বাংলাভূমি২৪ ডেস্ক ॥
ঢাকা: প্রতœতত্ত্বের পুরোধা ব্যক্তিত্ব, পুঁথিসাহিত্যবিশারদ ও অনুবাদক আ ক ম যাকারিয়া আর নেই (ইন্না লিল্লাহী… রাজিউন)।
রাজধানীর সমরিতা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় বুধবার (২৪ ফেব্রুয়ারি) সকাল ১১টা ৪৮ মিনিটে তিনি শেষ নি:শ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৯৭ বছর।
তিনি স্ত্রী, ২ ছেলে, ৩ মেয়ে, আত্মীয়-স্বজন, গুণগ্রাহী ও অসংখ্য শুভাকাঙ্ক্ষি রেখে গেছেন।
গত ২৬ নভেম্বর থেকে সমরিতা হাসপাতালে ডা. মামুনুর রশিদ ও ডা. কামরুল আলমের তত্ত্বাবধানে চিকিৎসা নিচ্ছিলেন আ ক ম যাকারিয়া।
অবস্থার অবনতি হলে সোমবার (২২ ফেব্রুয়ারি) রাতে তাকে ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে (আইসিইউ) রাখা হয়। অবস্থার আরো অবনতি হলে মঙ্গলবার তাকে নেওয়া হয় লাইফ সাপোর্টে।
বুধবার সকাল ১১টা ৪৮মিনিটে লাইফ সাপোর্ট খুলে চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন বলে বাংলানিউজকে জানান আ ক ম যাকারিয়ার মেঝ ছেলে মারুফ শমসের যাকারিয়া।
বার্ধক্যজনিত নানা জটিল রোগে ভুগছিলেন আ ক ম যাকারিয়া। এর মধ্যে ফুসফুস সংক্রমণজনিত ব্যাধিই বেশি কাবু করে ফেলেছিল এ বঙ্গের এ কৃতি সন্তানকে।
শেষ দিকে এসে তার কিডনিসহ শরীরের কোনো অর্গানই কাজ করছিল না ঠিক মত। চিকিৎসকরা বার বার চেষ্টা করেও ফুসফুসের শ্বাস-প্রশ্বাস ও কিডনির রক্তচলাচল স্বাভাবিক রাখতে পারছিলেন না।
গত ৩ বছর ধরেই অসুস্থ ছিলেন আ ক ম যাকারিয়া। রাজধানীর কলবাগানের ১৬ লেক সার্কাস’র বাসা ও হাসপাতালেই কাটছে তার শেষ ৩ বছর। সর্বশেষ গত ২৬ নভেম্বর থেকে টানা ২ মাস ২২ দিন এক নাগাড়ে সমরিতা হাসাপাতালের ৯৭৩ নম্বর কেবিনে ভর্তি ছিলেন তিনি।
একজন সরকারি চাকরিজীবী হয়েও ইতিহাস ও প্রতœত্বত্ত্বের জন্য যে কাজ তিনি করেছেন, এক কথায় তা অনন্য-অসাধারণ। এখনো বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো তরুণ শিক্ষক বা নবীন গবেষক প্রতœত্বত্ত্ব নিয়ে কাজ করতে চাইলে প্রথমেই শরনাপন্ন হতে হতো আ ক ম যাকারিয়ার।
গুণি এ মানুষটির কর্মজীবন শুরু হয়েছিল শিক্ষকতা দিয়ে। ১৯৪৬ সালে বগুড়ার আজিজুল হক কলেজে ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যের প্রভাষক হিসেবে চাকরি জীবন শুরু হয় তার। প্রায় পৌনে দুই বছর সেখানে কাজ করার পর যোগ দেন সিভিল সার্ভিসে।
১৯৪৬ সালের প্রথম দিকে তিনি যখন বগুড়া আজিজুল হক কলেজের প্রভাষক, তখন একদল ছাত্র রংপুর থেকে মহাস্থানগড়ে যান। জ্ঞান তাপস ডক্টর মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ্ তখন বগুড়া আজিজুল হক কলেজের প্রিন্সিপাল।
প্রতœতত্বে বিশেষ আগ্রহ থাকায় আ ক ম যাকারিয়াকে ছাত্রদের সঙ্গে মহাস্থানগড়ে পাঠান ডক্টর মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ। সেখানে গিয়ে প্রতœসম্পদের রতœভাণ্ডার দেখে অভিভূত হন তিনি। ভাবতে থাকেন, এতসব প্রাচীন ধ্বংসাবশেষ আছে আমাদের! যেদিকে চোখ পড়ে, শুধু ধ্বংসাবশেষ আর ধ্বংসাবশেষ। সেখান থেকে প্রতœতত্ত্ব ও প্রতœসম্পদের প্রতি আগ্রহ আরো বেড়ে যায় আ ক ম যাকারিয়ার।
