শনিবার , ২১শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ , ৬ই আশ্বিন, ১৪৩১ , ১৭ই রবিউল আউয়াল, ১৪৪৬

হোম > Uncategorized > নতুন জীবনের সন্ধানে ১১ বীরাঙ্গনা

নতুন জীবনের সন্ধানে ১১ বীরাঙ্গনা

শেয়ার করুন

বাংলাভূমি২৪ ডেস্ক ॥

চাঁপাইনবাবগঞ্জ: ‘এক নদী রক্ত পেরিয়ে’ অর্জিত এ বাংলাদেশ। স্বাধীনতার লাল সূর্যকে হাতের মুঠোয় পেতে স্বেচ্ছায় জীবন উৎসর্গ করেছেন লাখো প্রাণ। মুক্তিযুদ্ধকালে পাক হানাদার বাহিনীর কাছে বর্বর শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ২ লাখ বঙ্গকন্যা। তাদের ত্যাগের বিনিময়ে স্বাধীনতা অর্জিত হলেও এতদিন লোকচক্ষুর অন্তরালে ছিলেন এসব বীরাঙ্গনা। চরম দারিদ্র, ধর্মীয় কুসংস্কার আর সামাজিক বৈষম্যের শিকার হয়েই দীর্ঘ জীবন কাটিয়েছেন এসব মানুষ। সম্প্রতি ৪১ জন বীরাঙ্গনাকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়। এদের মধ্যে ১১ জনই চাঁপাইনবাবগঞ্জের। রাষ্ট্রের স্বীকৃতিতে উচ্ছ্বসিত তারা। অতীতের সব কষ্ট ভুলে এখন নতুন জীবনের স্বপ্ন দেখছেন এ বীরাঙ্গনারা।

বীরাঙ্গনারা হলেন-গোমস্তাপুর উপজেলার বোয়ালিয়া ইউনিয়নের নরশিয়া গ্রামের মৃত এন্তাজ আলীর স্ত্রী রাবিয়া বেগম, একই গ্রামের মো. নওশাদ আলীর স্ত্রী রেনু বেগম, শহীদ আয়েজ উদ্দিনের স্ত্রী রাহেলা বেগম, একই ইউনিয়নের লক্ষ্মীনারায়ণপুর গ্রামের মৃত এনতাজ আলীর স্ত্রী হাছিনা বেগম, লালাপাড়া গ্রামের মৃত কালু শেখের স্ত্রী জলো বেগম, বড়বঙ্গেশপুর গ্রামের মৃত রাজ্জাকের স্ত্রী সফেদা বেগম, একই গ্রামের ঝড়ু শেখের স্ত্রী আয়েসা বেগম, সাহাপুর গ্রামের মৃত তামির আলীর স্ত্রী হাজেরা বেগম, একই গ্রামের মৃত ওহেদুল আলীর স্ত্রী আরবি বেগম, শিবগঞ্জ উপজেলার মনাকষা ইউনিয়নের চৌকা গ্রামের মৃত রুস্তম আলীর স্ত্রী মালেকা বেগম ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ পৌর এলাকার লাখেরাজপাড়ার তাজেমুল হকের স্ত্রী লিলি বেগম। এসব বীর নারীদের সঙ্গে এই প্রতিবেদকের কথা হলে তাদের মুখে ফুটে ওঠে দীর্ঘ বঞ্চনার ইতিহাস।

একাত্তরের ২২ নভেম্বর নরশিয়া গ্রামে পাকহানাদার বাহিনী চরম শারীরিক নির্যাতন চালায় রাবিয়া বেগমের ওপর। নিজের স্বামীও জানতেন না তার স্ত্রী স্বাধীনতার বীর সেনানী। লোকলজ্জার ভয়ে রাবিয়ার শ্বশুর ও ভাবী গোপন করেছিলেন নির্মম এই সত্যটি। কিন্তু এই সত্যটি যখন উন্মোচিত হলো ততক্ষণে রাষ্ট্র তাকে সম্মানিত করেছে বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে।

মুক্তিযোদ্ধা রাবিয়া জানান, ফজরের আজানের পর তাদের গ্রামে আক্রমণ করে পাক হানাদারবাহিনী। এ সময় তারা গুলি চালিয়ে হত্যা করে কয়েকজনকে। ভয়ে মসজিদ থেকে পালিয়ে যান রাবিয়ার স্বামী। পরে রাজাকারসহ কয়েকজন পাকসেনা বাড়িতে প্রবেশ করে শ্বশুর, ভাবী ও তাকে মারধর করে। একপর্যায়ে তিন পাকসেনা তার ওপর শারীরিক নির্যাতন চালায়। শ্বশুর ও ভাবী সামাজিক সম্মানের বিষয়টি মাথায় রেখে তার স্বামীকেও এ সত্য জানাননি। পরে স্বামী মারা গেলে ধান কুড়িয়ে, মানুষের বাড়িতে কাজ করে সন্তানদের বড় করেছেন তিনি।

