রবিবার , ২২শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ , ৭ই আশ্বিন, ১৪৩১ , ১৮ই রবিউল আউয়াল, ১৪৪৬

হোম > Uncategorized > নতুন চ্যালেঞ্জে গার্মেন্ট শিল্প

নতুন চ্যালেঞ্জে গার্মেন্ট শিল্প

শেয়ার করুন

বাংলাভূমি২৪ ডেস্ক ॥
বাংলাদেশী তৈরী পোশাকের দেশভিত্তিক সর্ববৃহৎ একক বাজার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অগ্রাধিকারমূলক রফতানি সুবিধা (জিএসপি) হারিয়ে আহত হয়েছেন রফতানিকারকেরা আরো আগেই। অঞ্চলভিত্তিক সর্ববৃহৎ বাজার ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) থেকে ইংল্যান্ডের বেরিয়ে যাওয়ার ঘোষণায় তারা হন মর্মাহত। গ্যাস-বিদ্যুতের সীমাহীন দুর্ভোগ তো এ দেশের উদ্যোক্তাদের নিত্যসঙ্গী।

এখন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন ১২ জাতির জোট ট্রান্স প্যাসিফিক পার্টনারশিপে (টিপিপি) অন্যতম প্রতিদ্বন্দ্বী ভিয়েতনামের অন্তর্ভুক্তি নতুন করে ভাবনায় ফেলে দিয়েছে বাংলাদেশকে। একের পর এক বিদেশী হত্যাকাণ্ড এবং উগ্রবাদী হামলার ঘটনায় বায়ারদের ফিরে যাওয়ার প্রবণতা তো আছেই। চ্যালেঞ্জের তালিকায় সর্বশেষ যুক্ত হয়েছে বাজার দখলে প্রতিযোগী ভারতের আগ্রাসী কর্মসূচি। পোশাক শিল্পের উন্নয়ন ও প্রসারে নতুন করে ছয় হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি ঘোষণা করেছে দেশটির সরকার।

তৈরী পোশাক শিল্পখাত সংক্রান্ত স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশের জিএসপি সুবিধা বাতিল ও ভারতের রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় আন্তর্জাতিক বাজার দখলের কৌশলে বাংলাদেশ কঠিন চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হবে। এতে বলা হয়, বাংলাদেশের তৈরী পোশাকের ৭০ শতাংশ ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাজারে বিক্রি হয়। বছরে রফতানির তিন বিলিয়ন ডলারের বেশির ভাগই পোশাক খাতের। ইইউ থেকে বের হয়ে যাওয়া ব্রিটেনের বাজারে বাংলাদেশী পোশাক শুল্কমুক্ত সুবিধা না পেলে তারা নেতিবাচক প্রভাব পড়বে দেশের অর্থনীতিতে। ভারত সরকার পোশাক শিল্পের উন্নয়ন ও প্রসারে ছয় হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি ঘোষণা করেছে উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৮ সালের মধ্যে তারা চার হাজার ৩০০ কোটি মার্কিন ডলারের পোশাক রফতানির ল্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। সম্ভাব্য হুমকি ও চ্যালেঞ্জসমূহ যথাযথভাবে মোকাবেলা করা না গেলে ২০২১ সালের মধ্যে ৫০ বিলিয়ন ডলারের পোশাক রফতানির ল্যমাত্রা অর্জন মারাত্মকভাবে বাধাগ্রস্ত হবে বলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ বরা হয়।-নয়া দিগন্ত।

বিভিন্ন পর্যায়ের রফতানিকারকদের সাথে কথা বলে জানা যায়, দেশের তৈরী পোশাক শিল্পখাতে প্রথম বড় ধাক্কা লাগে ২০১৩ রানা প্লাজা ধসের ঘটনায়। সরকারের সাথে রাজনৈতিক মতপার্থক্যের কারণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশী পণ্যের অগ্রাধিকারমূলক প্রবেশাধিকার (জিএসপি) হারানোর ঘটনায় আরেক দফা মুষড়ে পড়েন এ খাতের উদ্যোক্তারা। সুশাসন ও মানবাধিকারসহ নানা বিতর্কের জেরে নিরাপত্তার অজুহাতে বাংলাদেশ থেকে ইংল্যান্ডে কার্গো পরিবহন বন্ধ হয়ে যাওয়া, একের পর এক বিদেশী হত্যাকাণ্ডে বায়ারদের মাঝে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়া, ধারাবাহিক রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ও অনিশ্চয়তায় উৎপাদন ও সরবরাহ ব্যবস্থায় ব্যাঘাত সৃষ্টি এবং সর্বোপরি তীব্র গ্যাস-বিদ্যুৎ সঙ্কটে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে শত শত কারখানা। আয়-ব্যয়ের হিসাব মেলাতে ব্যর্থ হয়ে ক্রমেই হতাশ হয়ে পড়ছেন রফতানি আয়ে ৮৩ শতাংশ অবদান রক্ষাকারী তৈরী পোশাক শিল্পখাতে উদ্যোক্তারা।

ব্যবসায়ীরা বলছেন, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সাথে সম্পর্কের ক্রমাবনতি এবং নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে কিছু দিন পরপরই বিদেশী দূতাবাসগুলোর উপর্যুপরি রেড অ্যালার্ট জারির ঘটনায় তৈরী পোশাক শিল্প খাতের ক্রেতাদের আনাগোনা আশঙ্কাজনক হারে কমে গেছে। ইউরোপ-আমেরিকার বাজারে বাংলাদেশের দখল ধীরে ধীরে চলে যাচ্ছে ভারতীয়দের হাতে। অন্য দিকে বিদ্যুৎ ও গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধিজনিত কারণে প্রতি ডজন পোশাকের উৎপাদন খরচ বেড়েছে গড়ে ৯৫ সেন্ট। অথচ বাড়ানোর পরিবর্তে বায়াররা প্রতিনিয়ত কমিয়ে দিচ্ছে উৎপাদিত পণ্যের দাম। সবমিলিয়ে যতই দিন যাচ্ছে বাংলাদেশের তৈরী পোশাক শিল্পের সামনে চ্যালেঞ্জ ক্রমেই বাড়ছে।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওই প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, সরকার এ খাতের প্রসারে লাতিন আমেরিকা, রাশিয়াসহ বিভিন্ন দেশে নতুন নতুন বাজার অনুসন্ধান করছে। এমন সময়ে গুলশানে উগ্রবাদী হামলার ফলে বায়ারদের বাংলাদেশে আসতে নিরাপত্তাহীনতাবোধের পরিপ্রেক্ষিতে নতুন বাজার ও ব্যবসা সম্প্রসারণের কাজ বাধাগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। পোশাক কারখানায় ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি বিদেশী টেকনিশিয়ানরা স্থাপন ও মেরামত করেন উল্লেখ করে এতে আরো বলা হয়, কারখানায় যান্ত্রিক ত্রুটি দেখা দিলে বিদেশী টেকনিশিয়ানরা নিরাপত্তার দোহাই দিয়ে আসতে গড়িমসি করতে পারেন। এতে প্রতিষ্ঠানের উৎপাদন ব্যাহত হয়ে পণ্যের ডেলিভারি দিতে সমস্যা হতে পারে। এসব চ্যালেঞ্জ ও হুমকি মোকাবেলা করতে না পারলে পোশাক রফতানি মারাত্মকভাবে বাধাগ্রস্ত হবে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।

পেট্রোবাংলার তথ্যানুযায়ী, দেশে বর্তমানে পাঁচ হাজার ৯৭৩টি শিল্প কারখানায় গ্যাস সংযোগ আছে। এসব কারখানায় উৎপাদনের প্রধান উপাদান গ্যাস হলেও নিরবচ্ছিন্ন ও প্রয়োজনীয় চাপসহ গ্যাস পাচ্ছে না কোনো প্রতিষ্ঠানই। গ্যাসের জন্য আবেদন করে বছরের পর বছর অপেক্ষা করছেন আরো দুই হাজার ২২৩ শিল্পপ্রতিষ্ঠানের উদ্যোক্তারা। সব প্রস্তুতি সম্পন্ন হলেও তারা জানেন না কবে গ্যাস সংযোগ পাবেন, কবে উৎপাদনে যেতে পারবেন। ফলে তীব্র অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে পুরো শিল্পোৎপাদনে। এলোমেলো হয়ে যেতে বসেছে দ্রুত শিল্পায়নের মাধ্যমে উৎপাদন বাড়িয়ে অর্থনৈতিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত করার সরকারি পরিকল্পনা। তীব্র গ্যাস সঙ্কট সামাল দিতে সরকার ২০০৯ সালের ১ অক্টোবর থেকে সারা দেশে নতুন শিল্প ও বাণিজ্যিক সংযোগ এবং লোড বৃদ্ধি বন্ধ করে দেয়। এর পর অগ্রাধিকার ভিত্তিতে শিল্পে সংযোগ দিতে ২০১১ সালের ২ জানুয়ারি একটি উচ্চপর্যায়ের কমিটি গঠন করা হলেও কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।

নানা সঙ্কটে গত তিন বছরে ৬১৮টি কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে জানিয়ে তৈরী পোশাক রফতানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএ সভাপতি মো: সিদ্দিকুর রহমান বলেন, বন্ধ হওয়ার পথে রয়েছে আরো ৩১৯ কারখানা। রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, বিভিন্ন পর্যায়ে উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়া এবং গ্যাস-বিদ্যুৎ সঙ্কটে বিনিয়োগ হচ্ছে না জানিয়ে তিনি বলেন, বিনিয়োগের অভাবে কর্মসংস্থানও সৃষ্টি হচ্ছে না। যেখানে প্রতি বছর ২০ লাখ ব্যক্তি শ্রমবাজারে যুক্ত হচ্ছে, সেখানে গত দুই অর্থবছরে দেশে কর্মসংস্থান হয়েছে মাত্র ছয় লাখ লোকের।

তিনি বলেন, ইউরোপ আমেরিকায় অর্থনৈতিক মন্দা, জিএসপি ফিরিয়ে পাওয়ার বিষয়ে অনিশ্চয়তা, ইইউ থেকে যুক্তরাজ্যের বেরিয়ে যাওয়ার ঘোষণা, বাজার দখলে ভারতের ব্যাপক পরিকল্পনা, মার্কিন জোটে ভিয়েতনামের অন্তর্ভুক্তি আমাদের আরো বেশি ভাবিয়ে তুলছে। এখনই কার্যকর উদ্যোগ নেয়া না হলে বাংলাদেশের তৈরী পোশাক শিল্প ভীষণ সমস্যায় পড়বে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি।