় বিচারের মুখোমুখি) মতিউর রহমান নিজামীর সফর শেষ হওয়ার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ১৭ জন ছাত্রলীগ কর্মীর রগ কাটে শিবির।

এছাড়া চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে গত দুই দশকে শিবিরের হাতে প্রাণ হারিয়েছেন অন্তত ১৫ জন। ৯০ দশকের পর চবিতে শিবির প্রকাশ্যে রাজনীতি শুরু করে। এ সময় যারাই শিবিরের কাজে বাধা হয়ে দাঁড়াতো প্রকাশ্যেই তাদের হাত পা রগ কেটে দেওয়ার নীতি গ্রহণ করে শিবির।

ছাত্রলীগের কোন্দলের সুযোগ নেয় শিবির: দেশের অধিকাংশ ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের ভেতর ঘাপটি মেরে থাকা শিবির ক্যাডাররা ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের সুযোগ নেয়। হামলা করে পরে দোষ চাপায় ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের ওপর। গত মাসে রাবি ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক তুহিনের রগ কাটার সঙ্গে ছাত্রলীগ জড়িত এ রকম খবরও প্রকাশ হয় খবরের কাগজে। পরে এই রগ কাটার সঙ্গে ছাত্রলীগের একটি পক্ষ জড়িত বলে প্রমাণ পায় পুলিশও।

আর ছাত্রলীগের এসব অভ্যন্তরীণ কোন্দলকে কাজে লাগিয়েই টার্গেটকৃত ছাত্রলীগ কিংবা ভিন্ন মতাদর্শের নেতাদের ওপর ঠাণ্ডা মাথায় হামলা চালায় শিবির।

শিবির সূত্র থেকে জানা গেছে, গত বছর প্রকাশ্যে অস্ত্র উচিয়ে ধাওয়া দিয়ে শিবিরকে ক্যাম্পাস থেকে বের করে দেয় রাবি ছাত্রলীগ নেতা তুহিন। এরপর থেকেই মূলত তাকে টার্গেট করে শিবির। ছাত্রলীগের ভেতর ঘাপটি মেরে থাকা শিবির কর্মীদের ব্যবহার শুরু করে সংগঠনটি। তুহিনের প্রতিপক্ষ গ্রুপটিকে নানাভাবে সহযোগিতা করতে শুরু করে ছাত্রলীগের লেবাসধারী শিবির কর্মীরা। পরবর্তীতে সুযোগ বুঝে ক্যাম্পাসে তার উপর অর্তকিত হামলা চালানো হয়। হামলার সময় তুহিনের সঙ্গে কোন কর্মী ছিল না। এভাবেই ছাত্রলীগের মধ্যে দ্বন্দ্ব তৈরি করে নিজেদের স্বার্থ হাসিল করে শিবির।