শনিবার , ২১শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ , ৬ই আশ্বিন, ১৪৩১ , ১৭ই রবিউল আউয়াল, ১৪৪৬

হোম > Uncategorized > দলীয় কোন্দলে খুন ৫০ নেতা, খুনিরাই পুরস্কৃত

দলীয় কোন্দলে খুন ৫০ নেতা, খুনিরাই পুরস্কৃত

শেয়ার করুন

জেলা প্রতিনিধি ॥ গত সাড়ে চার বছরে যশোরে দলীয় সন্ত্রাসীদের হাতে খুন হয়েছেন আওয়ামী লীগের অন্তত অর্ধশত নেতা। অভ্যন্তরীণ কোন্দল, আধিপত্য বিস্তার, চোরাচালানা ও টেন্ডার নিয়ে বিরোধের জের ধরে নিজ দলের সন্ত্রাসীদের হাতেই প্রাণ দিতে হয়েছে তাদের।

অধিকাংশ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় দলের লোকজন আসামি হওয়ায় বিচার হয়নি একটিরও। উল্টো খুনিদের রক্ষায় অনেক নেতা মরিয়া হয়ে ওঠেন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে পুরস্কৃত করা হয়েছে প্রধান আসামিকে।

২০০৯ সালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর জেলা-উপজেলা পর্যায়ে আওয়ামী লীগের প্রতিপক্ষ হয়ে উঠে আওয়ামী লীগ। যার জের ধরে খুন হয়েছে আওয়ামী লীগের গুরুত্বপূর্ণ পদের অন্তত ৫০ নেতা। এরমধ্যে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান, ছাত্রলীগ, যুবলীগ, তরুণ লীগের নেতা রয়েছেন। সর্বশেষ খুন হয়েছেন যশোর সদর উপজেলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক আলমগীর হোসেন।

গত ২৫ মে রাতে শহরতলীর রাজারহাট চামড়ার বাজারে যশোর সদর আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি খালেদুর রহমান টিটোর অনুসারীরা সদর উপজেলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক আলমগীর হোসেনের ওপর গুলি ও বোমা হামলা চালায়। চিকিৎসাধীন অবস্থায় ২৪ দির পর যুবলীগ নেতা মারা যান। তবে হামলার রাতেই তিনি এসপি আনিছুর রহমানের উপস্থিতিতে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট লিয়াকত আলী শেখের কাছে হামলাকারীদের বিষয়ে জবানবন্দি দেন।

২০১৪ সালের ১৫ জানুয়ারি রাত ৮ টার দিকে শহরের ঘোপ বেলতলা এলাকায় সন্ত্রাসীদের গুলি ও বোমা হামলায় নিহত হন যশোর শহর যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক রফিকুল ইসলাম শিপন। এ মামলায় জেলা ছাত্রলীগের সহসভাপতি ফয়সাল খানসহ আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে জড়িতরা আসামি হয়েছেন।

২০১৩ সালের ২৫ ডিসেম্বর রাতে খুন হয়েছেন জেলার ঝিকরগাছা উপজেলার গদখালী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি রবিউল ইসলাম। এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় যে সাত জনের নাম উল্লেখ করে মামলা করা হয়েছে তারা সবাই আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত এবং খুনিদের রক্ষায় স্থানীয় শীর্ষ জনপ্রতিনিধি উঠেপড়ে লেগেছে বলে নিহতের স্বজনরা অভিযোগ করেছেন।

২০১৩ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর চৌগাছার সিংহঝুলি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি জিল্লুর রহমান মিন্টুকে দিনে দুপুরে সন্ত্রাসীরা হত্যা করে। এঘটনাও দলের চিহ্ণিত সন্ত্রাসীদের নামে মামলা করা হয়েছে।

