শনিবার , ২১শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ , ৬ই আশ্বিন, ১৪৩১ , ১৭ই রবিউল আউয়াল, ১৪৪৬

হোম > গ্যালারীর খবর > নেতাদের রাজত্বে পশুর অবৈধ হাট, দাপটের কাছে ঠিকে কে?

নেতাদের রাজত্বে পশুর অবৈধ হাট, দাপটের কাছে ঠিকে কে?

শেয়ার করুন

বাংলাভূমি২৪ ডেস্ক ॥

সিলেটে কাজিরবাজারে যাওয়ার পথে পশুভর্তি ট্রাক থামিয়ে জোর করে অবৈধ হাটে নামানো হচ্ছে গরু

সিলেট: সিলেটে একটি মাত্র বৈধ পশুর হাট থাকলেও গত কয়েক দিনে পুরো নগরীই যেন হয়ে গেছে পশুর হাট। নগরীর আনাছে-কানাছে হাট বসানো হয়েছে। আর ওইসব হাটের নেপথ্যে আছেন আওয়ামী লীগ, বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা।

অভিযোগ ওঠেছে, দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে নিয়ে আসা ব্যবসায়ীদের গরুর ট্রাক আটকে জোর করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে ওইসব অবৈধ হাটে। অন্যান্য বছর নগরীতে বসা অবৈধ পশুর হাটের বিরুদ্ধে অ্যাকশন নেয়া হলেও এবার সিটি করপোরেশন ও পুলিশ প্রশাসন নিরব ভূমিকা পালন করছে।

মঙ্গলবার দুপুর থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত নগরী ঘুরে দেখা গেছে, মেজরটিলা, মেডিকেল রোড, টিলাগড়, রিকাবীবাজার, উপশহর, আখালিয়া, সুবিদবাজার, দর্শনদেউড়ি ও ঝালোপাড়াসহ বিভিন্ন স্থানে অবৈধ হাট বসানো হয়েছে। প্রত্যেকটি পশুর হাটেরই মালিকপক্ষ হচ্ছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা। ফলে ব্যবসায়ীরা বৈধ হাটে যেতে বাধাগ্রস্ত হচ্ছেন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে- এসব অবৈধ হাটের মধ্যে সবচেয়ে বড় হাটটি হচ্ছে সিলেট সদর উপজেলা পরিষদের মালিকানাধীন শাহী ঈদগাহ খেলার মাঠ। মাঠ উন্নয়ন কমিটির নামে স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও বিএনপি নেতারা হাটটি নিয়ন্ত্রণ করছেন।

শাহী ঈদগাহ খেলার মাঠের অবৈধ হাটের নিয়ন্ত্রণে আছেন ৫নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আমিনুল ইসলাম পাপ্পু, জেলা আওয়ামী লীগ নেতা মোশাহিদ আলীর ছোট ভাই শামীম আহমদ, সাবেক জেলা ছাত্রদল নেতা সাঈদুর রহমান হিরু এবং সিলেট চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ ও বিভিন্ন ব্যবসায়ীর টাকা আত্মসাতে অভিযুক্ত বিতর্কিত মেলা আয়োজক এমএ মঈন খান বাবলু।

টিলাগড় পয়েন্ট সংলগ্ন ফুটসাল মাঠে বসানো পশুর হাট নিয়ন্ত্রণ করছেন সিলেট মহানগর যুবলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক মুশফিক জায়গীরদার। তার নেতৃত্বে হাট নিয়ন্ত্রণে আছেন যুবলীগ ও ছাত্রলীগের টিলাগড় গ্রুপের অন্তত এক ডজন নেতা।

তবে হাটের ব্যবস্থাপনায় নিজের সংশ্লিষ্টতা নেই দাবি করে মুশফিক জায়গীরদার বলেন, ‘স্থানীয় লোকজন হাটটি বসিয়েছেন। এতে কিছু টাকা বিনিয়োগ করেছি।’

