শনিবার , ২১শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ , ৬ই আশ্বিন, ১৪৩১ , ১৭ই রবিউল আউয়াল, ১৪৪৬

হোম > Uncategorized > ঢাকার নদী দখল ও দূষণে ১০৯৩ শিল্পকারখানা চিহ্নিত

ঢাকার নদী দখল ও দূষণে ১০৯৩ শিল্পকারখানা চিহ্নিত

শেয়ার করুন

বাংলাভূমি২৪ ডেস্ক ॥ বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, বালু ও তুরাগ নদ দূষণ এবং দখল করেছে এক হাজার ৯৩ শিল্প-কারখানা। এসব কারখানা থেকে প্রতিদিন লাখ লাখ টন শিল্পবর্জ্য, ক্ষতিকর রাসায়নিক দ্রব্য, ট্যানারি বর্জ্য, পয়ঃনিষ্কাশন ও গৃহস্থালি বর্জ্য, ডকইয়ার্ডের লোহার মরিচা, সিমেন্ট-বালুমিশ্রিত পানি, পোড়া তেল-মবিল নদীতে ফেলার তথ্য-প্রমাণ পাওয়া গেছে। ঢাকার নদী দখল ও দূষণে ১০৯৩ শিল্পকারখানা চিহ্নিত

ইনস্টিটিউশন অব ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স, বাংলাদেশ (আইডিইবি) এ ব্যাপারে গত বুধবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে দূষণকারী কারখানার তালিকাসহ একটি প্রতিবেদন হস্তান্তর করেছে। এতে নদী দূষণকারী প্রতিষ্ঠান চিহ্নিতকরণ ও দূষণ রোধ করে পানির প্রবাহ বাড়াতে ১৩ দফা সুপারিশ করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে এই সুপারিশ তৈরি করেছে আইডিইবির ‘স্টাডি অ্যান্ড রিসার্চ সেল’। সুপারিশে দূষণ, দখল, ভরাট, নদীর প্রবাহহীনতা ও উৎসমুখ বন্ধ হওয়াকে ঢাকার চারপাশের নদীর মূল সমস্যা হিসেবে দেখানো হয়েছে। দূষণকারী শিল্প-কারখানার মধ্যে ট্যানারিশিল্প ৩০০টি, গার্মেন্টশিল্প ৫০০টি, ওষুধশিল্প ১২৫টি ও অন্যান্য শিল্প প্রতিষ্ঠান ১৬৮টি।

নৌমন্ত্রী শাজাহান খান নদী দূষণ রোধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছেন। তিনি সমকালকে বলেছেন, ঢাকা ওয়াসা ও বড় বড় প্রতিষ্ঠান নদী দূষণ করছে। অনেক শিল্প-কারখানা সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও ইটিপি স্থাপন না করে সরাসরি নদীতে বর্জ্য ফেলছে। অনেক শিল্প প্রতিষ্ঠান ইটিপি থাকা সত্ত্বেও ব্যবহার করছে না।

আইডিইবির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঢাকার চার নদী শীতলক্ষ্যা, তুরাগ, বালু ও বুড়িগঙ্গার অবস্থা শোচনীয়। নদীর তীরে গড়ে ওঠা প্রভাবশালীদের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানগুলো প্রতিনিয়ত দূষণের মাত্রা বাড়িয়ে তুলছে। নদী ব্যবহৃত হচ্ছে আবর্জনার ভাগাড় হিসেবে। অবাধে বর্জ্য ফেলতে পাকা ড্রেন, পাইপ ও সারফেস ড্রেন পর্যন্ত তৈরি করা হয়েছে। আরও কয়েক হাজার ব্যক্তি চোরা পাইপ ও উন্মুক্তভাবে নদী দূষণ করছে। ফলে পানির রঙ পরিবর্তন হয়ে কোথাও কালো, কোথাও লাল-নীল আকার ধারণ করেছে। পানি থেকে দুর্গন্ধ বের হচ্ছে। দূষণের মাত্রা এতই ভয়াবহ যে, শুষ্ক মৌসুমে বুড়িগঙ্গা ও তুরাগ নদের অক্সিজেনের মাত্রা শূন্যের কোঠায় পৌঁছায়।

