শনিবার , ২১শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ , ৬ই আশ্বিন, ১৪৩১ , ১৭ই রবিউল আউয়াল, ১৪৪৬

হোম > গ্যালারীর খবর > পাল্টেছে দখলদার, বদলে গেছে গডফাদার

পাল্টেছে দখলদার, বদলে গেছে গডফাদার

শেয়ার করুন

স্টাফ রিপোর্টার ॥ রাজধানীর সর্ববৃহৎ বস্তি কড়াইলের গ্যাস-পানি-বিদ্যুৎ চুরির মহোৎসব নিয়ে তোলপাড় চলছে, কিন্তু অপরাধ তৎপরতা কমেনি মোটেও। রাষ্ট্রীয় সম্পদের অবাধ লুটপাটও চলছে পাল্লা দিয়েই। সেখানে শুধু পাল্টে গেছে দখলদার, বদলে গেছে গডফাদার। গ্যাস, বিদ্যুৎ, ওয়াসার পানির চোরাই সংযোগ দেওয়া আর বিচ্ছিন্ন করা নিয়ে চলছে ইঁদুর-বিড়ালের খেলা। ডেসার অভিযানকারী টিম সদস্যরা প্রায় প্রতিদিনই চোরাই বিদ্যুৎ সংযোগগুলো বিচ্ছিন্ন করে দিলেও গভীর রাতে দুর্নীতিবাজ কর্মচারীদের সহায়তায় আবার পুনঃসংযোগ লাগিয়ে নেওয়া হচ্ছে। তিতাস গ্যাসের সংযোগ বিচ্ছিন্নকরণ ও চোরাই সংযোগ দেওয়া নিয়েও চলছে অভিন্ন তেলেসমাতি। শুধু বেড়ে গেছে চাঁদা আর ঘুষের রেট।

মিডিয়ায়’টোকাই যখন কোটিপতি’ শিরোনামে গ্যাস-বিদ্যুৎ-ওয়াসার পানি চুরি নিয়ে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশের পর থেকেই তোলপাড় শুরু হয়েছে। ডেসা, তিতাস গ্যাস ও ওয়াসার পক্ষ থেকে একের পর এক তদন্ত টিমের ছোটাছুটি চলছে, বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে বেশ কিছু বিদ্যুৎ ও গ্যাসের অবৈধ সংযোগ লাইন। চিহ্নিত অপরাধীদের গ্রেফতারে র্যাব-পুলিশ ও ডিবির অভিযানও চলছে সমানতালে। তবে এসব অভিযানে বস্তির পুরনো দখলদার সন্ত্রাসীরা গা-ঢাকা দিতেই নতুন গ্রুপের সন্ত্রাসীরা তা দখল করে নিয়েছে। তারা কড়াইল বস্তির ৪০ হাজার পরিবার থেকে রাতারাতি কয়েক কোটি টাকা চাঁদাও আদায় করে নিয়েছে। চাঁদাবাজির টাকায় ঘুষ প্রদানের মাধ্যমে ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই গ্যাস-বিদ্যুৎ ও পানির চোরাই সংযোগ আবার লাগিয়ে নেওয়া হচ্ছে। গত দুই দিন কড়াইল বস্তি এলাকা সরেজমিন ঘুরে ও বাসিন্দাদের সঙ্গে আলাপ করে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। তারা জানান, গত কয়েক দিনের প্রশাসনিক তৎপরতায় প্রভাবশালী দখলবাজ হোতারা ধরপাকড় এড়াতে এলাকা ছেড়ে গা-ঢাকা দিয়েছেন। এ সুযোগে বনানী থানা পুলিশের সহায়তায় বস্তির বড় একটি অংশ দখল করে নিয়েছে তাছলী-মোস্তফা-মুকুলের গ্রুপ। তারা বস্তির বেলতলা অংশ পুরোপুরি দখল করার পর এখন বিটিসিএলের ফাঁকা পড়ে থাকা জায়গাও বরাদ্দ দিতে শুরু করেছেন।