বালুচর আনন্দ সংসদ খেলার মাঠে ‘আনন্দ বাজার’ নাম দিয়ে বসানো হয়েছে কোরবানির পশুর অবৈধ হাট। এ হাটের নিয়ন্ত্রণে আছেন স্বেচ্ছাসেবক দল নেতা আবদুল গফ্ফার ও যুবলীগ নেতা মুশফিক।

ছড়ারপার কয়েদির হাওর মাঠে বসানো হয়েছে আরেকটি অবৈধ হাট। এ হাটের নেপথ্যে আছেন জনৈক আনোয়ারুজ্জামান ও যুবলীগ নেতা আবদুল মতিন।

কয়েদির হাওর মাঠের পাশেই আবুল মাল আবদুল মুহিত ক্রীড়া কমপ্লেক্স। এ কমপ্লেক্স, পার্শ্ববর্তী আইন মহাবিদ্যালয় ও শাহজালাল সিটি কলেজের সামনের রাস্তা দখল করে বসানো হয়েছে আরেকটি হাট। এ হাট নিয়ন্ত্রণ করছেন যুবলীগ নেতা মুশফিক, মুন্না, মহানগর শ্রমিকলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক শামীম ইকবাল, ১৯নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জাবেদ সিরাজ ও ট্রাক মালিক সমিতির সভাপতি আবুল কাহের ইজু।

ক্রীড়া কমপ্লেক্সের পেছনে কয়েদির মাঠে বসানো হয়েছে আরেকটি হাট। ওই হাটের ব্যবস্থাপনায় আছেন আওয়ামী লীগ ও বিএনপির স্থানীয় কয়েকজন নেতা। নগরীর বালুচরে আনন্দ সংসদের খেলার মাঠে বসানো অবৈধ হাটের ব্যবস্থাপনায় আছেন স্বেচ্ছাসেবক দল নেতা আবদুল গফ্ফার।

এদিকে, মঙ্গলবার রাতে সিলেটের বৈধ পশুর হাট কাজিরবাজারে গিয়ে দেখা গেছে, দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে বিক্রেতারা গরু নিয়ে ওই পশুরহাটে এসেছেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের তত্ত্বাবধানে বাজারে বসানো হয়েছে জালনোট শনাক্তকরণ বুথ। জেলা প্রাণী সম্পদ দপ্তরের তত্ত্বাবধানে কাজ করছেন চিকিৎসকরাও।

ক্রেতা-বিক্রেতাদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, কাজিরবাজার পশুর হাটে অন্যবারের মতো এবারও কোরবানির পশু ওঠেছে। তাই বাজারের অবস্থা ভালো। এছাড়াও ওইসব পশুর দাম সবার কেনার সাধ্যের নাগালে রয়েছে।

জৈন্তাপুর উপজেলার বাসিন্দা আব্দুর জব্বার নামের এক গরু বিক্রেতা জানান, গত বছর কোরবানির পর তিনি ৩৫ হাজার টাকা দিয়ে দুটি গরু ক্রয় করেছিলেন। সেই গরু দুটি নিয়েই এবার কাজিরবাজারে এসেছেন। কিন্তু তার গরু দুটির দাম হচ্ছে মাত্র ৬০ হাজার টাকা। তাই তিনি বিক্রি করছেন না। ৮০ হাজার টাকা পেলে বিক্রি করে দেবেন বলে জানান ওই বিক্রেতা।

শুধু জৈন্তাপুরের গরু বিক্রেতাই সিলেটে আসেননি। সিলেটের হাটগুলোতে পশু নিয়ে এসেছেন দেশের বিভিন্ন স্থানের পশু বিক্রেতারা। তাদের মধ্যে নাটোর, রাজশাহী, নেত্রকোনা, রংপুর, ভৈরব, কুড়িগ্রামের পশু বিক্রেতারা এসেছেন সিলেটে। তারা ট্রাকযোগে ছোট-বড়-মাঝারি সব ধরনের গবাদি পশু নিয়ে সিলেটে এসেছেন। এর মধ্যে মাঝারি ও ছোট গরুর চাহিদাই বেশি বলে জানিয়েছেন বিক্রেতারা।

কুড়িগ্রাম থেকে আসা গরু বিক্রেতা সাহাব উদ্দিন বাংলামেইলকে জানান, তিনি ২০টি গরু দিয়ে সিলেটে এসেছেন। প্রতি বছরই গরু নিয়ে তিনি সিলেটে আসেন, এবারও এসেছেন। অন্যবারের মতো এবারও গরুগুলো ভালো দামে বিক্রি করতে পারবেন বলে আশাপ্রকাশ করেছেন।

তবে, সাহাব উদ্দিন অভিযোগ করে বলেন, ‘নগরীতে প্রবেশ করতে কয়েকবার লাঠিয়ালবাহিনীর হাতে ধরা পড়তে হয়েছে। আর ওই বাহিনীর কাছ থেকে মুক্তি পেতে তাকে গুনতে হয়েছে বাড়তি টাকা।

শুধু সাহাব উদ্দিনই নয়, রাজশাহী থেকে এসেছেন মো. লুৎফুর রহমান নামের এক গরু বিক্রেতা। তিনি জানান, এবার তিনি ৯৪টি গরু নিয়ে সিলেটে এসেছেন। কিন্তু গরু নিয়ে আসতে পথে পথে ভোগান্তির শিকার হয়েছেন বলে অভিযোগ করেন।

তিনি বাংলামেইলকে জানান, ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের অনেক স্থানে গরু বহনকারী ট্রাকগুলো আটকানো হয়েছে। প্রতিস্থানেই তিনি চাঁদা দিয়ে আসতে হয়েছে। সেকারণে তিনি কম দামে গরু বিক্রি করতে পারবেন না।

কাজিরবাজার গরুর বৈধ হাটের জেনারেল ম্যানেজার শাহাদাত হোসেন দোলন অভিযোগ করে বলেন, ‘অবৈধ গরুর হাট বন্ধের ব্যাপারে পুলিশ কোনও ব্যবস্থা নিচ্ছে না। তবে তিনি অনেকটা আশাপ্রকাশ করে বলেন, অন্যান্য বছরের মতো এবারও কাজিরবাজারে ভালো মানের গরু উঠেছে। আর ক্রেতাও আসছে প্রতিদিন। ঈদ যত ঘনিয়ে আসছে ততই ক্রেতার সমাগম বাড়ছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, যানজট নিরসনে দিনে পশুবাহী ট্রাক নগরীতে প্রবেশ করতে দিচ্ছে না পুলিশ। রাত ৮টার পর পশুবাহী ট্রাক নগরীতে প্রবেশ করার প্রাক্কালে বিভিন্ন অবৈধ হাটের ইজারাদাররা জোরপূর্বক ট্রাক আটকিয়ে নিজেদের অবৈধ হাটে পশু নিয়ে যাচ্ছেন। এতে করে বৈধ ইজারাদাররা ব্যবসায়িকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।

এ ব্যাপারে সিলেট মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার মো. রহমত উল্লাহ বাংলামেইলকে বলেন, ‘পুলিশের পক্ষ থেকে পশুর হাটের কোনো অনুমোদন দেয়া হয় না। তাই উচ্ছেদের দায়িত্ব পুলিশের নয়। তবে কেউ রাস্তাঘাটে হাট বসালে পুলিশ ব্যবস্থা নেবে। অবৈধ হাট উচ্ছেদের দায়িত্ব সিটি করপোরেশনের।’

সিলেট সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এনামুল হাবীব বাংলামেইলকে বলেন, ‘সিটি করপোরেশন কোরবানির পশুর হাটের কোনো অনুমতি দেয়নি। অবৈধ হাট নাগরিক দুর্ভোগ সৃষ্টি করলে পুলিশ ও জেলা প্রশাসনকে সঙ্গে নিয়ে ব্যবস্থা নেয়া হবে।’ বাংলামেইল২৪ডটকম