চার নদী দূষণের ৩০০টি উৎস চিহ্নিত করেছে আইডিইবি। এতে দূষণের তালিকায় ঠাঁই পেয়েছে ঢাকা ওয়াসা, হাসপাতালসহ বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠান, ব্যক্তিমালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান, ট্যানারি, সিমেন্ট কারখানা, ডকইয়ার্ড, গার্মেন্ট কারখানা ও ঢাকার দুই সিটি কপোরেশন। এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক তাকসিম এ খান সমকালকে জানান, নদী দূষণের ৬০ শতাংশ ঘটছে শিল্পবর্জ্যে। এর মধ্যে ঢাকা সিটি করপোরেশনের মাধ্যমে ১৫ শতাংশ, ঢাকা ওয়াসার স্টর্ম ড্রেনেজ লাইন থেকে অবৈধভাবে স্যুয়ারেজ সংযোগ দেওয়ায় ১৫ শতাংশ এবং অন্যান্য কারণে ১০ শতাংশ দূষণ হচ্ছে।

বুড়িগঙ্গাসহ ঢাকার চারপাশের নদীগুলো পুনরুদ্ধার এবং রাজধানীর চারপাশে বৃত্তাকার নদীপথ ও সড়কপথ চালু করার বিষয়ে গত ২৭ জুলাই প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে উচ্চপর্যায়ের সভা হয়েছে। সভায় প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব আবদুস সোবহান সিকদারকে সমন্বয়কারী করে ১৪ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে।

এ ব্যাপারে আবদুস সোবহান সিকদার জানান, গত সপ্তাহে ঢাকার চারপাশে ১১০ কিলোমিটার নৌপথ সরেজমিন পরিদর্শনকালে নদীর দুই তীরে নির্দিষ্ট স্থানে সীমানা পিলার স্থাপন করা হয়েছে বলে মনে হয়নি। নদীর কোনো কোনো স্থান অনেক প্রশস্ত, আবার কোনো কোনো স্থান খুবই সংকীর্ণ।

নদীর সীমানা নির্ধারণে হাইকোর্টের নির্দেশে সীমানা পিলার স্থাপন করছে স্থানীয় জেলা প্রশাসন। প্রভাবশালীদের চাপে শুষ্ক মৌসুমে সীমানা পিলার স্থাপন করা হয় বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এতে নদীর একটি অংশ দখল হয়ে যাচ্ছে। পানিসম্পদমন্ত্রী ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ সমকালকে বলেন, বুড়িগঙ্গাসহ ঢাকা মহানগরীর চারপাশের নদীর সীমানা চিহ্নিত করার ক্ষেত্রে সমস্যা রয়েছে, যা সিএস এবং আরএস জরিপের তথ্য প্রয়োগের মাধ্যমে সমাধান করা প্রয়োজন।

আইডিইবির প্রতিবেদন অনুযায়ী, বুড়িগঙ্গা দূষণ করছে দুই তীরে গড়ে ওঠা গার্মেন্টস, ডকইয়ার্ড, হাসপাতাল, লঞ্চ থেকে ফেলা বর্জ্য এবং পোড়া জ্বালানি তেল। সদরঘাট থেকে আশুলিয়া পর্যন্ত দূষণের উৎসমুখ ১০৭টি। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- গাবতলী গরুর হাট, আপেল এন্টারপ্রাইজ, বেস টেক লিমিটেড, শাহ সিমেন্ট, এনডিএ, পূর্বাশা কাঁচাবাজার, ট্যানারি, ঢাকা ওয়াসা ও মিটফোর্ড হাসপাতাল। সদরঘাট থেকে ফতুল্লা বিজি মাউথ পর্যন্ত ৫৭ উৎসমুখ চিহ্নিত করা হয়েছে। এর মধ্যে ঢাকা ওয়াসা ২২টি উৎসমুখ থেকে পানি ও বর্জ্য ফেলছে। শীতলক্ষ্যা নদীর সৈয়দপুর থেকে নারায়ণগঞ্জের মুড়াপাড়া পর্যন্ত ৭০টি উৎসমুখ থেকে বর্জ্য ফেলা হচ্ছে।

