রবিবার , ২২শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ , ৭ই আশ্বিন, ১৪৩১ , ১৮ই রবিউল আউয়াল, ১৪৪৬

হোম > Uncategorized > তুমি আসবে বলে

তুমি আসবে বলে

শেয়ার করুন

বাংলাভূমি২৪ ডেস্ক ॥ ছোট বেলা থেকে নানীর মুখে শুনে আসছে একদিন এক রাজপুত্তর পঙ্খীরাজ ঘোড়ায় চেপে আসবে আর নিয়ে যাবে আকাশে উড়িয়ে। প্রেম,পুরুষ কিংবা সংসার বাঙ্গালী বাকি দশটা নারীর মত এই ছকেই জীবনটাকে বাধতে চেয়েছিল টুশি। চারপাশটা একবার দেখুন। টুশি কিংবা অমৃতা অথবা রিয়া একই বৃত্তে বন্ধি সবাই ইট পাথরের শহরে। সম্পর্কের আবডালে এই বন্ধির সাথে যেন গড়ে তোলা সন্ধি।

টুশি এখন ফিলোজফি নিয়ে বিদেশে গবেষণায় ব্যস্ত।

সবাই বলত, পরিবারের বাকিদের যখন বিয়ে হতে পেরেছে তাহলে ওর-ও জুটে যাবে। ছোটবেলা থেকেই টুশি শুনে আসছে  সে কালো, মোটা। গায়ের রং সব চাচতো ফুফতো বোনেদের চেয়ে কালো। আর এত কিছুর পরেও ডিম, মাখন, চিনি সব খেয়ে যেত টুশি, আজও খায়।

গার্লস্কুলের ক্যাপ্টেন গার্ল, পড়াশোনায় ভাল টুশিকে একটাই প্রশ্ন জ্বালিয়ে যেত- ‘আমার দিকে কোনও ছেলে তাকাবে না’? টুশির-র মন সেই অল্প বয়স থেকেই খুঁজে চলেছে সেই পুরুষকে, যার সঙ্গে আর পাঁচটা মেয়ের মতোই সে ঘর বাঁধতে চায়। খারাপ দেখতে মেয়ের শরীর তাড়া করে বেড়াত টুশিকে, রাগ হত শরীরটার ওপর। চাকরি করা মা শিখিয়েছিল টুশি যেন কোনও সময় কোনও ‘খারাপ’ কাজ না করে, ভাল মেয়ে হয়ে চলে। কারণ তার ‘খারাপ’ হওয়ার দায় বর্তাবে মেয়েকে ফেলে চাকরি করতে যাওয়া, বাইরে পা দেওয়া মা-এর ওপরেই।‘খারাপ’, ‘ভাল’, ‘মোটা’, ‘কালো’ ঘুরতে থাকে টুশির মাথায়, সেই নিয়ে পথ চলা।

বই, খাতা, স্কুল, বাড়ি-র ‘ভাল’ জীবনের বাইরেও টুশির একটু একটু করে তৈরি হওয়া শরীর যদিও মা-এর ‘ভাল’ মেয়ের শাসন টপকাতে চাইত।

স্কুলে শালিনীর বন্ধু রিয়াদ হেসে হেসে কথা বলতেই মনে হল ও বুঝি আমারই জন্যে স্কুলের গেটে অপোয়, ‘শার্টের প্রথম বাটনটা খুলে রাখতাম’। জানাল টুশি। পরে টুশি জানতে পারে শালিনীই ছিল ওর প্রেমিকা।

টুশি স্কুল পেরোলো কলেজে  এসে আলাপ শেখরের সাথে । টুশির দূসর্ম্পকের আতœীয় শেখর তখন ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে।

একদিন পাশের বাড়ির ল্যান্ডলাইন ফোনে শেখরের ফোন।

এরপর থেকে স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার পথে এক রাস্তায় চলতো টুশি আর শেখর। উফ! সে কী উত্তেজনা, এক ভেলপুরির ঠোঙায় আঙুলের ছোঁয়া। শেখর ভাবেনি কোনওদিন কনভেন্ট ব্যাকগ্রাউন্ডের শহুরে মেয়েকে সে কাছে টানতে পারবে। কলেজেও চলল প্রেম। হাতে হাত, ঝোপঝাড়। মনের ইচেছ আর শরীরকে সেদিন মেলাতে পারেনি টুশি। পুরুষ তো পেলো কিন্তু কালো শরীরের ভিতর দেখে যদি কেউ ফিরে যায়? তাই শেখরের সঙ্গেও কেবল একটুকু ছোঁয়ার প্রেম ছিল।

আই টি ওয়ার্ল্ড-এ এক্সপোজার পাওয়া শেখর একদিন টুশিকে বলল তোমায় রোগা হতে, কম খেতে। তাকে নাকি ওর দিদি মনে হয়। সবটাই যেন টুশির গড়নের দোষ! জিম জয়েন করলো টুশি। এতেও শেখরের মন ভরল না।

