শনিবার , ২১শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ , ৬ই আশ্বিন, ১৪৩১ , ১৭ই রবিউল আউয়াল, ১৪৪৬

হোম > শীর্ষ খবর > দিশাহীন প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া বাড়ছে তহবিল সংকট

দিশাহীন প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া বাড়ছে তহবিল সংকট

শেয়ার করুন

বাংলাভূমি ডেস্ক ॥
২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট। মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশে বসবাসরত রোহিঙ্গাদের জন্য ভয়াবহ এক দুঃস্বপ্নের বার্তা নিয়ে এসেছিল দিনটি। রাখাইনের সীমান্তবর্তী পুলিশ ও সেনাচৌকিতে এক হামলার জের ধরে রোহিঙ্গা সংখ্যালঘুদের ওপর নেমে আসে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর প্রতিহিংসার খড়্গ। বর্মি সেনাবাহিনীর নির্বিচার দমন-পীড়ন, হত্যা, অগ্নিসংযোগ আর লুটপাটের শিকার হতে থাকে রোহিঙ্গারা। ধর্ষণ ও বর্বর যৌন সহিংসতার শিকার হয় সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীটির নারীরা। এসব বর্বরতা বর্মি সৈন্যদের সহযোগী হয় স্থানীয় কিছু উগ্রপন্থী। প্রাণ বাঁচাতে নিজ মাতৃভূমি ছেড়ে প্রতিবেশী বাংলাদেশের দিকে দলে দলে রওনা দিতে থাকে রোহিঙ্গারা। রাতারাতি বিশ্বের বাস্তুচ্যুত মানুষের সবচেয়ে বড় গন্তব্য হয়ে ওঠে বাংলাদেশ।

চলমান রোহিঙ্গা সংকটের এক বছর পূর্ণ হচ্ছে আজ। এ সংকট সমাধানের দিশা মেলেনি আজো। ভেস্তে যেতে বসেছে রোহিঙ্গাদের নিজভূমে প্রত্যাবাসনের গোটা পরিকল্পনাটাই। উপরন্তু তহবিল সংকটে হোঁচট খাচ্ছে জাতিসংঘের নেতৃত্বে উদ্বাস্তুদের সহায়তায় নেয়া বিভিন্ন উদ্যোগ। এ সংকট দিনে দিনে হয়ে উঠছে জোরালো থেকে জোরালোতর।

রাখাইনে সেনা ও পুলিশচৌকিতে হামলার অজুহাতে বর্মি সেনাবাহিনী রোহিঙ্গাদের ওপর যে বর্বরতা ও নিপীড়ন চালিয়েছে, তাকে ‘জাতিগতভাবে নির্মূলের’ কার্যক্রম হিসেবেই দেখছে জাতিসংঘ। বর্মি সেনাদের বর্বরতার মুখে প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে অল্প কয়েকদিনের মধ্যে বাংলাদেশে পালিয়ে আসে প্রায় সাত লাখ রোহিঙ্গা। পেছনে ফেলে আসে জ্বালিয়ে দেয়া, ধুলোর সঙ্গে মিশিয়ে দেয়া গ্রাম।

এত অল্প সময়ের মধ্যে এ বিপুলসংখ্যক উদ্বাস্তুর চাপ আশ্রয়দাতা বাংলাদেশকেও ফেলে দেয় সমস্যার মুখে। উপকূলীয় জেলা কক্সবাজারে আগে থেকেই বসবাস করে আসছিল প্রায় তিন লাখ রোহিঙ্গা। দরিদ্র জেলাটির বাসিন্দাদের জীবন-জীবিকাকে ঝুঁকিতে ফেলে দেয় নতুন করে আরো সাত লাখের আগমন।

মিয়ানমার বলছে, পালিয়ে আসা উদ্বাস্তুদের ফিরিয়ে নিতে প্রস্তুত দেশটি। কিন্তু উদ্বাস্তু রোহিঙ্গাদের নিজ দেশের নাগরিকত্ব দিতে অস্বীকৃতি জানিয়ে আসছে নেপিদো। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে মিয়ানমারে বসবাস করে আসা রোহিঙ্গাদের বারবার ‘বাঙালি’ বলে অভিহিত করে আসছে বর্মিরা, যদিও তাদের এ দাবি ঐতিহাসিকভাবেই ভ্রান্ত বলে প্রমাণিত।

পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর বিষয়ে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে একটি চুক্তি হয়েছে ঠিকই। কিন্তু এ চুক্তিতে কোনো লাভ হয়নি কারো। উল্টো আমলাতান্ত্রিকতা আর অবিশ্বাসের বেড়াজালে আটকে গেছে এর বাস্তবায়ন। এখন পর্যন্ত প্রত্যাবাসন করা গেছে ২০০ জনেরও কমসংখ্যক রোহিঙ্গাকে।

এর আগে গত সপ্তাহে মিয়ানমারের কার্যত রাষ্ট্রপ্রধান অং সান সু চি বলেছিলেন, এ প্রত্যাবাসন কার্যক্রম কত দ্রুত শেষ হবে, তা সিদ্ধান্ত নেয়ার দায়িত্ব বাংলাদেশের। একই সঙ্গে রোহিঙ্গা জঙ্গিদের কাছ থেকে ‘সন্ত্রাসী হামলা’র আশঙ্কাকেও ‘বাস্তব ও উপস্থিত’ বলে মন্তব্য করেন তিনি।

অন্যদিকে রোহিঙ্গারাও এখন তাদের প্রাণের নিরাপত্তা, নাগরিকত্ব এবং পুড়িয়ে দেয়া ঘর ও জমির ক্ষতিপূরণ ছাড়া নিজ দেশে ফিরে যেতে চাইছে না। কিন্তু সমস্যা হলো, গাদাগাদি করে কাটানো উদ্বাস্তু শিবিরের জীবনযাত্রাও এখন দিন দিন কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে পড়ছে। রোহিঙ্গাদের জন্য মার্চ পর্যন্ত সহযোগিতা কার্যক্রম চালাতে জাতিসংঘের নেতৃত্বে ১০০ কোটি ডলারের এক তহবিল গঠনের উদ্যোগ নেয়া হয়। কিন্তু অর্থের সংস্থান হয় মোটে এর এক-তৃতীয়াংশ। তহবিল গঠনের আহ্বানে সাড়া পড়ার এ শ্লথগতিতে শঙ্কিত হয়ে ওঠে বিশেষজ্ঞ মহল।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ইমার্জেন্সি রেসপন্স চিফ ড. পিটার সালামা বলেন, ‘কোনো সংকট দেখা দেয়ার প্রথম এক বছরের মধ্যেই সবচেয়ে বেশি সহায়তা পাওয়া যায়। এর পর তহবিলের সংস্থান করা দিনে দিনে আরো কঠিন হয়ে পড়ে।’

তিনি জানান, ডিপথেরিয়া, কলেরা ও অন্যান্য সংক্রামক ব্যাধি ছড়িয়ে পড়া ঠেকানোর ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য রকম সাফল্য পাওয়া গেছে। বড় অংকের তহবিলের সংস্থান ছাড়া এ সাফল্য পর্যবসিত হতে পারে ব্যর্থতায়। এছাড়া পরিবার পরিকল্পনা ও মানসিক স্বাস্থ্যবিষয়ক সহযোগিতাও বন্ধ হয়ে যেতে পারে।

ড. পিটার সালামা বলেন, ‘বাংলাদেশ সরকারের এখন আরো বেশি আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ও সহমর্মিতা প্রয়োজন।

এছাড়া কক্সবাজার অঞ্চলের অবকাঠামো, স্বাস্থ্য ও শিক্ষাগত উন্নয়নের জন্য আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ৫০ কোটি ডলারের এক তহবিল সংগ্রহের আবেদন জানিয়েছিল বিশ্বব্যাংক।

রোহিঙ্গাদের সঙ্গে মিয়ানমার সরকারের বিমাতাসুলভ আচরণ চরমের দিক উঠতে শুরু করে সত্তরের দশকে। ওই সময় থেকে রোহিঙ্গা তাড়ানোর কার্যক্রম বাস্তবায়ন করতে থাকে মিয়ানমার।