মাত্র তিন মাস বিয়ে হয়েছিল সাহাপুর গ্রামের হাজেরা বেগমের। এর মধ্যেই যুদ্ধ। পাকিস্তানি হায়েনার দল দ্বারা শারীরিক নির্যাতনের শিকার। এমন দুঃসময়ে পাষণ্ড স্বামীও হাজেরাকে ত্যাগ করে নিরুদ্দেশ হয়।

সন্তান প্রসবের তিন মাস পর রাজাকারদের সহায়তায় পাক হানাদাররা চৌডালা এলাকায় এক ঘরে বন্দি করে আরবী বেগমকে। তারপর চালায় অবর্ণনীয় নির্যাতন। এ সময় কোলের সন্তানটিকে পর্যন্ত তারা বুকের দুধ খেতে দেয়নি। ক্ষুধায় কাতর শিশুটি একসময় মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। শুধু তাই নয়, গুলি করে হত্যা করা হয় তার স্বামীকেও।

তবে অন্য বীরাঙ্গনাদের চেয়ে সৌভাগ্যবান নরশিয়া গ্রামের রেনু বেগম। পাকসেনাদের দ্বারা নির্যাতিত হলেও বুকে টেনে নিতে ভোলেননি তার স্বামী। দিনমজুরি করে স্বামী স্ত্রী-সন্তানদের চালাতেন। কিন্তু সেই সুখ বেশিদিন টেকেনি। স্বামীর মৃত্যুর পর পরের বাড়িতে ঝিয়ের কাজ করে সংসারের হাল ধরতে বাধ্য হন তিনি । এখন বয়স হয়েছে। শারীরিক সামর্থ্য না থাকায় নেমেছেন ভিক্ষাবৃত্তিতে!

তবে মুক্তিযোদ্ধা খেতাব প্রাপ্তির বিষয়ে বীরাঙ্গনাদের কেউ জানতেনই না। সাংবাদিকদের কাছ থেকে এ খবর জানলে হাস্যোজ্বল হয়ে ওঠে তাদের মুখ। বর্তমান সরকারের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান তারা। কিন্তু একটু পরই আবার মলিন হয়ে ওঠে তাদের মুখ। অনেকে আক্ষেপ করে বলেন, ‘জীবন তো শেষ, আর কয়দিন বাঁচব। এখন তাহলে ভালভাবে দু’ বেলা খেতে-পরতে পারব!’

একই গ্রামের শহিদ মুক্তিযোদ্ধা অয়েজউদ্দীন ও বীরাঙ্গনা রাহেলা বেগমের ছেলে তাইফুর রহমান জানান, তার চোখের সামনে পিতাকে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে আহত করে। পরে হাত-পা বেঁধে গুলি করে হত্যা করে লাশ পানিতে ফেলে দেয়। মায়ের ওপর চালানো হয় অকথ্য নির্যাতন। তারপর ঘরবাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেয় পাকবাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসররা।

পাকবাহিনীর নির্মমতার প্রত্যক্ষদর্শী বেনু মিয়া। তিনি বলেন, স্থানীয় রাজাকারদের সহায়তায় রহনপুর ক্যাম্প থেকে পাক মিলিটারি এসে ধর্ষণ, হত্যা, লুটপাট, অগ্নিসংযোগসহ ব্যাপক তাণ্ডব চালায়। এই এলাকায় ছিল মুক্তিবাহিনীর স্থায়ী ক্যাম্প। আর ওই ক্যাম্প ধ্বংস করাই ছিল এ আক্রমণের মূল লক্ষ্য। এ সময় ১৭ জন মুক্তিযোদ্ধাসহ আশপাশের গ্রামের ৩৫ জনকে হত্যা করে তারা। খবর পেয়ে ক্যাপ্টেন মহিউদ্দীন জাহাঙ্গীরের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনী পাল্টা আক্রমণ চালালে পিছু হটতে বাধ্য হয় হানাদারা।

তিনি বলেন, ‘এতদিন পর মাত্র কয়েকজনকে সম্মান জানানো হয়েছে। কিন্তু এখনও অনেকেই লোকলজ্জার ভয়ে নির্মম সেই সত্য প্রকাশ করেননি। ৪৪ বছর ধরে অর্ধাহার-অনাহারে থাকা এসব বীর নারীদের খুঁজে বের করা জরুরি।’

দেশের সকল বীরাঙ্গনাকে সঠিক সম্মান দেওয়ার দাবি জানিয়ে জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘অস্ত্র হাতে যুদ্ধ না করলেও এসব বীরাঙ্গনা তাদের মতোই বীর, তারাও মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক। সামাজিক লোকলজ্জা আর ধর্মীয় গোঁড়ামির শিকার এসব নারীরা ডুকরে কেঁদেছেন সুদীর্ঘকাল। স্বাধীনতার পরই যদি তাদের সম্মান জানানো হতো তাহলে এতদিন তাদের কষ্ট করতে হতো না।’