রবিবার , ২২শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ , ৭ই আশ্বিন, ১৪৩১ , ১৮ই রবিউল আউয়াল, ১৪৪৬

হোম > Uncategorized > টাকার কুমির হাওলাদার

টাকার কুমির হাওলাদার

শেয়ার করুন

বাংলাভূমি২৪ ডেস্ক ॥: ক্ষমতার দাপট, ভীতি প্রদর্শন, সরকারি জমি আত্মসাৎ যার কাজ তিনি হচ্ছেন পটুয়াখারী-১ আসনের সংসদ সদস্য ও জাতীয় পার্টির (জাপা) সাবেক মহাসচিব এবিএম রুহুল আমিন হাওলাদার। বিএনপি ও জাতীয় পার্টির মন্ত্রী-উপমন্ত্রী হয়ে ঢাকা, বরিশাল, পটুয়াখালী ও কুয়াকাটায় গড়ে তুলেছেন অট্টালিকা। নির্মাণ করছেন কুয়াকাটা গ্রান্ড হোটেল ও রিসোর্টস এবং ডাকবাংলোসহ স্থাপনা। ঢাকার অভিজাত এলাকায় বাড়ি, ফ্লাট, প্লট, বিভিন্ন মার্কেটে দোকান রয়েছে তার। মন্ত্রী-এমপি হয়ে অবৈধভাবে দু’হাতে কামাই করেছেন টাকা। স্ত্রী-সন্তানসহ নামে-বেনামে অর্জন করেছেন অবৈধ সম্পদ। এলাকার মানুষ তাকে টাকার কুমির হিসেবেই চিনে। দিয়েছেন নির্বাচনী হলফনামায় মিথ্যা তথ্য। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ও অনুসন্ধানে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।

