স্টাফ রিপোর্টার ॥ নাগরিক জীবনে ব্যস্থতার মাঝে প্রত্যেকেই চায় একটু প্রশান্তির জন্য পারিবারিক ভ্রমন। আর সে ভ্রমন যদি হয় পুরো পরিবার সহ তাহলে তো কথাই নেই। এমন এক পর্যটন কেন্দ্র হল নানা বাড়ী ট্যুরিজম। এ পর্যটন কেন্দ্র এমন এক স্থানে অবস্থি যার বর্ণনা এক কথায় না বলা সম্ভব নয় তার পরও দু’এক কথা না বলেই নয়। প্রকৃতির কোলে বেড়ে উঠা এ জনপদের মানুষের কণ্ঠে তাই খেলা করে প্রকৃতিরই সুর। সব মিলিয়ে হাজার বছরের সংস্কৃতি আর ঐতিহ্যে লালিত এ জনপদ তাই সারা দেশের কাছে পরিচিত পর্যটন নগরী হচ্ছে হবিগঞ্জ জেলা। প্রকৃতির উদারতা নানাবাড়ীকে করেছে পর্যটন সমৃদ্ধ। পর্যটন শিল্পের অপার সম্ভাবনা সত্ত্বেও সরকারি ও বেসরকারি পৃষ্ঠ পোষকতার অভাবে এ সম্ভাবনারময় হবিগঞ্জে গড়ে উঠেনি ভাল কোন পর্যটন কেন্দ্র। এই অঞ্চলের পর্যটন শিল্পের বিকাশে সাহসিকাতার সাথে কাজ করে যাচ্ছেন নানা বাড়ী ট্যুরিজমের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক দেওয়ান মতিন বলে মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশন এর প্লানিং ম্যানেজার মো. খালিদ-বিন-মজিদ।
সমতল ভূমির এক প্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে সুউচ্চ পাহাড়। পাহাড়ের গায়ে খেলা করছে সাদা মেঘ। বৃষ্টি হলে পাহাড় বেয়ে নেমে আসা ঝর্ণাধারার জলে চিকচিক করে সূর্য। অনতিদূরে হাওর। হাওরের বুকে নানা জাতের পাখির আনা গোনা আর ডুবো খেলা। পাহাড়-সমতল-জলাভূমির এমন অপূর্ব সৌন্দর্যের দেখা মেলে নানা বাড়ীর চার পাশে।
প্রকৃতির রম্য নিকেতন বৃহত্তর সিলেটের প্রবেশদ্বার হবিগঞ্জ জেলা। সিলেট বিভাগের নৈস্বর্গিক সৌন্দর্যের অনেকটা অংশ জুড়েই রয়েছে হবিগঞ্জ। প্রকৃতি অকৃপণভাবে সাজিয়েছে এই জেলাটিকে। খোয়াই, করাঙ্গী, সুতাং, সুনাই, রতœা, ভেড়ামোহনা, কুশিয়ারা, বিবিয়ানা নদী বিধৌত এই জনপদ। এর একদিকে বিস্তীর্ণ হাওর, অপরদিকে বনজ ও প্রাকৃতিক সম্পদে পরিপূর্ণ পাহাড়ি এলাকা। পাহাড়, হাওর, নদী, চা ও রাবার বাগান, বনজসম্পদ, গ্যাসসহ অফুরন্ত প্রাকৃতিক সম্পদ, প্রতœতাত্ত্বিক নিদর্শন সমৃদ্ধ হবিগঞ্জে খাসিয়া, টিপরা উপজাতি এবং মনিপুরী সম্প্রদায়ের বসবাস। প্রায় আড়াইহাজার বর্গকিলোমিটার বিশিষ্ট হবিগঞ্জের উত্তরে সুনামগঞ্জ ও সিলেট, পূর্বে মৌলভীবাজার, দক্ষিণে ব্রাহ্মণবাড়ীয়া ও ভারতের পার্বত্য ত্রিপুরা, পশ্চিমে ব্রাহ্মণবাড়ীয়া ও কিশোরগঞ্জ জেলা অবস্থিত।
