বাংলাভূমি২৪ ডেস্ক ॥ নিজ ঘরেই সংকটে আওয়ামী লীগ। রাজপথ থেকে সরে এসে দিবসবৃত্তে বন্দী হয়ে পড়েছে দলের সাংগঠনিক কার্যক্রম। সংগঠনের প্রতি কেন্দ্রীয় নেতাদের অমনোযোগিতায় সারাদেশেই চলছে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব। পরিস্থিতি এতটাই নাজুক যে, খুন আতঙ্ক ঘিরে ধরেছে আওয়ামী লীগকে। অভ্যন্তরীণ কোন্দলে একের পর এক হত্যাকান্ড ঘটেই চলেছে। রাজপথ থেকে শুরু করে মাঠঘাট সবুজ প্রান্তর সর্বত্রই নিজেদের রক্তে রঞ্জিত হচ্ছে আওয়ামী লীগ। কী নেতা, কী তৃণমূল কর্মী- রক্ত ঝরছে সবারই। প্রতিপক্ষের কারও আঘাতে নয়, নিজেদের গুলি, নিজেদের রামদার কোপেই বেশির ভাগ নেতা-কর্মী ধরাশায়ী হচ্ছেন।
চলতি মেয়াদে দ্বিতীয় দফায় ক্ষমতা গ্রহণের মাত্র ছয় মাসেই সারা দেশে শতাধিক আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মী হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছেন। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে নিজেদের দ্বন্দ্ব-সংঘাতেই জীবন হারিয়েছেন তারা। নারায়ণগঞ্জে সাত খুন, ফেনীতে উপজেলা চেয়ারম্যান একরামুল হত্যাকান্ড এবং মিরপুরের কালশীতে ঘুমন্ত ১০ জনকে আগুনে পুড়িয়ে মারার ঘটনা দেশে-বিদেশে সরকার ও আওয়ামী লীগকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলেছে। সর্বশেষ ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি ও আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা এনামুল হক শামীম গুলিবিদ্ধ হয়েছেন দলের কিছু সন্ত্রাসীর মাধ্যমে। এসব ঘটনাকে কেন্দ্র করে স্থানীয় পর্যায়ে দলীয় কর্মীদের মধ্যে দেখা দিয়েছে হতাশা। দলের ভেতর অপকর্মকারীদের বিরুদ্ধে শুদ্ধি অভিযান চালানোর ঘোষণা দেয়া হলেও; এখন পর্যন্ত তেমন কোন জোরালো পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। এতে করে অভ্যন্তরীণ কোন্দল আরও বাড়ছে। অবস্থাদৃষ্টে আওয়ামী লীগের অনেক নেতাই বলেছেন, যে অবস্থা বিরাজ করছে তাতে আওয়ামী লীগের শত্রু এখন আওয়ামী লীগই!
টানা দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতার ছয় মাস পেরুলেও দলটির স্থবিরতা এখনও কাটেনি। ইতোমধ্যেই বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৯ দলীয় জোটের পক্ষ থেকে সরকার পতনের আন্দোলন গড়ে তোলার ঘোষণা দেয়া হয়েছে। বিরোধী দলগুলোর সরকার হটানোর আন্দোলন মোকাবেলা করার মত সাংগঠনিক শক্তিই আওয়ামী লীগের রয়েছে কিনা; এই নিয়েও দলের ভেতরে-বাইরে নানামুখী গুঞ্জন। বারবার তৃণমূলকে শক্তিশালী করে সাংগঠনিক ভিত মজবুত করার কথা বলা হলেও কার্যত সরকারেই ব্যস্ত থাকছে দলটি। এতে করে বাড়ছে দল ও সরকারের দূরত্ব। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সারা দেশেই আধিপত্যের লড়াই, প্রভাব বিস্তার এবং একক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার লড়াইকে কেন্দ্র করে নিজ দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে হত্যাকান্ডের মত ঘটনাও ঘটছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে দলের একজন সিনিয়র নেতা জানান, শামীম ওসমান, নিজাম হাজারী ও ঢাকার ইলিয়াস উদ্দিন মোল্লার মত প্রভাবশালী নেতারা অপকর্মে জড়িয়ে পড়ায় তৃণমূলে দলীয় নেতা-কর্মীরা আরও বেশি অপরাধ প্রবণ হয়ে উঠছে। দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে দলের সর্বনাশই শুধু হবে না ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক দলটি মানুষের আস্থাও হারাবে।
