শনিবার , ২১শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ , ৬ই আশ্বিন, ১৪৩১ , ১৭ই রবিউল আউয়াল, ১৪৪৬

হোম > আন্তর্জাতিক > পশ্চিমবঙ্গে দাঙ্গার নেপথ্যে জামায়াতে ইসললামীকে দায়ী করলেন মমতা

পশ্চিমবঙ্গে দাঙ্গার নেপথ্যে জামায়াতে ইসললামীকে দায়ী করলেন মমতা

শেয়ার করুন

আন্তর্জাতিক ডেস্ক ॥
ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের বশিরহাট এলাকায় বাংলাদেশের জামায়াতে ইসলামীর নেতাকর্মীরা সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাধানোর চেষ্টা করেছে বলে অভিযোগ করেছেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বাংলাদেশে সন্ত্রাসী কর্মকা-ের জন্য ব্যাপক সমালোচিত জামায়াতের নামে এবার পার্শ্ববর্তী দেশ থেকেও অভিযোগ এলো। যদিও ভারতের রাজনীতিতে জামায়াতের সঙ্গে মমতার সখ্যতা নিয়ে জোর গুঞ্জন রয়েছে।

এখনো পর্যন্ত বিষয়টি নিয়ে মুখ খোলেননি বাংলাদেশ সরকারের নীতিনির্ধারকরা। অবশ্য জামায়াতের পক্ষ থেকে মমতার অভিযোগ অস্বীকার করা হয়েছে।

জামায়াতের বিরুদ্ধে তোলা অভিযোগে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, বাংলাদেশের সাতক্ষীরা সীমান্ত দিয়ে জঙ্গিরা বশিরহাটে প্রবেশ করে সেখানে দাঙ্গা বাধানোর চেষ্টা করেছে। গত সোমবার দেশটির বিধানসভায় রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে ভোট দেওয়ার পর সাংবাদিকদের কাছে এ অভিযোগ করেন তিনি। মমতা বলেন, ‘সাতক্ষীরা দিয়ে কারা জামায়াতকে প্রবেশ করতে দিচ্ছে? কারা তাদের জন্য সীমান্ত খুলে দিচ্ছে? তারা (জামায়াতে ইসলাম) হাসিনার (প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা) বিরোধী এবং তারা পশ্চিমবঙ্গে দাঙ্গা সৃষ্টি করতে চেয়েছিল। কিন্তু এ রাজ্যের ভালো মানুষরা এই অপচেষ্টা রুখে দিয়েছিল। সাতক্ষীরা দিয়ে এসে সামাজিক মাধ্যমে ভুয়া ভিডিও ছড়িয়ে তারা দাঙ্গা ছড়িয়ে দিতে চেয়েছিল।’

গত কয়েকদিন ধরেই মমতা অভিযোগ করে আসছিলেন, বাদুড়িয়া-বশিরহাটের দাঙ্গায় বাইরের লোকের হাত রয়েছে। রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে ভোট দিয়ে বেরিয়ে আসার পর সাংবাদিকদের তিনি সরাসরিই জানান, ওই দাঙ্গায় বাংলাদেশের জামায়াতের হাত রয়েছে। তার সরকারের কাছে এই অভিযোগের সমর্থনে তথ্যপ্রমাণও রয়েছে বলে দাবি মমতার।

ভারতীয় গণমাধ্যমের খবরেও বলা হয়েছে, জামায়াতের ভূমিকা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশই নয়, সরকারের হাতে নথি রয়েছে বলেও দাবি করেছেন মমতা। মমতা জানান, পশ্চিমবঙ্গের গোয়েন্দা দপ্তর তেমনই রিপোর্ট দিয়েছে। সীমান্তবর্তী এলাকায় গোষ্ঠী সংঘর্ষ বাধাতে জামায়াতের লোকজনকে ব্যবহার করা হয়েছে বলে খবর পান গোয়েন্দারা। তবে সরকারিভাবে অভিযোগের বিষয়টি স্বীকার করা হয়নি।

চলতি মাসের শুরুর দিকে পশ্চিমবঙ্গের বশিরহাট থেকে ২০ কিলোমিটার দূরে বাদুরিয়ায় এক কিশোরের ফেসবুক পোস্ট নিয়ে স্থানীয় মুসলিমরা ক্ষুব্ধ হওয়ার মধ্য দিয়ে দাঙ্গার সূত্রপাত। এ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা উত্তর চব্বিশ পরগনার অন্যান্য এলাকায়ও ছড়িয়ে পড়ে।