কিভাবে যাবেন:
রাজধানী ঢাকা থেকে হবিগঞ্জের দূরত্ব সড়ক পথে ১৩০ কিলোমিটার এবং রেল পথে ১৫০ কিলোমিটার। সায়েদাবাদ বাসস্ট্যান্ডে গিয়ে হবিগঞ্জের কাউন্টারে টিকিট কেটে দিগন্ত, অগ্রদূত, বিসমিল্লাহ বাসযোগে ৩ থেকে সাড়ে ৩ ঘন্টায় নানা বাড়ীতে আসা যাবে। বাস ভাড়া নন এসি জনপ্রতি ২০০ টাকা এবং এসি ২৫০ টাকা। কমলাপুর রেলস্টেশন থেকে আন্তঃনগর ট্রেন পারাবত, জয়ন্তিকা, কালনী ও উপবনযোগেও ৪ ঘন্টায় নাওয়া পাড়া স্টশনে আসা যায়। ভাড়া শোভন শ্রেণী ১৯৫ টাকা, এসি চেয়ার ৪৪৯ টাকা। নাওয়া পাড়া স্টেশনে নেমে সিএনজি অটোরিক্সা বা যে কোন যানবাহনে তেলিয়া পাড়া নানা বাড়ী যাওয়া যায়।নানা বাড়ীতে আসতে চাইলে প্রয়জনে মোবাইলে যোগাযোগ করতে পারেন:০১৭১১৬৬২৩৯০।
কোথায় কোথায় বেড়াবেন, মুক্তিযোদ্ধা চত্বর থেকে পুরাতন ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক দিয়ে তেলিয়াপাড়া চা বাগানে ম্যানেজারে বাংলোর পাশে নির্মিত বুলেট আকৃতির ব্যতিক্রমধর্মী মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিসৌধ পরিদর্শনের মধ্যে দিয়ে শুরু করতে পারেন আপনার ভ্রমন। স্বাধীনতা যুদ্ধের পর এই স্মৃতিসৌধটি নির্মাণ করা হয়। ১৯৭১ সালে এ অঞ্চলের তেলিয়াপাড়া ম্যানেজার বাংলো ছিল মুক্তিযুদ্ধের বীর নায়কদের পদচারণায় মুখরিত। স্মৃতিসৌধের পাশেই মনোরম লেক। স্মৃতিসৌধ দেখা শেষে পুরাতন মহাসড়ক ধরে আরো কিছু দূর এগিয়ে গেলে রঘুনন্দন পাহাড়ের অবস্থিত সাতছড়ি ফরেস্ট রেঞ্জ অফিস। এখানে রয়েছে সাতছড়ি জাতীয় উদ্যান। ২০০৫ সালে ২৪৩ হেক্টর ভূমির উপর প্রতিষ্ঠিত এই জাতীয় উদ্যানে রয়েছে ১৯৭ প্রজাতির জীব। আছে ১৪৯ প্রজাতির পাখি, ২৪ প্রজাতির স্তন্যপায়ী জীব, ১৮ প্রজাতির সরীসৃপ ও ৬ প্রজাতির উভচর জীব। জাতীয় উদ্যান ঘিরে আছে ৯টি চা বাগান, পাশেই রয়েছে পাম ওয়েল গাছের বাগান। বন বিভাগের ব্যবস্থাপনায় স্থাপিত আগরগাছ, বাঁশ ও বেত চাষ প্রকল্প। এছাড়াও আছে সেগুন, কড়ই, আকাশি, মেহগনিসহ বিভিন্ন প্রজাতির গাছের সবুজ অরণ্য। সাতছড়ি এলাকায় ২৫টি টিপড়া পরিবারের বসবাস। তারা জুম চাষ করেন এবং বন বিভাগের শ্রমিক হিসাবে কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করেন। মহাসড়কের পশ্চিম পাশে বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে ইদানিং তৈরি হচ্ছে দেশের বড় বড় শিল্প কারখানার অঙ্গ প্রতিষ্ঠান।
