শনিবার , ২১শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ , ৬ই আশ্বিন, ১৪৩১ , ১৭ই রবিউল আউয়াল, ১৪৪৬

হোম > গ্যালারীর খবর > দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে ব্যয়বহুল শহর ঢাকা

দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে ব্যয়বহুল শহর ঢাকা

শেয়ার করুন

বাংলাভূমি২৪ ডেস্ক॥

কিছুদিন আগে একজন পোশাক ব্যবসায়ী কথাচ্ছলে বলছিলেন, ঢাকা হচ্ছে বিদেশিদের জন্য খুবই সস্তা শহর। ইউরোপীয় ক্রেতাদের প্রতিনিধিরা তাদের দেশে থাকে একটা কুঠুরিতে। ঢাকায় এসে তারা রাজকীয় হালে থাকে—তাদের আনন্দের সীমা নেই! আমাদের শ্রম সস্তা, আমাদের থাকা-খাওয়া সস্তা। তার এই বর্ণনা শুনতে শুনতে আমার খুবই ভাল লাগছিল। পাশে ছিলেন আরো কয়েকজন পোশাক ব্যবসায়ী। তারাও তাল দিচ্ছিলেন। যেহেতু তারা প্রতিদিন ‘বায়ারদের’ প্রতিনিধিদের দেখভাল করছেন, প্রতিদিন তাদের সাথে চলাফেরা করছেন, কাজেই তাদের কথা বিশ্বাস করা ছাড়া আমার উপায় ছিল না। বলা যায়, এই ধারণাতেই আমি ছিলাম যে ঢাকা একটি সস্তা শহর। কিন্তু এখন খবর দেখি ঠিক উল্টো। উল্টো নয়, একদম রাত আর দিন, উত্তর মেরু আর দক্ষিণ মেরু।

গত শুক্রবার একটি দৈনিকে একটি চমকপ্রদ খবর ছাপা হয়েছে। এর শিরোনাম: ‘বিদেশিদের জন্য ঢাকা হচ্ছে দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে ব্যয়বহুল শহর’। খবরটি একটি সার্ভে বা জরিপের উপর ভিত্তি করে তৈরি রিপোর্টের উপর। জরিপটি করেছে ‘আমেরিকান হিউম্যান রিসোর্স কনসালটেন্সি ফার্ম।’ জুলাই মাসের ১০ তারিখে এটা প্রকাশিত হয়েছে। নিউইয়র্ক শহরসহ বিশ্বের ২১১টি দেশে এই জরিপটি করা হয়েছে। জরিপকারীরা সর্বমোট ২০০টি পণ্য সেবার মূল্যের উপর ভিত্তি করে তাদের রিপোর্টটি তৈরি করেছে। এখন একটা জরিপে বলা হচ্ছে, ঢাকা হচ্ছে দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে ব্যয়বহুল শহর। কোথায় করাচী, ইসলামাবাদ, কোথায় মুম্বাই, নিউ দিল্লি—সব এখন ঢাকা শহরের কাছে ধরাশায়ী। কলকাতা, ব্যাঙ্গালুর, চেন্নাই (মাদ্রাজ) বহু দূরে। এমনকী এক সময়ের দামি কলম্বো শহরও। তাই বলে কী জাকার্তা, ম্যানিলা, হ্যানয় এবং হোচিমিন সিটি আমাদের ঢাকা শহরের চেয়ে বেশি ব্যয়বহুল? না, তাও নয়।
