শনিবার , ২১শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ , ৬ই আশ্বিন, ১৪৩১ , ১৭ই রবিউল আউয়াল, ১৪৪৬

হোম > Uncategorized > দুদকের তদন্তে শওকতের দুর্নীতির চিত্র

দুদকের তদন্তে শওকতের দুর্নীতির চিত্র

শেয়ার করুন

বাংলাভূমি২৪ ডেস্ক ॥ প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. খোন্দকার শওকত হোসেন বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে, গণপূর্তসচিব থাকাকালে ক্ষমতার অপব্যবহার, নিয়মনীতি লঙ্ঘন ও প্লট বরাদ্দে অনিয়মসহ নানা দুর্নীতির মাধ্যমে তিনি হাতিয়ে নিয়েছেন কোটি কোটি টাকা।

দুর্নীতির অভিযোগে ইতিমধ্যে তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) তিনটি পৃথক মামলা করেছে। দুদকের অনুসন্ধানে তার চাঞ্চল্যকর সব দুর্নীতির চিত্র বেরিয়ে এসেছে। মুক্তিযোদ্ধা না হয়েও ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সনদ নিয়ে চাকরির মেয়াদ বাড়ানোর অভিযোগেও অনুসন্ধান করছে দুদক।

আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন বিগত মহাজোট সরকারের আমলে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রী আবদুল মান্নান খানের দুর্নীতির অন্যতম সহযোগী ছিলেন একই মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন সচিব ড. খোন্দকার শওকত হোসেন।

দুদক সূত্র জানায়, খোন্দকার শওকত হোসেন দুর্নীতির মাধ্যমে উপার্জিত শত শত কোটি টাকায় শুধু দেশেই সম্পদের পাহাড় গড়েননি, কৌশলে হুন্ডি ও ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিদের মাধ্যমে দেশের বাইরেও কোটি কোটি টাকা পাচার করেছেন। দুদকে তিনটি মামলাসহ হাজারো দুর্নীতির অভিযোগ মাথায় নিয়ে এখনো শওকত হোসেন প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব পদে বহাল তবিয়তে থাকায় সচিবালয়েরই একাধিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বিস্ময় প্রকাশ করেন।

অনেকেই ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘মানুষের দুর্নীতির একটা সীমা আছে, কিন্তু শওকত হোসেনের দুর্নীতির কোনো সীমা নেই। গণপূর্তসচিবের দায়িত্ব পালনকালে তিনি প্রায় হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন, দুর্নীতির অভিযোগে তার বিরুদ্ধে দুদক মামলা করল। মুক্তিযোদ্ধা না হয়েও ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সনদ নিয়ে চাকরির মেয়াদ বাড়ানোর অভিযোগেও তার বিরুদ্ধে দুদক অনুসন্ধান করছে। বিদেশে কয়েক শ‘ কোটি টাকা পাচারের বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত পেয়েছে গোয়েন্দা বিভাগ, তা সত্ত্বেও সেই দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা এখনো বহাল আছেন। এক শওকত হোসেনের কারণে আমাদের সরকারি কর্মকর্তাদের অনেক জায়গায় মাথা নিচু হয়ে যায়।’

অভিযোগকারীরা বলছেন, শওকত হোসেন সরকারের ওপর মহলকে দুর্নীতির টাকায় ম্যানেজ করে এখন সচিব হিসেবে বহাল আছেন।

দুদক সূত্রে জানা গেছে, মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সংশ্লিষ্ট বিষয়ে তদন্ত করতে গিয়ে সচিব ড. শওকত হোসেনের সম্পদের পরিমাণ ও দুর্নীতির ভয়াবহতা দেখে বিস্মিত হচ্ছেন। শওকত হোসেন স্ত্রী আয়েশা খানমের নামে উত্তরা ৬ নম্বর সেক্টরে (রোড-৯, বাড়ি-১৩৪) ছয় কাঠা প্লটের ওপর ছয় তলা ভবন করেছেন, যার বাজারমূল্য প্রায় আট কোটি টাকা। গুলশান-১-এর ১২ নম্বর রোডের ২২০ নম্বর অ্যাপার্টমেন্টে একটি ফ্ল্যাট কিনেছেন। এর মূল্য সাড়ে তিন কোটি টাকা। সাভার-আশুলিয়ায় রয়েছে ১২০ বিঘা জমি, যার মূল্য এখন শত কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। ময়মনসিংহের ভালুকা শিল্প এলাকায়ও শওকত হোসেনের রয়েছে ৪০ বিঘা জমি, যার মূল্য প্রায় ১৬ কোটি টাকা।

নিজের ভাইদের নাম ব্যবহার করে তিনি কক্সবাজার সৈকত ঘেঁষে তিন বিঘা জমি কিনেছেন, যার বাজারমূল্য প্রায় ২০ কোটি টাকা। রাজধানীর বনানীতে স্ত্রী ও শ্যালকের নামে আট কাঠার প্লট কিনেছেন, এর বাজারমূল্য ৩৮ কোটি টাকা।