সেসব স্থানে বাঁশ, খুঁটির সাহায্যে নতুন নতুন ঘর তোলার কাজ চলছে। দখলবাজির ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি প্রতাপশালী হয়ে ওঠায় এরই মধ্যে তাছলীর নাম দেওয়া হয়েছে ‘বস্তির সম্রাজ্ঞী।’ তার নেতৃত্বে বস্তি দখল করে নেওয়ার স্টাইলটিও অভিনব। স্থানীয় সূত্রগুলো জানায়, মাদক ব্যবসায়ী তাছলীমা বেগম ওরফে তাছলীর নিয়ন্ত্রণে ২০ জনেরও বেশি নারী নিয়ে মারদাঙ্গা মহিলা গ্রুপ গড়ে তুলেছেন। বস্তির টার্গেটকৃত বাড়িঘরের পুরুষ সদস্যদের বিরুদ্ধে কল্পিত অভিযোগ তুলে এসআই মুকুল তাদের তাড়িয়ে বেড়াতে থাকেন। এ সুযোগে তাছলীর মহিলা গ্রুপ সেসব বাড়িতে হানা দিয়ে অবস্থানরত নারী সদস্যদের মারধর করে তাড়িয়ে দেন। রাতের আঁধারে দখল করে নেওয়া বাড়িঘর তাছলী পরমুহূর্তেই অন্য লোকের কাছে ভাড়া দিচ্ছেন। নতুন ভাড়াটেদের কাছ থেকে এককালীন ১০ হাজার টাকা আদায় করাসহ মাসিক দেড় হাজার টাকা ভাড়া নির্ধারণ করে দেওয়া হচ্ছে। পুলিশের সহায়তায় অভিনব এ কৌশলে মাত্র চার দিনের মধ্যেই খলিল, পারভেজ, রেশমা, সুফিয়া, হোটেল কর্মচারী জাকির, লিটন, ফুল মিয়াসহ অন্তত ১৫টি বাড়ি দখল করেছে তাছলী গ্রুপ। বাড়িঘর হারিয়ে এসব নারী-পুরুষ এখন রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ানো ছাড়া আর কোনো উপায় খুঁজে পাচ্ছেন না। ভুক্তভোগীরা অভিযোগ করে জানান, ‘দারোগা এমদাদ ও জাহাঙ্গীরসহ পুলিশ সদস্যদের উপস্থিতিতেই তাছলী গ্রুপের সদস্যরা একের পর এক ঘর দখল করে নিচ্ছে। অসহায় নারী-পুরুষ-শিশুদের ঘরছাড়া, আশ্রয়হীন করা হচ্ছে।’ গত শুক্রবার সকালে সরেজমিনে কড়াইল বস্তি এলাকায় গিয়ে বেশ কয়েকজন যুবককে বস্তির ঘরে ঘরে বিদ্যুতের চোরাই লাইন টানানোর কাজে ব্যস্ত থাকতে দেখা যায়। বস্তির বাসিন্দারা জানান, মাত্র তিন দিন আগে ডেসার কর্মীরা এসব অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করেন। পরে বাড়ি বাড়ি থেকে চাঁদা তুলে মোটা অঙ্কের ঘুষ দিয়ে আবার বিদ্যুৎ লাইন টানানোর ব্যবস্থা করা হচ্ছে। চোরাই বিদ্যুৎ লাইন টানানোর সময় বনানী থানার সাব-ইন্সপেক্টর মুকুল মিয়ার নেতৃত্বে সিভিল টিমের পুলিশ সদস্যরা সেখানে অবস্থান করছিলেন। স্থানীয়রা অভিযোগ করে জানান, আগে বেলতলাসহ আশপাশের অন্তত পাঁচ হাজার ঘরের বিদ্যুৎ লাইনের মালিক ছিল নূরুল ও কাবিল মোল্লা। প্রতি মাসে তারা বিদ্যুৎ বিলের নামেই হাতিয়ে নিত ৩০-৩৫ লাখ টাকা। ডেসার বিশেষ অভিযানের পর বিদ্যুৎ চোরও বদলে গেছে। নূরুল আর কাবিল মোল্লার সাম্রাজ্য জবর-দখল করে নিয়েছে সাবেক স্বেচ্ছাসেবকলীগ নেতা মঞ্জুরুল হক মঞ্জু। তার অনুগত যুবকরা ঘরে ঘরে নতুন বিদ্যুৎ লাইন টানাতে গেলে প্রতিপক্ষ হামলা চালাতে পারেথ এমন আশঙ্কায় পুলিশ রাখা হয়েছে বলেও বাসিন্দারা জানান।