রোহিঙ্গা উদ্বাস্তু মোহাম্মদ কাসিমের (২৭) জন্ম বাংলাদেশে। কিন্তু মিয়ানমার বা বাংলাদেশ— কোনো দেশেরই নাগরিকত্ব নেই তার। কাসিমের ভাষায়, ‘আমাদের ইতিহাসই হলো অন্ধকারাচ্ছন্ন ইতিহাস।’

মোহাম্মদ কাসিম কখনই নিজ দেশ মিয়ানমারের ভূখণ্ডে পা রাখেনি। সম্ভবত জীবনে আর কখনই রাখা হবে না। তার মতো বিড়ম্বিত জীবন মাথায় করে বেঁচে আছে এ রকম আরো কয়েক হাজার রোহিঙ্গা যুবক। মিয়ানমারে যেতে হলে এদের আগে প্রমাণ করতে হবে, সে ওই দেশেরই কেউ একজন। কিন্তু এদের জন্মই হয়েছে মিয়ানমারের বাইরে। সুতরাং এদের পক্ষে এটি প্রমাণ করাও এখন প্রায় অসম্ভব।

মিয়ানমারের আচরণে গত বছর রোহিঙ্গাদের ওপর শুরু করা দমন-পীড়ন সম্পর্কে কোনো ধরনেরই অনুতাপ দেখা যায় না। এছাড়া বিস্তর প্রমাণ থাকলেও রোহিঙ্গা গ্রামগুলোয় ব্যাপকহারে মানবাধিকার লঙ্ঘন, ধর্ষণ, খুন ও অগ্নিসংযোগ চালানোর অভিযোগগুলো অস্বীকার করে এসেছে দেশটি। অন্যদিকে এজন্য দায়ীদের বিচারের মুখোমুখি করার বিষয়ে আন্তর্জাতিক চাপও এখন বাড়ছে।

গত সপ্তাহেই জাতিগতভাবে নির্মূলের প্রয়াস চালানোর অভিযোগে মিয়ানমারের চার সেনা কর্মকর্তা ও দুটি ইনফ্যান্ট্রি ডিভিশনের ওপর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে ওয়াশিংটন।

অন্যদিকে বিষয়টি নিয়ে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদও শিগগিরই আলোচনায় বসবে। অন্যদিকে বিষয়টিতে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে (আইসিসি) তোলার জন্য উদ্বাস্তু শিবিরগুলোতেও এখন প্রমাণ একাট্টা করা হচ্ছে। কিন্তু নিরাপত্তা পরিষদে এ মুহূর্তে মিয়ানমারের ঢাল হয়ে দাঁড়িয়েছে পরিষদের এক স্থায়ী সদস্য চীন।

অন্যদিকে আরেক স্থায়ী সদস্য রাশিয়াকে নিয়েও সংশয় কম নয়। চলমান সংকটের এক বছর পূরণ হওয়ার প্রাক্কালে বর্মি সেনাপ্রধান রাশিয়ায় অবস্থান করছিলেন বলে জানা গেছে।

তলে তলে রোহিঙ্গাশূন্য উত্তর রাখাইন প্রদেশে ভূমি বণ্টন কার্যক্রমও সেরে রেখেছে মিয়ানমার। গড়ে তুলেছে নতুন নতুন সিকিউরিটি ক্যাম্প। অন্যদিকে প্রত্যাবাসিত উদ্বাস্তুদের জন্য বড় বড় ট্রানজিট ক্যাম্প বানিয়ে রেখেছে দেশটি। এর মধ্যে কোনো কোনোটির ধারণক্ষমতা প্রায় ৩০ হাজার জন।

রোহিঙ্গাদের ভয়, নাগরিকত্ব ছাড়া প্রত্যাবাসনের অর্থ হলো, এসব ক্যাম্পে তাদের স্থায়ীভাবে রেখে দেয়া হবে। ২০১২ সালে গড়ে তোলা এ রকমই এক শিবিরে ১ লাখ ২৯ হাজার রোহিঙ্গাকে এখনো রেখে দেয়া হয়েছে।সূত্র: বণিক বার্তা