২০১৩ সালের ২৪ মার্চ ছেলের সামনে দলীয় সন্ত্রাসীদের হাতে খুন হন বেনাপোলের আওয়ামী লীগ নেতা ও পুটখালী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আব্দুর রাজ্জাক। এ মামলায় ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি আব্দুল গফফারসহ ১০ জন নেতাকর্মীর নামে মামলা করা হয়। স্থানীয় এক জনপ্রতিনিধি দলের লোকের নামে মামলা করতে আপত্তি জানালে হত্যাকাণ্ডের প্রায় এক সপ্তাহ পর সে সময়ের পুলিশ সুপারের নির্দেশে মামলা রেকর্ডভুক্ত হয়। শুধু তাই নয় পুটখালী ইউনিয়ন পরিষদ উপ নির্বাচনে মামলার এক নম্বর আসামি আব্দুল গফফারকে দল থেকে মনোনয়ন দিয়ে চেয়ারম্যান নির্বাচিত করে পুরস্কৃত করা হয়। এভাবেই হত্যা মামলাটি হত্যা করা হচ্ছে বলে নিহতের স্বজনদের অভিযোগ।

২০১২ সালের ২২ জুন খুন হয় যশোর শহরতলীর রামনগর ইউনিয়ন স্বেচ্ছাসেবক লীগের সহসভাপতি ইদ্রিস আলী। এ হত্যাকাণ্ডের বিষয়েও দলীয় প্রতিপক্ষের দিকে সন্দেহের তীর রয়েছে।

২০১১ সালের ২৯ আগস্ট মনিরামপুরে উপজেলা আওয়ামী লীগের কৃষি বিষয়ক সম্পাদক আবু আব্দুল্লাহ সন্ত্রাসীদের হাতে নিহত হন। এ হত্যার ঘটনায় এজাহারভুক্ত পাঁচ আসামির মধ্যে চার জনই স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী। ফলে আসামিরা জামিন নিয়ে এলাকায় প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। এ হত্যার বিচার নিয়েও সংশয় দেখা দিয়েছে।

পুলিশ সূত্রমতে, ২০১০ সালে ১৩ মার্চ জেলা ছাত্রলীগের সম্মেলন পণ্ড হলে পরদিন ১৪ মার্চ যশোর সদর উপজেলা ছাত্রলীগের আহ্বায়ক রিপন হোসেন দাদা দলীয় সন্ত্রাসীদের হাতে নৃশংসভাবে খুন হন। এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় নিহতের বাবা শহিদুল ইসলাম কোতোয়ালি থানায় যাদের নামে মামলা করেন তারা সবাই আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। গত চার বছরেও এ হত্যাকাণ্ডের বিচার না হওয়ায় নিহতের স্বজনরা ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।

২০১০ সালের ১৬ মে খুন হন শার্শা উপজেলা যুবলীগের ত্রাণ ও সমাজসেবা বিষয়ক সম্পাদক কামরুজ্জামান রতন। এ হত্যার ঘটনায় নিহতের ভাই জাহাঙ্গীর হোসেন বাদী হয়ে ডিহি ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি আব্দুল খালেককে এক নম্বর আসামি করে ৮ জনের নামে মামলা করেন। কিন্তু আসামিরা সবাই আওয়ামী লীগের রাজনীতি করায় আসামিদের রক্ষা করতে স্থানীয় এক জনপ্রতিনিধি পুলিশকে প্রভাবিত করে চলেছেন বলে স্বজনরা অভিযোগ করেন।

চৌগাছা উপজেলা আওয়ামীলীগ আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও পাশাপোল ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান ইমামুল হাসান টুটুলকে উপজেলা আওয়ামী লীগ কার্যালয়ের সামনে বোমা হামলা ও গুলি করে হত্যা করা হয়। এমামলার উপজেলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক দেবাশীষ মিশ্র জয়সহ দলীয় নেতাকর্মীরা আসামি হয়েছেন। এ হত্যাকাণ্ডের বিচার নিয়ে বিভিন্ন সময় সাংবাদিকদের কাছে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন নিহতের স্ত্রী উপজেলা মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান আকলিমা টুটুল।