বিদ্যুতের চোরাই লাইনের সংযোগ দিয়ে মঞ্জুরুল হক, আলমগীর, মোক্তার, কাবিল মোল্লা, রিপন, জুয়েল ও মোহাম্মদ আলীরা লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিলেও বিদ্যুতের যাবতীয় বিল চাপানো হয় বিটিসিএলের মাথায়। সরকারি সংস্থাটির জায়গার ওপর গজিয়ে ওঠা কড়াইল বস্তিবাসীর ব্যবহৃত বিদ্যুৎ বিলের পরিমাণ ধরা হয়েছে আড়াই কোটি টাকা। বকেয়া এ বিল আদায় করা নিয়ে এরই মধ্যে ডেসার সঙ্গে বিটিসিএলের মামলা-লড়াই চলছে। এদিকে ডেসার গুলশান জোনের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, কড়াইল বস্তিতে বৈধভাবে দেড় হাজার বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়া হয়েছে। সেখানে মোমিন মিয়াসহ কয়েকজন বৈধভাবেই ডেসার ঠিকাদার হিসেবে এসব বিদ্যুৎ সংযোগ প্রদানের কাজ করছেন। তবে অন্য যারা ডেসার নাম ভাঙিয়ে বিদ্যুতের বাণিজ্য ফেঁদে বসেছে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে বলেও জানান সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।

ইমামের বস্তি সাম্রাজ্যে মোয়াজ্জিনই সর্বেসর্বা : কড়াইল বস্তিতেই বেশ কয়েক বছর আগে মাথা গোঁজার ঠাঁই করে নিয়েছিলেন মাওলানা সোবাহান ও মৌলভী কাবিল মোল্লা। নিজেদের বসবাস নির্বিঘ্ন করতে চাটাইয়ের বেড়া আর কয়েকটি টিনের ছাউনি দিয়ে বানিয়েছিলেন মসজিদ। মাওলানা সোবাহান ছিলেন ওই মসজিদের ইমাম এবং মৌলভী কাবিল মোল্লা হন মোয়াজ্জিন। বার বার বস্তি উচ্ছেদের অভিযানে সোবাহান-কাবিলের গড়ে তোলা মসজিদটি ঢাল হিসেবেও ব্যবহার হতো। রাজউক, সিটি করপোরেশন ও জেলা প্রশাসনের বুলডোজার শত শত বস্তিঘর ভেঙে গুঁড়িয়ে দিলেও মসজিদ ঘর পর্যন্ত এসেই থেমে যেত। ফলে মসজিদটির পেছনেই মাওলানা সোবাহান অসংখ্য ঘর তুলে রীতিমতো আলাদা মহল্লা বানিয়ে ফেলেন, নাম দেওয়া হয় ‘মসজিদ পট্টি’। মাওলানা এখন পাঁচ শতাধিক ঘরের ‘বস্তি সাম্রাজ্যের’ একক মালিক। প্রতি মাসে ঘর ভাড়া বাবদ পাঁচ লক্ষাধিক টাকা পান তিনি।

অন্যদিকে মাওলানার সহযোগী মোয়াজ্জিন কাবিল মোল্লাও মাত্র দুই বছরের মধ্যে দাড়ি-টুপি ছেড়ে মাস্তান বনে যান। জড়িয়ে পড়েন হেরোইন ফেনসিডিলসহ নানারকম মাদক ব্যবসায়। কড়াইল বস্তি জুড়েই তার একচ্ছত্র দাপট। বস্তির প্রতিটি পট্টিতেই তার সামাজিক বিচার কেন্দ্র রয়েছে। সেখানে বস্তির বাসিন্দাদের ডেকে নিয়ে বিচার করেন, মোটা অঙ্কের জরিমানা ধার্য করেন, আবার কাউকে কাউকে বস্তি ছেড়ে চলে যাওয়ার সময়সীমা পর্যন্ত বেঁধে দেন।

স্থানীয়রা জানান, নানারকম ধান্ধাবাজির মাধ্যমে কাবিল মোল্লা এখন প্রতাপশালী কোটিপতি। তারই ঘনিষ্ঠজন মোহাম্মদ আলী, নূরুল হক ও আবদুল জলিল হচ্ছেন ইয়াবার ডিলার। তাদের নেতৃত্বে কড়াইল বস্তি থেকেই সমগ্র গুলশান, বনানী, বাড্ডা, ভাটারাসহ আশপাশের বিভিন্ন থানা এলাকায় ইয়াবার সরবরাহ যায় বলেও অভিযোগ রয়েছে। তবে কাবিল মোল্লা তার বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, ‘মিটারের মাধ্যমে বিদ্যুৎ ও গ্যাস সংযোগ এনে বস্তিতে সরবরাহ দিয়ে আসছি। এক্ষেত্রে দুই নম্বরী কোনো কাজে জড়িত থাকার প্রশ্নই ওঠে না।’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘মানুষজন মান্য-গণ্য করে- বিচার-আচারে ডাকে, না গিয়ে উপায় কি?’ কিন্তু ডেসা ও তিতাস গ্যাসের গুলশান কার্যালয়ে খোঁজ নিয়ে কাবিল মোল্লার নামে কোনো বৈধ সংযোগ নেওয়ার সত্যতা পাওয়া যায়নি।