সিভিল সার্ভিসে যোগ দেওয়ার পর ১৯৫৮ সালে অ্যাডমিনিস্ট্রেশন সম্পর্কে পড়াশোনা করতে আ ক ম যাকারিয়াকে পাঠানো হয় সাউদার্ন ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে। বিশ্ববিদ্যালয়ের কোর্স শেষে দেড় মাস ছুটি নেন তিনি। এই দেড় মাস গ্রিস, রোম ও মিসরের পিরামিডসহ ইউরোপ ও আমেরিকার প্রতœতাত্ত্বিক স্থানগুলো চষে বেড়ান।
পরে ইন্দোনেশিয়ায় গিয়ে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বৌদ্ধমন্দির দেখে আসেন। তখন থেকেই নোট রাখা শুরু করেন তিনি। লেখা শুরু ১৯৭৬ সালে সরকারি চাকরি থেকে অবসরের পর।
বিশিষ্ট প্রতœতাত্ত্বিক নলিনীকান্ত ভট্টশালীর সান্নিধ্য পেয়েছিলেন আ ক ম যাকারিয়া। মিউজিয়ামের কিউরেটর নলিনীকান্তের ছেলে ছিলেন তার সহপাঠী। ঢাকা কলেজে এক সঙ্গে পড়তেন। সেই সুবাদে প্রায়ই যেতেন নলিনীকান্তের বাসায়। প্রশ্ন করতেন—এটা কী মূর্তি, ওটা কী মূর্তি। নলিনীকান্ত হেসে হেসে সব প্রশ্নের উত্তর দিতেন।
রেভিনিউ হেড হিসেবে দিনাজপুরে দায়িত্বপালনকালে যেসব গ্রামে রেভিনিউ কালেকশনে যেতে হত তাকে, সেসব গ্রামে ছিল পাল, গুপ্ত ও সেন আমলের প্রাচীন কীর্তি। এ সবের মধ্যে তিনি অসাধারণ প্রতœসম্পদের সন্ধান পান। কিন্তু দুই বছর পর তাকে ময়মনসিংহ বদলি করা হয়।
পরে ১৯৬৮ সালে ডেপুটি কমিশনার হিসেবে ফের দিনাজপুরে পোস্টিং দেওয়া হয় তাকে। এবার সেখানে একটি বাঁধানো মাউন্ড (ঢিবি) পান তিনি। তার পূর্বসূরি ওয়েস্ট মে কট ওটাকে বাঁধানো পুকুর বলেছিলেন।
কিন্তু যাকারিয়া বললেন, এটি কোনো মতেই বাঁধানো পুকুর হতে পারে না। চারদিকে দেয়াল, মাঝখানে বাঁধানো জায়গা। ইট বেরিয়ে আছে। তিনি প্রতœতত্ত্ব অধিদপ্তরকে খনন করার কথা বললেন। সরকারকে বুঝিয়ে ১০ হাজার টাকা বরাদ্দ পেলেন খনন করার জন্য। তখন সেখান থেকে একটি ইমারত বের হল। এটিই পঞ্চম থেকে ষষ্ঠ শতকের সিতাকোট বিহার। বাংলার প্রাচীনতম বৌদ্ধবিহার।
শুধু প্রতœতত্ত্ব চর্চা নয়, অনুবাদ সাহিত্যে অপরিসীম অবদান রয়েছে আ ক ম যাকারিয়ার। প্রতœতত্ত্ব বিষয়ে পড়তে পড়তে এক সময় ইখতিয়ার উদ্দিন মোহাম্মদ বখতিয়ার খিলজির বঙ্গবিজয় নিয়ে প্রচুর পড়েন তিনি। সেই সময় মিনহাজ-ই-সিরাজের তবাকত-ই নাসিরি সম্পর্কে জানতে পারেন। সংগ্রহ করেন বইটি। ফরাসী ভাষায় লেখা এই বই পরে বাংলায় অনুবাদ করেন আ ক ম যাকারিয়া।
পুঁথিসাহিত্য নিয়েও কাজ করেছেন তিনি। বাবা ফারসি পণ্ডিত ছিলেন। কিন্তু কোনো চাকরি পাননি। বাড়িতেই থাকতেন তিনি। পুঁথিপাঠের প্রতি তাঁর গভীর আগ্রহ ছিল। গ্রামের মানুষ তাঁকে নিয়ে যেত পুঁথি শুনতে।
যাকারিয়াও যেতেন বাবার পুঁথিপাঠ শুনতে। বদিউজ্জামানের পুঁথি, গাজী কালু চম্পাবতীর পুঁথি—আরও অনেক পুঁথি শুনেছেন বাবার মুখে। সেখান থেকে পুঁথিসাহিত্যের প্রতি আগ্রহ তৈরি হয়।
চাকরি করার সময় বিভিন্ন জায়গায় থেকে হাতে লেখা পুঁথি সংগ্রহ করেন তিনি। এর মধ্যে নাথ সাহিত্যের বড় যোগীর পুঁথি পড়ে মুগ্ধ হন। এ বিষয়ে গুপিচন্দ্রের সন্ন্যাস নামে একটি বইও লেখেন। এর পর তিনি গাজী কালু চম্পাবতীর পুঁথি নামে আরেকটি গ্রন্থ লেখেন।
আ ক ম যাকারিয়া সারাজীবন কাজ করেছেন। কিন্তু পদক ও পুরস্কারের পেছনে ছোটেননি কখনো। বরং পুরস্কারই তার পেছনে ছুটেছে। ২০১৫ সালে পেয়েছেন একুশে পদক ও ২০১৬ সালে আমিন জুয়েলার্স গুণজন সম্মাননা।
এর আগে পেয়েছেন বাংলা একাডেমি, ইতিহাস পরিষদ ও ইতিহাস একাডেমি পদক।
এছাড়া এশিয়াটিক সোসাইটি অব বাংলাদেশ তাকে ম্যান অব দ্য ইয়ার গোল্ড মেডেল দিয়েছে।