‘‘একবারই ওর বাড়িতে আই জাস্ট হ্যাড টু পারফর্ম! উই নেভার এনজয় সেক্স।’’এভাবেই লাইনের পর লাইনে ডায়রির পাতা ভরছিল টুশির।

এরি মাঝে কলেজের অনিরুদ্ধ আর টুশি প্রায়-ই ছবি তোলার নেশায় প্রথম ভোরের শহরে সকালে পথ ঘুরেছে।

‘‘মন ঘুরছে আমার ওর দিকে, কিছুটা ওর স্পর্শেও। বন্ধু… ওর শরীর খারাপ, স্পেশাল পেপারের নোট- সব তখন আমার দায়িত্বে। কীরকম ‘মা’ টাইপ কেয়ারিং। আসলে পুরুষ আমায় চাইছে ভাবলেই তার সব দায়িত্ব নিজে তুলে নিতাম। ব্যাস! ইমোশনাল ড্রেনিং চলতেই থাকত। সব গুলিয়ে যাচ্ছিল, অনিরুদ্ধর ঘাড়ে মাথা দিয়ে শেখরের পদোন্নতির কথা ভাবতাম। আর শেখরের কাছেও অনিরুদ্ধর গল্প। কিন্তু আমার কথা কেউ মনে রাখল না। শেখরের সঙ্গে বিয়ের দিনও ঠিক হল, কিন্তু ঠিক একমাস আগে ও নিজেই সব শেষ করে দিল। আর অনিরুদ্ধ-ও চাকরি পেয়ে ভুলে গেল আমায়। দম বন্ধ হয়ে আসছিল। দেশ ছাড়লাম।’’

টুশি এখন ফিলোজফি নিয়ে বিদেশে গবেষণায় ব্যস্ত।

বিদেশের মাটিতে অন্য জগৎ এখন টুশির। স্কলারশিপ নিয়ে চলে গেল টুশি। ম্যাকের সঙ্গে কয়েকদিনের আলাপ।

‘‘স্নো ফলের টানা চারদিনের বন্দি শহরে ম্যাকের শরীরে প্রথম আমার শরীর মন ছড়িয়ে দিল। শেখরের সঙ্গে রোম্যান্স ছিল শরীর ছিল না আর ম্যাকের কাছে জানলাম শরীর খেলা। শুধুই খেলা। ম্যাক চলে গেল পড়তে, জানতাম-ই ও যাবে। খুব একটা কিছু মনে হয়নি।  পড়াশোনা চলতে লাগল জোরকদমে। সব-ই ঠিক। কিন্তু বিয়ের কী হবে? আসলে আমিও তো চাই, পুরুষ, সংসার- আমাকেও কোথাও প্রুফ করতে হবে আমিও পারি।’’

অনলাইনে সৌরভের সঙ্গে যোগাযোগ টুশির।

‘‘ব্রিলিয়ান্ট কেরিয়ার। আমার ছবি দেখে পছন্দ করল। অবাক হলাম। বিয়ের জন্যে তখন আমি পাগল। তিন চার মাসের ফোনালাপে সৌরভ বলল আমরা বিয়ে করব। আমাকে না দেখেই ও বলেছিল। দেখা উন্মুখ, ম্যাকের কাছে শেখা  শরীর জ্বালান গন্ধ নিয়ে তখন কাঁপছে আমার মন। সৌরভ পারল না… মাঝ পথেই খেলার ময়দান ছেড়ে ল্যাপটপ জড়িয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। স্তব্ধ রাতে আমি একা।’’

পরের দিন সৌরভের নার্ভাস ব্রেকডাউন। টুশি জানতে পারলো সৌরভ স্কিৎজোফ্রেনিক রোগী। অবাস্তব চরিত্র গড়ে তাদের সঙ্গে একটানা কথা বলে চলে। অজানা লোকের শব্দ নিয়ে ওর মন খেলে। সৌরভের বাবা শিতি নার্সের জন্যে বিয়ে দিচ্ছিলেন!

টুশি পারেনি সৌরভকে ছাড়তে। ওর ওষুধ, ডাক্তার, পড়াশোনা, খেয়াল রাখা, আবার কেয়ারিং মাদার-এর রোল-এ!

‘‘সৌরভ ভালবাসত আমায়। আমায় মুক্তি দেওয়ার জন্যে একদিন ‘হি শ্যুট হিমসেল্ফ’!’’  ঢোক গিলল টুশি।

টুশি এখনও ওর সংসারী পুরুষের অপোয়। ওর ডায়েট শরীরে বিদেশি ফেস পাউডারের রং। লম্বা চুল ছড়িয়ে সরবতের ট্রে হাতে হয়তো হবু শ্বশুরবাড়ির লোকদের আপ্যায়ন করছে এখনো।

টুশির ডায়রির পাতায় এখনো একটি লাইন একই সমান্তরালে লেখা হয়- ‘তুমি আসবে বলে’।