এছাড়াও যেতে পারেন বাহুবল উপজেলার ফয়েজাবাদ পাহাড়ে। পুরাতন ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের আলিয়াছড়া খাসিয়া পুঞ্জি এলাকায় রয়েছে ১২৫টি খাসিয়া পরিবারের বসবাস। নিকটবর্তী মুছাই ও বৈরাগী খাসিয়া পুঞ্জিতে রয়েছে কয়েকটি খাসিয়া পরিবার। এই উপজাতির লোকেরা খাসিয়া পান, আনারস, লেবু, গোলমরিচ চাষ করে বর্তমানে আর্থিকভাবে অনেকটা সচ্ছল। এই উপজাতিদের পুঞ্জিতে গিয়ে দেখতে পারেন খাসিয়াদের বৈচিত্র্যপূর্ণ জীবনযাত্রার চিত্র। আলিয়াছড়া খাসিয়া পুঞ্জি বাজারে প্রায় সারা বছরই আনারস ও লেবু পাইকারি দরে বিক্রি হয়।
এই এলাকায় প্রচুর কাঁঠালও হয় যা স্বাদে ও মানের দিক থেকে অতুলনীয়। এখানে রয়েছে রশিদপুর গ্যাস ফিল্ড, রাবার ও চা বাগান। আলিয়াছড়া থেকে চুনারুঘাটের দিকে এগিয়ে গেলে পথে পড়বে মুরারবন্দ মাজার শরীফ। এখানে হযরত শাহজালাল (রঃ) সফর সঙ্গীদের অন্যতম হযরত সৈয়দ নাসির উদ্দিন সিপাহ্সালার (রঃ) এবং হযরত কুতুবুল আউলিয়াসহ অনেক পীর আউলিয়ার মাজার। চুনারুঘাট উপজেলার গাজীপুর ও আহম্মদাবাদ ইউনিয়নের কয়েকটি গ্রামে রয়েছে ঐতিহ্যবাহী মনিপুরি জনগোষ্ঠির বসবাস। এখানকার কালেঙ্গা পাহাড়ে রয়েছে কয়েকটি টিপড়া পরিবার। রোমায় রয়েছে বন্যপ্রাণী ও জীবজন্তু সংরক্ষণ প্রকল্পের আওতায় স্থাপিত অভয়ারণ্য। যেতে পারেন গড়ের খাল বেষ্টিত বানিয়াচং গ্রামে। সেখানে রয়েছে রাজা গড়গোবিন্দের বংশধরদের প্রসাদের ধ্বংসাবশেষ, সুলতানি আমলে নির্মিত বিবির মোকাম ও পুরানবাগ মসজিদ। এছাড়াও গ্রামের মধ্যস্থলে রয়েছে রানী কমলাবতির দীঘি যা সাগর দীঘি নামেও পরিচিত। বানিয়াচং উপজেলা সদরের দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে প্রায় ১০ মাইল দূরে রয়েছে ১২০ কক্ষ বিশিষ্ট প্রাচীন বিথঙ্গল আখড়া। বর্ষাকালেই সেখানে যেতে সুবিধা। শহরের পার্শ্ববর্তী কালারডোবা নৌকাঘাট থেকে ইঞ্জিন নৌকা ভাড়া করে ১ ঘন্টায় বিথঙ্গল পৌঁছা যায়।
নাগুড়া থেকে ১৫ মাইল উত্তরে অবস্থিত নবীগঞ্জ উপজেলা সদরটি ‘লন্ডনী উপজেলা’ হিসাবে খ্যাত। এখানকার জনসংখ্যার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ ইংল্যান্ডে বসবাস করছেন। এ উপজেলার বিভিন্ন স্থানে সুরম্য ও বিলাসবহুল বাসভবনগুলো সহজেই দর্শনার্থীদের মনোযোগ আকর্ষণ করে।