সকলকে টেক্কা দিয়ে ঢাকা শহর এখন দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে দামি, ব্যয়বহুল শহর। অথচ ২০১৩ সালেও তা ছিল না। বলা বাহুল্য, যে জরিপটিতে এ কথা বলা হচ্ছে তা তৈরি করা হয়েছে জীবনযাত্রার ব্যয়ের (কস্ট অব লিভিং) ভিত্তিতে।উপরিউক্ত খবরটির তাত্পর্য কী? দৃশ্যত বেশ আনন্দের সংবাদ। ঢাকা শহর সবচেয়ে ব্যয়বহুল। সেই শহরের বাসিন্দা আমরা! এটা খবর হিসাবে খারাপ কী? সাদামাটা চোখে এটি একটি নির্দোষ সংবাদ। সত্যিই কী তাই? নাকি এর ভেতরে লুকিয়ে আছে আশঙ্কাজনক কোন ইঙ্গিত? ব্যয়বহুল শহর মানে কী ব্যয়বহুল (কস্টাল) অর্থনীতি? ব্যয়বহুল অর্থনীতির বোঝা কী মানুষ টানতে পারছে? যে বিদেশিরা এক ডলার ভাঙ্গিয়ে ৮০ টাকা পায় এবং সেই ৮০ টাকা দিয়ে ঢাকায় বাজার করে, নাস্তা খায়, ‘লাঞ্চ’ করে, ‘ডিনার’ করে, চুল কাটে, ট্যাক্সিতে চড়ে, জামা-কাপড় কিনে, বাড়ি ভাড়া দেয়, কাঁচা বাজার করে, তারাই যদি বলে ঢাকার বাজার ব্যয়বহুল, তাহলে যাদের ১০ টাকার রোজগার মানে ১০ টাকাই (কারণ এটাই স্থানীয় মুদ্রা) তাদের কাছে ঢাকার বাজার কী? উত্তরটা খুবই সোজা। একটা ডলার মানে ৮০ টাকা, আর আমার এক টাকা মানে এক টাকা। এমতাবস্থায় বিদেশিদের কাছে যদি ঢাকা শহর ব্যয়বহুল হয় তাহলে স্থানীয়দের কাছে ঢাকা শহর অসহনীয় হয় না কি? এ রকম ডজন ডজন ডাল-পালা বর্তমান খবরের।
যে ২০০টি পণ্য ও সেবার ব্যয়ের উপর ভিত্তি করে জরিপটি তৈরি করা হয়েছে তার মধ্যে আছে বাড়ি ভাড়া, পরিবহন, যাতায়াত, খাদ্যদ্রব্য, জামাকাপড়, গৃহস্থালী দ্রব্যাদি এবং বিনোদন ইত্যাদি। বলা হচ্ছে এসবই ব্যয়বহুল। আরেকটা কারণ বলা হচ্ছে টাকার দাম। টাকার দাম ডলারের তুলনায় শক্তিশালী। বাজারে ডলারের ক্রেতা নেই। যেই ডলার দুই বছর আগে ৮৩, ৮৪ এমনকী ৮৫ টাকায় বিক্রি হতো, এখন তা ৭৮-৭৯ টাকায় বিক্রি হয়। জরিপের উপর ভিত্তি করে যে স্টোরিটি একটি দৈনিকে ছাপা হয়েছে তাতে দেখা যাচ্ছে, গত এক বছরে বিদেশিদের ঢাকাস্থ ক্রয় ক্ষমতা প্রধানত হরাস পেয়েছে দুটো খাতে। প্রথমত তারা ডলারের বিনিময় মূল্য পাচ্ছেন কম, দ্বিতীয়ত বাড়ি ভাড়া বৃদ্ধি পেয়েছে অনেক বেশি হারে। দৃশ্যত মনে হচ্ছে ডলারের মূল্যমানই প্রধান আসামি।
পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে ডলারের সরবরাহ যথেষ্ট। বিপরীতে ক্রেতা কম। বাংলাদেশ ব্যাংক সামনের ঈদকে উপলক্ষ করে বাজার থেকে ডলার কিনবে। কারণ তারা আশা করছে ঈদ উপলক্ষে প্রচুর ‘রেমিটেন্স’ দেশে আসবে। এছাড়া প্রায় নিয়মিতভাবেই বাংলাদেশ ব্যাংক বাজার থেকে ডলার ক্রয় করছে। এদিকে ব্যাংকগুলোতে ঋণ সংকোচননীতি পালিত হচ্ছে। সরকারি ব্যাংকগুলো ৮-১০ শতাংশের বেশি ঋণ বাড়াতে পারছে না। এর অর্থ ঋণ বাড়ছে না। কারণ ৮-১০ শতাংশ ঋণ ‘সুদের’ কারণেই বাড়ে। এর অর্থ ব্যাংকঋণ যেখানে আছে সেখানেই থাকছে। বড় বড় ব্যবসায়ীদেরকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিদেশ থেকে ঋণ করার অনুমতি দিচ্ছে। ইতিমধ্যেই সব কোম্পানি মিলে প্রায় ২৫-৩০ হাজার কোটি টাকা ঋণ করেছে। বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর ডলার বাংলাদেশ ব্যাংক নিচ্ছে, অথচ তাদেরকে সমপরিমাণ টাকা দিচ্ছে না। ডলারে খরচ বৃদ্ধির জন্য পর্যটকদের কোটা বৃদ্ধি করা হয়েছে উল্লেখযোগ্য হারে। ‘সার্ক’ অঞ্চলের জন্য এবং সার্ক বহির্ভূত অঞ্চলে বেড়ানোর জন্য ডলারের কোটা ৫০ থেকে ১০০ ভাগ বাড়ানো হয়েছে। ব্যবসা-বাণিজ্যে মন্দা। এর ফলে দেখা যাচ্ছে ডলারে ডলারে বাজার এখন সয়লাব। এতে ডলারের দাম পড়ে গেছে।
ডলারের দাম পড়লে বাংলাদেশের ক্রেতাদের লাভ। কারণ আমরা আমদানিনির্ভর দেশ। আমদানিকৃত পণ্যের মূল্য হরাস পায়, নিদেনপক্ষে স্থিতিশীল থাকে যদি ডলারের মূল্য বৃদ্ধি না পায়। এটা আমাদের লাভের দিক। কিন্তু যারা বিদেশি পর্যটক তারা ঢাকায় ক্ষতিগ্রস্ত। তারা আগে এক ডলার ভাঙ্গিয়ে ৮৪ টাকা পেত, এখন পায় ৭৮-৭৯ টাকা। অথচ অভ্যন্তরীণ বাজারে তাদেরকে সবকিছুই বেশি দামে কিনতে হয়, দেশীয় ক্রেতাদের মতই। অতএব বাংলাদেশে যত বিদেশি চাকরি করেন, যারা ডলারে বেতন পান তারা ডলারের দরপতনে ক্ষতিগ্রস্ত। দেশীয় বাজারে বাড়ি ভাড়া বেড়েছে-বাড়ছে। কাঁচা বাজারের খরচ বাড়ছে। বাড়ন্ত সবকিছুর মূল্যই। এই বর্ধিষ্ণু বাজারে বিদেশিরা যেমন ক্ষতিগ্রস্ত তেমনি দেশীয়রাও ক্ষতিগ্রস্ত। ডলারে বেতন পেলেও যা, টাকায় বেতন পেলেও তা। তবে ঢাকা দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে ব্যয়বহুল শহর এই খবরে আমাদের একটা ক্ষতি হবে। পর্যটকরা বাংলাদেশে আসতে নিরুত্সাহিত হবে। ডলারের মূল্য পতনের আরো দুটো দিক আছে। রপ্তানি ও রেমিটেন্স। আমাদের চিরায়ত ধারণা, ডলারের বিপরীতে টাকার দাম বাড়লে রপ্তানি ক্ষতিগ্রস্ত হবে, রেমিটেন্স ক্ষতিগ্রস্ত হবে। গত দুই বছরের অভিজ্ঞতা একটু ভিন্ন। ডলারের দাম টাকার বিপরীতে কমলেও, ভিন্ন অর্থে টাকার দাম বাড়লেও রেমিটেন্স কমেনি। রেমিটেন্স বৃদ্ধির হার কমেছে। সেটা কমেছে শ্রম রপ্তানি হরাস পাওয়ার ফলে, টাকার বিনিময় মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ার জন্য নয়। অন্তত দৃশ্যত এমন মনে হচ্ছে না। আবার রপ্তানিও ক্ষতিগ্রস্ত নয়। রপ্তানি টাকার মূল্য বৃদ্ধি সত্ত্বেও