দেশটির ক্ষমতাসীন দল বিজেপির বিরুদ্ধে অভিযোগের তীর ছুড়ে তৃণমূল কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মমতা দাবি করেন, বিজেপি রাজ্যে অশান্তি তৈরির চেষ্টা করছে। কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর গাফিলতিতেই বাংলাদেশের সাতক্ষীরা দিয়ে এ রাজ্যে জঙ্গিদের অনুপ্রবেশ ঘটছে।

তবে মমতার অভিযোগের জবাবে পশ্চিমবঙ্গ বিজেপির সভাপতি দিলীপ ঘোষ বলেছেন, ‘মুখ্যমন্ত্রী মমতা সব জানেন। এতদিন তিনি মুখ খোলেননি। এখন বুঝে গেছেন বিজেপি সব ফাঁস করে দেবে। রাজ্যের মানুষও বুঝে গিয়েছে কোথায় কারা গোলমাল পাকাচ্ছে। সত্যকে যে বেশি দিন চেপে রাখা যায় না সেটিই বুঝিয়ে দিলেন মাননীয়া।’ তিনি আরও বলেন, ‘এই ঘটনায় ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসফকে দোষ না দিয়ে পশ্চিমবঙ্গের বশিরহাটের পুলিশ কী করছিল সেই জবাব দিন মুখ্যমন্ত্রী।’

ভারতের রাজনৈতিক মহল থেকে অভিযোগ করা হয়, মমতার সঙ্গে বাংলাদেশের জামায়াতের গোপন সম্পর্ক আছে। ভারতের বর্ধমানকা-ের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জামায়াতের যোগাযোগের ঘটনা মমতা শুধু অস্বীকারই করেননি, তিনি সে সময় বলেছিলেন, এটা ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’-এর কাজ। ভারত সরকারের একাধিক সূত্র জানিয়েছে, মমতা নিজেও জানেন তিনি বাংলাদেশের কত সন্ত্রাসবাদীদের মদদ দিয়েছেন। জানেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিও। বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার স্থলসীমান্ত চুক্তির বিলটি ভারতের সংসদে পাস হয়ে গেছে। যদিও মোদি সরকার যখন প্রথমবার বিলটি পেশ করে তখন মমতার দলের সাতজন সাংসদে এর বিরোধিতা করেছিলেন। তাদের মধ্যে একজন এখন সারদাকা-ে জেলে আছেন। দলের আরেক বিধায়ক ও রাজ্যের মন্ত্রীও বর্তমানে জেলে আছেন।

২০১৪ সালের ২ অক্টোবর দুর্গাপুজোর অষ্টমীর দিন বর্ধমান শহরের অদূরে খাগড়াগড়ের একটি বাড়িতে ইম্প্রোভাইজড এক্সপ্লোসিভ ডিভাইস (আইইডি) বিস্ফোরণে দুজন নিহত হন। তাদের নাম শাকিল আহমেদ এবং শেখ সুবহান। আব্দুল হাকিম নামে একজনকে গুরুতর আহত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়। ওই ঘটনায় বাংলাদেশের জামায়াতে ইসলামীর হাত ছিল বলে তখন দাবি তোলে বিজেপি। মমতার সহায়তায় জামায়াত পশ্চিমবঙ্গে তৎপরতা চালাচ্ছে বলেও অভিযোগ তোলা হয় তখন। এখন সেই ঘটনার তদন্ত করছে এনআইএ।

বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রিসভার অন্তত চারজন জ্যেষ্ঠ মন্ত্রীর সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে কথা হলে তারা কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি, প্রসঙ্গটি এড়িয়ে গেছেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, ঘটনা কী ঘটেছে তা আপনারাও জানেন। এ বিষয়ে আমার কোনো মন্তব্য নেই।