যশোর জেলা তরুণ লীগের যুগ্ম আহ্বায়ক কামরুজ্জামান রিপন ওরফে বাঁশি রিপন হত্যা মামলারও একই অবস্থা। আধিপত্য বিস্তার নিয়ে দলীয় সন্ত্রাসীদের হাতে খুন হওয়ায় এ মামলাটির এখনও কুলকিনারা হয়নি।

এছাড়া আরও হত্যার শিকার হয়েছেন চৌগাছার সিংহঝুলি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি জিল্লুর রহমান মিন্টু, মনিরামপুরের হরিদাসকাটি ইউনিয়নের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান আওয়ামী লীগ নেতা প্রকাশ দত্ত, অভয়নগরে আওয়ামী লীগ নেতা রাজু আহম্মদ, শার্শার জামতলা এলাকার যুবলীগ নেতা মজু, শার্শার পুটখালী ইউনিয়ন যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল খালেক ও যুবলীগ নেতা নজরুল ইসলাম বাবু, লক্ষণপুরের যুবলীগ নেতা আরব আলী, শার্শার ডিহি ইউনিয়ন যুবলীগের সহসভাপতি ও স্থানীয় সাংবাদিক জামাল হোসেন, বাঘারপাড়ায় পুলেরহাট বাজারে আওয়ামী লীগ নেতা বাছের, যশোর শহরের পুরাতন কসবা কাজীপাড়ায় যুবলীগ কর্মী জাফর, তরিকুল ইসলাম ও রুহুল আমীন, শহরতলীর খোলাডাঙ্গায় যুবলীগ কর্মী মনিরুল, যশোর সদরের সাজিয়ালী গ্রামের আওয়ামী লীগ কর্মী শফিকুল ইসলাম, দোগাছিয়া গ্রামের যুবলীগ কর্মী মনিরুজ্জামান পিকুল, কেশবপুরের ত্রিমোহিনী ইউনিয়ন যুবলীগের সহসভাপতি আব্দুল্লাহ ওরফে বাবু।

এসব হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় দলীয় নেতাকর্মীরা জড়িত থাকায় বিচার নিয়ে সংশয়ে রয়েছেন বাদী ও স্বজনরা।

যশোর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আলী রেজা রাজু বলেন, ‘রাজনীতিশূন্যতা ও রাজনীতিস্থবিরতার কারণে আমাদের শত্রুদের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষরা সাহস বাড়িয়ে দিচ্ছে। তারাই আমাদের লোকজনের খুন করার মতো সাহস জোগাচ্ছে।’

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন ‘খালেদুর রহমান টিটো আওয়ামী লীগের লোক না, তার লোকজন খুন করলে আওয়ামী লীগ খুন করেছে বলা যাবে না।’

প্রসঙ্গত, খালেদুর রহমান টিটো ২০০৮ সালের নির্বাচনে নৌকা প্রতীক নিয়ে আওয়ামী লীগ থেকে যশোর-৩ আসনে নির্বাচন করে এমপি নির্বাচিত হন। এরপর থেকেই জেলা আওয়ামী লীগের সাথে তার দুরত্ব বাড়ে। ১৮ জুন নিহত সদর উপজেলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক আলমগীর হোসেনের খুনিরা তার লোক বলে পুলিশ নিশ্চিত হয়েছে।

আলী রেজা রাজু আরও বলেন, যুবলীগ নেতা শিপন হত্যাকাণ্ড পরিকল্পিত এবং ছাত্রলীগ নেতা দাদা রিপনকে খুনিদের শায়েস্ত করতে বলা হয়েছিল। ফলে যা হওয়ার তাই হয়েছে।

এদিকে আসামি গ্রেপ্তার নিয়ে বাদীদের অভিযোগ উল্লেখ করলে যশোরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার কেএম আরিফুল হক বলেন, মামলার বাদীরা অনেক কিছুই বলেন। কিন্তু পুলিশ খুনিদের আটকের জন্য অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে। আসমি যে দলেরই হোক তাদের গ্রেপ্তার করা হয়।