বাড়ছে। কাজেই টাকার মূল্য বাড়লে রপ্তানি ও রেমিটেন্স হরাস পাবে অথবা ক্ষতিগ্রস্ত হবে এমন ধারণার শক্ত কোন ভিত্তি পাওয়া যাচ্ছে না। মোট কথা, টাকার বিনিময় হার নিয়ে আমরা বেশ ক্রান্তিকালে আছি। টাকার বিনিময় হারের কারণে ঢাকা শহর হয়ে যাচ্ছে দক্ষিণ এশিয়ার ব্যয়বহুল শহর, বাজার হয়ে যাচ্ছে ডলারে ডলারে সয়লাব। এসব ঘটনা নতুন নতুন ঘটনা। অত্যন্ত তীক্ষভাবে এই বাজার পর্যবেক্ষণে রাখা দরকার।
ব্যয়বহুল শহরের আরেক কারণ হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে বাড়ি ভাড়াকে। বাড়ি ভাড়া ঢাকা শহরে অত্যধিক একথা আলোচনার অপেক্ষা রাখে না। এর অন্যতম প্রধান কারণ জমির মূল্য। জমির মূল্য বেশি, অতএব ফ্ল্যাটের দাম বেশি, বাড়ি তৈরির খরচ বেশি। অতএব বাড়ি ভাড়া বেশি। জমির মূল্য বাদেও অন্যান্য কারণ আছে। শুধু জমির মূল্যের দিকে তাকালে দেখা যায়, গত বছরখানেকের মধ্যে জমির মূল্য বেশকিছুটা কমেছে। হাজার হাজার ফ্ল্যাট অবিক্রীত। দাম বেশি। দেখা যাচ্ছে লালমাটিয়া, ধানমন্ডি, বনানী, গুলশান ও বারিধারায় এখনও এক কাঠা জমির দাম ২ কোটি টাকা থেকে ৫ কোটি টাকা। খবরের কাগজের রিপোর্ট অনুযায়ী এই মূল্যস্তর জমির দাম কমার পর। এবার বুঝুন অবস্থা!
এই টাকায় জমি কিনে তার উপর ফ্ল্যাট বানিয়ে বিক্রি করলে এর দাম যা পড়ে তা কিনবে কে? মধ্যবিত্ত চাকরিজীবী? ব্যাংকার, বীমাবিদ? সরকারি চাকরিজীবী? বহুজাতিক সংস্থার অফিসাররা? কোন হিসাবে তা মিলানো যাবে না। দেড় কোটি দুই কোটি টাকা দিয়ে ফ্ল্যাট কেনা! ক্রেতার অভাব কেন, তাই বুঝতে অসুবিধা হয় না। মজার দেশ, ক্রেতা নেই তবু দাম কমে না। অন্য দেশ হলে নির্মাতারা অর্ধেক দামে বিক্রি করে মুক্তি পেতে চাইতো। কিন্তু আমাদের দেশে তা নয়। পরিশেষে বলা দরকার জমির দাম, ফ্ল্যাটের দাম, সহায়-সম্পদের দাম, জিনিসপত্রের দাম— সবকিছুর দামের নিরিখেই ঢাকা তথা বাংলাদেশ ব্যয়বহুল (কস্টলি) একটা দেশ। ঢাকাবাসীর জন্য ব্যয়বহুল বলেই ব্যয়বহুল বিদেশিদের জন্যও। ব্যয়বহুল ঢাকা, ব্যয়বহুল অর্থনীতি। এই কস্টাল অর্থনীতিতে মানুষ বাস করতে পারতো যদি মানুষের আয় সমানভাবে বাড়ত। আয় ও ব্যয়ের পার্থক্য সব সময়ই বাড়ছে। এই পার্থক্য দূর হওয়ার কোন কারণ এখন আর দেখি না। বিদেশি যারা টাকার ডলারে বেতন পান তাদের ওষুধ একটাই—তাদের নিয়োগকর্তারা যদি বেতন-ভাতাটা বাড়িয়ে দেন! কিন্তু ঢাকাবাসীর ওষুধ কী? সরকার কী তা করবে, বেসরকারি মালিকরা কী তা করবে? দিল্লী দূরান্ত!