দুদক থেকে জানা যায়, নির্বাচন কমিশনে দেয়া হলফনামায় এবিএম রুহুল আমিন হাওলাদার উল্লেখ করেছেন, বাড়ি, অ্যাপার্টমেন্ট, দোকানভাড়া থেকে তার বার্ষিক আয় এক কোটি ৬২ লাখ ৬৬ হাজার টাকা। যা ২০০৮ সালে এই খাত থেকে ছিল মাত্র ১৩ লাখ আট হাজার ৯৩৮ টাকা। সাংসদের পারিতোষিক হিসেবে তার বার্ষিক আয় ১৩ লাখ ৮৯ হাজার ৬২৫ টাকা। গত পাঁচ বছরে রুহুল আমিন ৬৭ লাখ ৯৪ হাজার ৫৩০ টাকা দামের একটি ও স্ত্রী ৫৯ লাখ ৪৪ হাজার ৫৩০ টাকা দামের আরেকটি গাড়ির মালিক হয়েছেন। দুটিই ল্যান্ডক্রুজার ব্র্যান্ডের। স্ত্রীর ১০০ ভরি স্বর্ণসহ অন্যান্য অলঙ্কার আছে। তার আগ্নেয়াস্ত্রের মধ্যে নাইন এমএম পিস্তল, ২২ বোর রাইফেল, দোনালা বন্দুক, রিভলবার ও একটি শটগান আছে। হলফনামায় উল্লেখ আছে, তিনি ধার দিয়েছেন ১০ কোটি ৫৫ লাখ টাকা। স্ত্রীকেও অর্থ ধার দিয়েছেন তিনি। রুহুল আমীনের অকৃষি জমির মধ্যে গুলশানে নিজের নামে রয়েছে ১২ দশমিক ৭ কাঠা; যার মূল্য দেখানো হয়েছে অর্জনের সময়ে নয় লাখ ৩৪ হাজার ৩৭৯ টাকা। স্ত্রীর নামে এবার পূর্বাচলে সাড়ে সাত কাঠা জমি দেখিয়েছেন; যার মূল্য দেখানো হয়েছে ১৮ লাখ ৭৫ হাজার টাকা। ২০০৮ সালে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে তাঁর নগদ টাকা ছিল ১৭ লাখ ৬৮ হাজারের কিছু বেশি। পাঁচ বছর পর এসে এখন তাঁর নিজের নগদ টাকাই আছে ছয় কোটি ৬৬ লাখের বেশি। গতবার যেখানে কোনো শেয়ার বা বন্ড ছিল না, সেখানে এবার স্বামী-স্ত্রীর সাড়ে আট কোটি টাকার শেয়ার, দুটি ল্যান্ডক্রুজার গাড়ি, প্লটসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সম্পদ বেড়েছে।
দুদকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, নির্বাচন কমিশনে জমা দেয়া হলফনামায় এবিএম রুহুল আমিন হাওলাদারের উল্লেখিত সম্পদের বাইরেও বিপুল সম্পদের তথ্য পেয়েছে দুদক। গত ৯ এপ্রিল দুদক এ বি এম রুহুল আমিন হাওলাদারের অবৈধ সম্পদের অর্জনের অভিযোগ অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেয়। দুদকের উপ-পরিচালক হামিদুল হাসানকে অনুসন্ধানের দায়িত্ব দেয়া হয়। বিশেষ করে কুয়াকাটায় তাঁর বিপুল পরিমাণ সম্পদ রয়েছে বলে অভিযোগ এসেছে। ২০০৮ সালে রুহুল আমিন হাওলাদারের সম্পদের হিসাব চেয়ে নোটিশ দেয় দুদক। দুদকের নোটিশ পেয়ে তিনি সম্পদ বিবারণীও দুদকে জমা দেন। এরপর অনুসন্ধান করে দুদক। ২০০৮ সালে হাইকোর্টে দুদকের নোটিশ বাতিল চেয়ে রিট করেন তিনি। এরপর গত ১৩ এপ্রিল রুহুল আমিন হাওলাদারের নির্বাচনী হলফনামা চেয়ে নির্বাচন কমিশনকে চিঠি দেয় দুদক। এই চিঠি বাতিল চেয়ে রুহুল আমিন হাওলাদার ওই পূর্বের রিটের অন্তর্ভুক্ত করে গত ১৪ মে তার পক্ষে আদেশ নেন। হাইকোর্ট ইসিতে দুদকের পাঠানো চিঠি বাতিলের আদেশ দেন। বর্তমানে রুহুল আমিন হাওলাদারের বিরুদ্ধে দুদকের অনুসন্ধান স্থগিত রয়েছে। হাইকোর্টের আদেশের বিরুদ্ধে দুদক আপিল করবে বলে সংশ্লিষ্ট অনুসন্ধান কর্মকর্তা জানিয়েছেন। এর আগে ১৯৯১ সালের ৪ মে রাজধানীর রমনা থানায় তৎকালীন দুর্নীতি দমন ব্যুরো এবিএম রুহুল আমিন হাওলাদারের বিরুদ্ধে একটি মামলা করেছিল। এতে জামানতের অর্থ একতরফা ও এককভাবে হ্রাসের মাধ্যমে আর্থিক অনিয়মের অভিযোগ আনা হয়। মামলা বাতিল চেয়ে রুহুল আমিন হাওলাদার হাইকোর্টে আবেদন করেন। ১৯৯২ সালে আদালত রুল জারি ও স্থগিতাদেশ দিয়েছিলেন। রুলের ওপর চূড়ান্ত শুনানি শেষে আদালত রায় ষোষণা করেন। এরপর রুহুল আমিন হাওলাদারের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) করা মামলা বাতিল চেয়ে হাইকোর্টে আবেদন করে রুহুল আমিন হাওলাদার। ২০১২ সালের ১৯ ফেব্র“য়ারি তার আবেদন খারিজ করে দেন হাইকোর্ট বলে দুদক থেকে জানা গেছে।
তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, পটুয়াখালীর প্রশাসক মো. জাহাঙ্গীর হোসেন স্বাক্ষরিত ২০১৩ সালের ৫ জুনের একটি পত্রে বলা হয়, স্থানীয় সরকার (পৌরসভা) আইন, ২০০৯ এর ধারা মোতাবেক পৌর এলাকার নাগরিকগণের পৌরসেবা প্রদানের লক্ষ্যে অবকাঠামোগত উন্নয়ন, ইমারত নির্মাণসহ নগর উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করার দায়িত্ব পৌরসভার। একই আইনের দ্বিতীয় তফসিলের ক্রমিক নম্বর ৩৫ ও ৩৬ এ কোন ভবন নির্মাণ, পুনর্র্নিমাণে পৌরসভা কর্তৃক অনুমোদন ও ইমারত সম্পাদন, পরিবর্তন ইত্যাদি সম্পর্কে পৌরসভাকে ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছে। ইতোমধ্যে পটুয়াখালী জেলাধীন কলাপাড়া উপজেলার লতাচাপলী, গঙ্গামতি, কাউয়ারচর ও চরচাপলী মৌজার বিভিন্ন দাগে ১০,২৭৯.৫৮ একর জমি পর্যাটন সংরক্ষিত এলাকা হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে মর্মে সরকারের বেসামরিক বিমান পর্যাটন মন্ত্রণালয় পর্যাটন-২ অধিশাখার ৬ জানুয়ারি ২০১৩ তারিখের প্রজ্ঞাপন, যা বাংলাদেশ গেজেট অতিরিক্ত শাখায় বৃহস্পতিবার জানুয়ারি ২০১৩ তারিখে প্রকাশিত হয়েছে। এবিএম রুহুল আমীন হাওলাদার এমপি পটুয়াখালী জেলাধীন কলাপাড়া উপজেলার জে. এল. ৩৪ নং লতাচাপলী মৌজার হাল ৫৩৮৭,৫৩৮৯ ও ৫৩৯০ নং দাগের উপর কুয়াকাটা গ্রান্ড হোটেল অ্যান্ড রিসোর্টস স্থাপনা নির্মাণেরর নিমিত্ত নকশা অনুমোদনের জন্য পৌরসভা বরাবর দাখিল করেন। কিন্তু বর্ণিত দাগ ৩টি পর্যাটন সংরক্ষিত এলাকা হিসেবে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। এ অবস্থায় এবিএম রুহুল আমীন হাওলাদার এমপি কর্তৃক দাখিলকৃত নকশাসহ সকল সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান এবং জনসাধারণের অবকাঠামো, ইমারত নির্মানের পূর্বে স্থানীয় সরকার (পৌরসভা) আইন, ২০০৯-এর বিধান মোতাবেক কুয়াকাটা পৌরসভা কর্তৃক নকশা অনুমোদন দেয়া যাবে কি না সে বিষয়ে নির্দেশনা প্রদানের জন্য অনুরোধ করা গেল। এই পত্রের পাওয়ার পর ভূমি মন্ত্রণালয় থেকে রুহুল আমিন হাওলাদার উক্ত সরকারি জমি আত্মসাৎ করেছেন।
কুয়াকাটা পৌর আওয়ামী লীগ নেতা মনির ভূইয়া ইনকিলাবকে জানান, তার ৯৭৪নং খতিয়ানের ২৩ শতাংশ জমি রুহুল আমীন হাওলাদার জোরপূর্বক দখল করে নিয়েছেন। আওয়ামী লীগ নেতা মনির ভূইয়ার কাছে রুহুল আমিন হাওলাদার ওই জমির দলিল চেয়েছেন। দলিল আগে না দিলে জমির মূল্যেও টাকা দেবেন না বলে রুহুল আমিন হাওলাদার জানিয়ে দিয়েছেন বলে মনির ভুইয়া জানান। তিনি বলেন, আমার জমির উপরে রুহুল আমিন হাওলাদার হোটেল নির্মাণ করছেন। ভবনের নির্মাণ কাজ চলছে। জমি নিয়ে মামলা হাইকোর্টে বিচারাধীন রয়েছে বলে জানান তিনি।
অনুসন্ধানে আরো পাওয়া যায়, এবিএম রুহুল আমিন হাওলাদার কুয়াকাটা পানি উন্নয়ন বোর্ডের খতিয়ান নং ১২০৩ এর সরকারি জমি দখল করেছেন। কেয়ার ফ্যাশন নামে সেখানে সাইনবোর্ড টানিয়েছেন। এছাড়াও তিনি ঢাকার বাড্ডা এলাকায় ১৩৮.২৫ অজুতাংশ, তেজগাঁও ২৪১ শিল্পঅঞ্চল এলাকায় প্রায় পাঁচ’শ কোটি টাকা মূল্যেও সরকারি সম্পত্তি দখল কওে আত্মসাৎ করেছেন। এসব জমিতে তার কেয়ার ফ্যাশন নামে কোম্পানির সাইনবোর্ড টানিয়ে রেখেছেন।
তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়,এই প্রথম এবিএম রুহুল আমিন পটুয়াখারী-১ (সদর-ধুমকি-মির্জাগঞ্জ) আসনে এমপি নির্বাচিত হন। আগে বাকেরগঞ্জের এমপি হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিলেন। বর্তমানে সে আসনে তার স্ত্রী নাসরিন জাহান রতœা আমীন এমপি নির্বাচিত হন। এবিএম রুহুল আমিন হাওলাদার ১৯৮১ থেকে ৮২ সালে বিএনপির থেকে মনোনয়ন পেয়ে এমপি নির্বাচিত হন। বিএনপি সরকারের বস্ত্র ও পাট উপমন্ত্রী ছিলেন তিনি। পরে ১৯৮২ সালে জাতীয় পার্টিতে যোগ দিয়ে হুইপের দায়িত্ব পালন করেন। পরে স্বাস্থ্য ও কৃষির মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নেন। ১৯৯০ সালে তিনি পাটমন্ত্রী ছিলেন।
এ বিষয়ে মোবাইল ফোনে এবিএম রুহুল আমিন হাওলাদারের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। কিন্তু তার ফোনটি রিসিভ করেন তার ব্যক্তিগত সহকারী জসিম উদ্দিন। তিনি বলেন, স্যার ব্যস্ত আছে। পরে ফোন দেন। এরপর একাধিকবার তার ফোনে কল দেয়া হলেও তিনি আর ধরেননি