সাতক্ষীরার সরকারদলীয় সংসদ সদস্য এসএম জগলুল হায়দার মমতার অভিযোগটি উড়িয়ে দিয়ে বলেন, বর্ডার গার্ড অব বাংলাদেশের (বিজিবি) চোখ ফাঁকি দিয়ে এখান থেকে ভারত যাওয়া খুব কঠিন। নিজের নির্বাচনী এলাকা সম্পর্কে বলেন, আমার এলাকায় স্থল সীমান্ত নেই। সীমান্ত মূলত কালিন্দী নদী। নদীর ওপারে ভারত এপারে বাংলাদেশ।
সাতক্ষীরা-১ আসনের সংসদ সদস্য মুস্তফা লুৎফুল্লাহ আমাদের সময়ের সঙ্গে আলাপকালে গতকাল বলেন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জামায়াতের ক্যাডারদের নিজ রাজ্যে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়ে এসেছেন এতদিন। এখন তারা দানব হয়ে যাচ্ছে, তাই তিনি বাধ্য হয়ে কৌশলগত অবস্থান বদলাচ্ছেন।

জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) থেকে নির্বাচিত এই এমপি বলেন, ২০১৪ সালের নির্বাচন বানচালের নামে এর আগের দুবছর জামায়াত তা-ব চালিয়েছিল সাতক্ষীরায়। তখন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অভিযান চালিয়ে তাদের ধরতে পারেনি। অভিযানের সময় তারা সীমান্ত পাড়ি দিয়ে পশ্চিমবঙ্গে চলে যায়। চব্বিশ পরগনা জেলা পরিষদের এক সদস্যের এলাকায় রীতিমতো ক্যাম্প করে অবস্থান নেয় জামায়াতের নেতাকর্মীরা। শুধু তাই নয়, ২০১৪ সালে নির্বাচনের পর জামায়াতের ওই নেতাকর্মীরা ভারতেই বসবাস করতে থাকে। এমনকি মমতার নির্বাচনেও তারা ক্যাডার হিসেবে কাজ করেছে, ওই এলাকার মুসলমানদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভোট চেয়েছে।

এদিকে গতকাল জামায়াতের সাতক্ষীরা জেলার সহকারী সেক্রেটারি আজিজুর রহমানকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। তবে ঠিক কী অভিযোগে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, সে সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তাকে গ্রেপ্তারের ঘটনায় নিন্দা জানিয়েছেন জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল হামিদুর রহমান আযাদ।
অন্যদিকে ভারতের দাঙ্গার ঘটনার সঙ্গে জামায়াতের কোনো ধরনের সশ্লিষ্টতা নেই বলে জানিয়েছেন দলটির বেশ কয়েকজন নেতা। দলটির ঢাকা মহানগরীর উত্তরের রুকন সাইফুল ইসলাম বলেন, জামায়াতের বিরুদ্ধে মিথ্যা প্রোপাগান্ডার অংশ হিসেবেই এমন ভিত্তিহীন অভিযোগ তোলা হয়েছে। মূলত এটা বাংলাদেশ সরকারের ষড়যন্ত্রের সফল মঞ্চায়ন। জামায়াতের নেতাকর্মীরা ভিন্ন ধর্মকে অবহেলায় বিশ্বাস করেন না। সব ধর্মের স্বাধীনতায় বিশ্বাসী।

এদিকে এসব বিষয়ে জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল ডা. শফিকুর রহমান এক বিবৃতিতে বলেন, প্রতিবেশী দেশ ভারতসহ বিশ্বের কোথাও বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর কোনো ধরনের কোনো শাখা নেই। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বশিরহাটের দাঙ্গায় বাংলাদেশের জামায়াতের হাত রয়েছে বলে যে অভিযোগ করা হয়েছে তা ভিত্তিহীন, অসত্য। তিনি বলেন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যে অভিযোগ করেছেন, তা আমরা বিশ্বাস করতে চাই না। যদি তিনি এ ধরনের কোনো অভিযোগ করেই থাকেন, তা হলে তা একেবারেই অসত্য। প্রতিবেশী দেশ ভারতে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর কোনো ধরনের কোনো শাখা বা তৎপরতা থাকার প্রশ্নই আসে না। বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর কোনো ধরনের কোনো শাখা ভারত তো নয়ই, বিশ্বের কোথাও নেই।

বাশিরহাটের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় যে বা যারাই জড়িত থাকুক না কেন তাদের বিরুদ্ধে ভারতের আইন অনুযায়ী যে কোনো ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণের অধিকার সে দেশের সরকারের রয়েছে। আমরা সব দেশের স্বাধীন সত্ত্বা ও অখ-তার প্রতি শ্রদ্ধাশীল।

সূত্র : আমাদেরসময়