এর মধ্যে নারায়ণগঞ্জের নিতাইগঞ্জে এসডি ফ্লাওয়ার মিল, সৈয়দপুরে পূবালী সল্ট ইন্ডাস্ট্রিজ, পপুলার জুট এক্সচেঞ্জ, মুন্সীগঞ্জের মুক্তারপুরে প্রিমিয়াম সিমেন্ট, শাহ সিমেন্ট, মেট্রোপলিটন সিমেন্ট, লক্ষ্মীনারায়ণ কটন মিল, র‌্যাক্স নিটওয়্যার, অলরাউন্ড নিটওয়্যার, সোহাগপুর টেক্সটাইল মিলস, প্রীতম ফ্যাশন, ইব্রাহিম টেক্সটাইল, আদমজী ইপিজেড, স্টার পার্টিকেল বোর্ড, নিউ ঢাকা ইন্ডাস্ট্রিজ, কাঁচপুর ডাইং অ্যান্ড প্রিন্টিং, ডেমরার বেঙ্গল প্যাকেজেস ও মীর সিমেন্ট উল্লেখযোগ্য। এসব প্রতিষ্ঠান ড্রেন ও পাইপের মাধ্যমে শিল্প এবং প্রতিদিনের বর্জ্য অপসারণের মাধ্যমে নদী দূষণ করছে।

৮৭টি উৎসমুখ দিয়ে সারফেস ড্রেন, পাইপ ও অন্যান্য মাধ্যমে তুরাগ নদ দূষণ করছে কামারপাড়ায় কনক্রিট রেডিমিক্স, নিশাদনগরে ওয়াশিং অ্যান্ড ডাইং, গাজীপুর সিটি করপোরেশন, টঙ্গী বাজার, বেঙ্গল ডাইং অ্যান্ড নিটিং, আইচি হাসপাতাল, আজমিরী গার্মেন্ট, বিসিক, ঢাকা ডাইং, মার্চেন্ট ডাইং, মেহমুদ হোসেন ডাইং অ্যান্ড প্রিন্টিং লিমিটেড, সার্ফ ফিটিং ওয়াশিং প্ল্যান্ট ও প্যারাডাইস ওয়াশিং প্ল্যান্ট।

আইডিইবি সভাপতি এ কে এম এ হামিদ বলেন, তারা সেপটিক ট্যাঙ্ক ছাড়া ঘরবাড়ির নকশা অনুমোদন না দেওয়ার সুপারিশ করেছেন। পূর্ণ মাত্রায় পাগলা ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট ব্যবহার নিশ্চিত করার পাশাপাশি সব ক’টি খালে পানি নিষ্কাশন স্বাভাবিক ও খাল পুনরুদ্ধারের সুপারিশও রয়েছে। তিনি আরও বলেছেন, প্রতিদিন ট্যানারি কারখানাগুলো ১২ হাজার লিটার, টেক্সটাইল ডাইংসহ প্রিন্টিং ও ওয়াশিং কারখানাগুলো ৬০ হাজার লিটার এবং ঢাকা ওয়াসা ১২ হাজার ঘনমিটার তরল বর্জ্য নদীতে ফেলছে। এ অবস্থায় ব্রহ্মপুত্রের পানিপ্রবাহের জন্য জগন্নাথগঞ্জ ও ফুলছড়ি ঘাট এলাকায় ব্যারাজ নির্মাণ করা যেতে পারে। যমুনার পানি এনে বুড়িগঙ্গায় প্রবাহ বাড়ানো, ঢাকার চারপাশের নদীগুলোর নাব্য ধরে রাখতে ড্রেজিং, দ্রুতগতিসম্পন্ন ও জ্বালানিসাশ্রয়ী নৌযান নির্মাণের মাধ্যমে স্বল্প ব্যয়ে ও দ্রুত যাতায়াতের ব্যবস্থা এবং হাজারীবাগের ট্যানারিশিল্প সাভারে স্থানান্তর করলে নদী রক্ষা পাবে।-সমকাল