অনুসন্ধানে আরও জানা গেছে, শওকত হোসেন রাজধানীর মোহাম্মদপুরে ১৪ কোটি টাকায় সাত বিঘা জমি কিনেছেন, তা রেজিস্ট্রি করেছেন ভাইয়ের নামে। দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের আবদুল্লাহপুরে ১৫ বিঘা জমি কিনেছেন ৩৬ কোটি টাকায়। তাঁর নিজ নামে প্লট-ফ্ল্যাট, বাড়ি-গাড়ি, জমি, ব্যাংক ব্যালান্স ছাড়াও তাঁর স্ত্রী, শ্যালক ও ভাইদের নামে ৩০টি ট্রাক, শেয়ারসহ বিশাল সম্পদের তথ্য পেয়েছে দুদক। এখানেই শেষ নয়, পুঁজিবাজারে স্ত্রী ও শ্যালকদের বিও অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে বিনিয়োগ করেছেন প্রায় শত কোটি টাকা। বিদেশে পাচার করেছেন কয়েক শ কোটি টাকা।

এসব জ্ঞাত সম্পদের বাইরে অজ্ঞাত আরো প্রচুর সম্পদ রয়েছে বলে দুদক কর্মকর্তারা ধারণা করছেন। সেগুলোর খোঁজে রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে অনুসন্ধান চালাচ্ছে দুদক।

দুদক সূত্র জানিয়েছে, খোন্দকার শওকত হোসেনের প্লট কেলেঙ্কারির অন্যতম সহযোগী প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের উপসচিব মোহাম্মদ মুসাসহ ১২ জনকে মামলার বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করতে তলব করে দুদক। এরই ধারাবাহিকতায় গত বুধবার দুদকের প্রধান কার্যালয়ে টানা দেড় ঘণ্টা মুসাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন দুদকের অনুসন্ধান কর্মকর্তা ও উপপরিচালক যতন কুমার রায়। একই দিন সকালে রাজউকের সহকারী পরিচালক মিজানুর রহমানসহ আরো তিনজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করে দুদক।

জানা গেছে, শওকত হোসেন গণপূর্ত সচিব থাকাকালে মুসা রাজউকের উপপরিচালক (এস্টেট-২) হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। শওকত হোসেনের পাশপাশি মুসাও বদলি হয়ে এখন একই মন্ত্রণালয়ে কর্মরত। শওকত হোসেনের দুর্নীতির অনুসন্ধান করতে গিয়ে দুদকের তদন্তে বেরিয়ে আসে মুসার অবৈধ কর্মকাণ্ডের চিত্র। দুদকের জিজ্ঞাসাবাদে শওকত হোসেনের নানা অনিয়মের বিষয়ে মুখ খুলেছেন মুসা, কিন্তু তদন্তের স্বার্থে সেসব তথ্য প্রকাশ করতে চাননি দুদকের ওই কর্মকর্তা।

দুদকের জিজ্ঞাসাবাদে রাজউক কর্মকর্তারা জানান, খন্দকার শওকত হোসেন সচিব থাকাকালে প্রতিমন্ত্রী মান্নান খান ও রাজউকের চেয়ারম্যান নূরুল হুদার সিন্ডিকেটে সবকিছুই নিয়ন্ত্রণ হতো। অবৈধ সুযোগ-সুবিধা নিয়ে তাঁরা দিনকে রাত আর রাতকে দিন করতেন। জালিয়াতি করে অনেকের প্লট দখল করে নিয়েছেন তাদের আত্মীয়স্বজনের নামে। মিথ্যা অভিযোগের ভিত্তিতে উত্তরা প্রকল্পে আইনুল হক নামের এক ব্যবসায়ীর পাঁচ কাঠার একটি প্লট হাতিয়ে নেন সচিব শওকত হোসেন। রাজউক থেকে প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে দুদকের অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে এ জালিয়াতির ঘটনা।

আইনুলের প্লট শওকতের দখলে:
জালিয়াতির মাধ্যমে জীবিত আইনুল হককে মৃত দেখিয়ে কয়েক কোটি টাকা মূল্যের দামি প্লটটি এখন দখলে নিয়েছেন শওকত হোসেন। তিন কাঠার নিজের প্লটের পরিবর্তে রাজধানীর উত্তরা ১৩ নম্বর সেক্টরের ৮৬ নম্বর সড়কের পাঁচ কাঠার প্লটটি কৌশলে হাতিয়ে নিয়েছেন তিনি।