এ নেতা আরও বলেন, দল-উপদলে বিভক্ত হয়ে কিছু নেতা-কর্মী সাংগঠনিক কার্যক্রমকে রীতিমতো বাধাগ্রস্তও করছেন। জানা গেছে, গত কয়েক মাসে দেশের যেসব স্থানে জামায়াত-বিএনপি তা-ব চালিয়েছে, যেসব স্থানে আওয়ামী লীগ সাংগঠনিকভাবে দুর্বল। মূলত নানাভাবে বিভক্ত হয়ে পড়া ও দীর্ঘদিন ধরে সম্মেলন না হওয়ার কারণেই তারা আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী ও সমর্থকদের ওপর হামলা চালানোর সাহস পেয়েছে। এদিকে দলের মধ্যেই প্রশ্ন উঠেছে, আওয়ামী লীগের মতো প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক দলের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আলোচনায় আওয়ামী লীগ কর্মী-সমর্থক নেই কেন? দলের ত্যাগী ও মাঠপর্যায়ের পরীক্ষিত নেতা-কর্মীদের সাথে আলাপ করলে ক্ষোভের সঙ্গে বলছেন, দিবসভিত্তিক কর্মসূচি ছাড়া আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতাদের সাংগঠনিক কর্মসূচিতে দেখা যায় না। দলে হাইব্রিড নেতাদের কাছে পরীক্ষিত নেতারা অনেকটা কোণঠাসা। এমন পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগ প্রায় হারাতে বসেছে তার স্বাভাবিক গতিধারা ও ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতা।
জেলায় জেলায় আধিপত্য বিস্তারের লড়াইয়ে টেন্ডারবাজি, হাট, মাঠ-ঘাট মিলিয়ে রাজনৈতিক বাণিজ্যিকীকরণের রমরমা ব্যবসায় বিভক্ত সিন্ডিকেটগুলো সক্রিয়। দলের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম নেতা-কর্মীদের কাছ থেকে নক্ষত্রের দূরত্বে থাকেন। দলের সাংগঠনিক সম্পাদকদের কাজ নেই তো খই ভাজ অবস্থা। দলের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম প্রেসিডিয়াম সদস্যরা যেন এলপিআর-এ আছেন। ৬৫ বছরের ঐতিহ্যবাহী এই রাজনৈতিক দলের কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যন্ত সভা-সমাবেশে যে আওয়ামী লীগ সুসংগঠিত রূপ নিয়ে রাজনৈতিক শক্তি প্রদর্শন করত; তারা এখন সেই পথ ছেড়ে নিজেরাই গোলাগুলি, সংঘাত ও রক্তারক্তিতে ব্যস্ত। সাংগঠনিক সফরেও আগ্রহ নেই কেন্দ্রীয় নেতাদের। দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়েও আসেন না শীর্ষ নেতারা। গত দেড় বছরে দলের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম প্রেসিডিয়ামের বৈঠক হয়েছে মাত্র একবার। দলের কার্যনির্বাহী কমিটির যে কয়টি বৈঠক হয়েছে সেখানেও সাংগঠনিক আলোচনার চেয়ে গালগল্পই বেশি হয়েছে।
পাঁচই জানুয়ারির নির্বাচনের পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কোনো মন্ত্রী-এমপিকে বিতর্কিত কর্মকান্ডে না জড়ানোর জন্য হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন। দলের ভাবমর্যাদা ক্ষুণœ না হওয়ার জন্যই তার এ নির্দেশ ছিল। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত যৌথ সভায়ও প্রধানমন্ত্রী কঠোরভাবে একই নির্দেশ দেন। কিন্তু সরকারের ছয় মাস না যেতেই দলের কয়েকজন সংসদ সদস্যের নাম জড়িয়ে গেছে নানা বিতর্কিত কর্মকান্ডে। একের পর এক চাঞ্চল্যকর ঘটনায় ঘুরে ফিরে আসছে কয়েকজন এমপির নাম। এতে বিব্রত দলের হাইকমান্ড, বিব্রত সাধারণ নেতাকর্মীরাও; ক্ষুব্ধ সাধারণ মানুষ। স্থানীয় নেতাকর্মীদের অভিযোগ, গুটিকয়েক নেতার কর্মকান্ডে সরকার এবং দল ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এসব সুযোগ সন্ধানীরা এখন সামনের কাতারে। সম্প্রতি মিরপুরের কালশীতে ১০ বিহারি হত্যাকা-, নারায়ণগঞ্জের বহুল আলোচিত সেভেন মার্ডার, ফেনীতে উপজেলা চেয়ারম্যান একরাম হত্যার ঘটনায় নানাভাবে ক্ষমতাসীন দলের তিন সংসদ সদস্যের নাম আলোচিত হচ্ছে। দলে অপকর্মকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার কথা বলা হলেও; এসব অপকর্মকারীরা ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়ে গেছেন।
অন্যদিকে দলের ত্যাগী নেতাকর্মীদের অবমূল্যায়ন, আত্মীয়স্বজন পরিবেষ্টিত মন্ত্রী-এমপি, সুবিধাভোগী ও চাটুকারদের অবস্থান হচ্ছে আরও শক্তিশালী। বছরের পর বছর ধরে জেলা-উপজেলা শাখার সম্মেলন না হওয়া এবং সাংগঠনিক কার্যক্রম অব্যাহত না থাকার জন্যও আওয়ামী লীগ এ অবস্থায় পৌঁছেছে বলে তারা মনে করেন। এ নিয়ে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান সম্প্রতি বলেছেন, আওয়ামী লীগকে খুব শক্তিশালী মনে হলেও এর সাংগঠনিক ভিত্তি নড়বড়ে। ফরিদপুরে অনুষ্ঠিত এক মতবিনিময় সভায় টিআইবি’র নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান আরও বলেন, দলটির স্থানীয় পর্যায়ের নেতাকর্মীরা ক্ষুব্ধ ও হতাশ। নিজ ঘরের এতবড় সঙ্কটেও ঘুম ভাঙ্গছে না শাসক দলটির। বেঙ্গলিনিউজটোয়েন্টিফোর.কম