দুদক সূত্র জানায়, তিন কাঠার পরিবর্তে পাঁচ কাঠার প্লটের আবেদনের পর শওকতকে বিভিন্ন লোকেশনে আরো দুটি পাঁচ কাঠার প্লট দেখানো হয়। একপর্যায়ে লয়েডস রেজিস্ট্রার অব শিপিং নামক বেসরকারি জাহাজ প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা মো. আইনুল হকের প্লটটি পছন্দ হয় শওকতের। তার নির্দেশে প্লটটি দখলের জন্য আইনুলকে মৃত দেখিয়ে তার ভুয়া ওয়ারিশদের দিয়ে প্লটের মালিকানা দাবি করানো হয়। এরপর প্লটটিকে মাদকসেবীদের আখড়া হিসেবে দেখানো হয়। আবার আইনুলকে সাত দিনের মধ্যে রাজউকে হাজির হওয়ার জন্য তার গ্রামের বাড়ির ঠিকানায় নোটিশও পাঠানো হয় কাগজে-কলমে। বাস্তবে সেই চিঠি তার গ্রামের বাড়িতে পাঠানোই হয়নি। আর এই সুযোগ নিয়ে রাজউকের শুনানিতে আইনুল হাজির না হওয়ার অজুহাত দেখিয়ে প্লটটির বরাদ্দ বাতিল করে দেয় রাজউক। আইনুল হক জাহাজে চাকরি করায় বেশির ভাগ সময়ই দেশের বাইরে থাকেন, দেশে ফিরে এমন জালিয়াতির ঘটনা জানতে পেরে প্রায় পাগল হয়ে যান। বিভিন্ন স্থানে ছোটাছুটি করেও তিনি নিজের প্লটটি আর দখলে নিতে পারেননি। এ বিষয়ে আইনুল হকও দুদকের কাছে সম্প্রতি অভিযোগ দেন।

দুদক সূত্র জানায়, আইনুলের প্লটটি নিজের দখলে আনতে শওকত হোসেন আশ্রয় নেন ভয়ানক জালিয়াতির। আইনুলের প্লটের বরাদ্দ বাতিল করতে রাজউকে তার বিরুদ্ধে বেনামে একটি অভিযোগ দায়ের করা হয়। উত্তরা ১৩ নম্বর সেক্টরের সচেতন এলাকাবাসীর পক্ষে জনৈক মো. আবদুল করিমের নাম দিয়ে অভিযোগ করে রাজউকে। অভিযোগে জালিয়াত চক্রের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানানো হয়।

তবে এতে প্লট বরাদ্দ পাওয়া আইনুল হকের বিরুদ্ধে সরাসরি কোনো অভিযোগ করা হয়নি। বলা হয়, আইনুল হক ১৯৯০ সালে মারা গেছেন- মর্মে তিন ব্যক্তি ওয়ারিশ দাবি করে রাজউকে সন্দেহজনকভাবে ঘোরাঘুরি করছে। তারা জালিয়াত চক্রের সদস্য। তা ছাড়া খালি পড়ে থাকা ওই প্লট মাদকসেবীদের আস্তানা। সাজানো ওই অভিযোগকে কেন্দ্র করেই তদন্তের নামে ৮৬ নম্বর প্লটের মালিক আইনুল হককে সাত দিনের মধ্যে রাজউকে হাজির হওয়ার নোটিশ দেয় রাজউক। ২০১১ সালের ১৪ ডিসেম্বর সহকারী পরিচালক হাফিজুর রহমান (এস্টেট) স্বাক্ষরিত নোটিশটি পাঠানো হয় আইনুল হকের গ্রামের বাড়ি পাবনার দিলালপুর গ্রামে। তবে কাগজে-কলমে পাঠানো হয়ছে দেখানো হলেও বাস্তবে নোটিশটি চেপে রাখা হয়। আইনুল দেশে ফিরে জানতে পারেন তাঁকে নোটিশ করা হয়েছিল। হাজির না হওয়ায় বরাদ্দ বাতিল করে দেওয়া হয়েছে।

২০১১ সালের ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত রাজউকের ১২তম সভায় বরাদ্দ বাতিলের সিদ্ধান্ত অনুমোদন হয়। সভার সিদ্ধান্তে রাজউকের সাবেক চেয়ারম্যান প্রকৌশলী মো. নূরুল হুদা, রাজউকের মো. আনোয়ারুল ইসলাম সিকদার (সদস্য-অর্থ), আখতার হোসেন ভুঁইয়া (সদস্য-এস্টেট), এম মাহবুব উল আলম (সদস্য-উন্নয়ন), নাজমুল হাই (সদস্য-প্রশাসন ও ভূমি), শেখ মোহাম্মদ আবদুল মান্নান (সদস্য-পরিকল্পনা) সই করেন।

জানা গেছে, রাজউক বিধি দ্য টাউন ইমপ্রুভমেন্ট অ্যাক্ট-১৯৫৩ ও দ্য ঢাকা ইমপ্রুভমেন্ট ট্রাস্ট (অ্যালটমেন্ট অব ল্যান্ড) রুলস-১৯৬৯ অনুযায়ী যেসব কারণে একজনের নামে বরাদ্দকৃত প্লট চূড়ান্তভাবে বাতিল হতে পারে তার কোনোটিই ছিল না আইনুল হকের নামে করা বেনামি অভিযোগে। খোন্দকার শওকত হোসেন রাজউক আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে আইনুল হকের প্লটটি দখলে নেন। বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম