শনিবার , ২১শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ , ৬ই আশ্বিন, ১৪৩১ , ১৭ই রবিউল আউয়াল, ১৪৪৬

হোম > Uncategorized > জাহাজভাঙা শিল্প ॥ জীবনের বিনিময়ে জীবিকা

জাহাজভাঙা শিল্প ॥ জীবনের বিনিময়ে জীবিকা

শেয়ার করুন

বাংলাভূমি২৪ ডেস্ক ॥ বাংলাদেশের জাহাজভাঙা শিল্প নিয়ে কাজ করতে যাওয়ার পর আমাকে সতর্ক করে দেয়া হয়েছিল। যদিও আমি ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম একজন পর্যটক হিসেবে। ঘুরে বেড়ানোর সময় স্থানীয় একজন আমাকে বলেছিল, ‘মানুষ কীভাবে তার দুহাত দিয়ে বড় বড় জাহাজ টুকরো টুকরো করে ফেলে তা দেখতে অনেকেই আসে, কিন্তু এই ঘটনা বাইরের মানুষকে জানতে দেয়া হয় না।’ আমি বঙ্গোপসাগরের কূল ঘেঁষে কয়েক মাইল এলাকায় ঘুরেছি। চট্টগ্রাম শহরের উত্তরে বঙ্গোপসাগরের উপকূল ঘেঁষে প্রায় আট মাইল এলাকাজুড়ে প্রায় ৮০টি জাহাজভাঙা ডক আছে। প্রতিটি ডকেরই নিরাপত্তা ব্যবস্থা খুব জোরালো। পুরো এলাকাটি কাঁটাতার দিয়ে ঘেরা।

‘ছবি তোলা যাবে না’ লেখা সম্বলিত সাইনবোর্ড তো আছেই সঙ্গে আছে নিরাপত্তা প্রহরী। কয়েক বছর আগেও বাইরে থেকে যে কেউ এখানে এসে ঘুরে বেড়াতে কিংবা ছবি তুলতে পারতো। কিন্তু গত বছর একটি জাহাজ ভাঙার সময় বিস্ফোরণে কয়েকজন শ্রমিক মারা যাওয়ার পর থেকে জনসাধারণের প্রবেশ নিষেধ। তবে স্থানীয়দের দাবি, মুনাফা এবং অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের তথ্য যেন বাইরে চলে না যায় তাই ডক মালিকরা এরকম নিরাপত্তা ব্যবস্থা চালু করেছে। তারা আরও বলে, মালিকরা ভূমিতে তাদের নিজস্ব কায়দায় নিরাপত্তার ব্যবস্থা করে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে পারে, কিন্তু সাগরে কোনো নিষেধাজ্ঞা চলে না।

একদিন বিকেলবেলা আমি স্থানীয় এক জেলেকে ভাড়া করলাম, কথা হলো সে আমাকে ডকগুলোর খুব কাছ থেকে ঘুরিয়ে দেখাবে। নৌকা নিয়ে পানিতে নামার পর যে দৃশ্যটা আমার চোখে আটকে গেল, তা হলো বিশাল সব ট্যাংকার। একদিকে জাহাজ ভাঙার কারণে সৃষ্ট ধোঁয়া, অন্যদিকে ভারি তেল পড়ে কালো হয়ে যাওয়া পানির ঝাঁঝালো তেলচিটে গন্ধ। অনেক জাহাজকে প্রায় অক্ষত অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখলাম। আরও দেখলাম, জাহাজের সারি সারি কঙ্কাল। প্রায় অবলীলায় শ্রমিকরা বড় বড় জাহাজ; গ্যাস কাটার দিয়ে কেটে ফেলছে। এসময় অনেকগুলো জাহাজের নাম দেখতে পেলাম, যেমন কমোরস, ভি ইউরোপ (মার্শাল আইল্যান্ড), গ্লোরি বি (পানামা) ইত্যাদি। শ্রমিকরা জানেই না যে তারা কোন দেশের কিংবা কোন কোম্পানির জাহাজ ভাঙছে। আমি বিস্মিত হয়ে দেখলাম, কী নির্লিপ্ততায় একটা বিশাল ট্যাংকারকে কেটে অজস্র ছোট ছোট খণ্ডে বিভক্ত করে ফেললো শ্রমিকেরা।

মূলত যে ধরনের জাহাজ এখানে ভাঙা হয়ে থাকে, তার বেশিরভাগই আশির দশকে নির্মিত; তেল কিংবা বিষাক্ত বর্জ্য পদার্থ বহন করার কারণে ২৫-৩০ বছরের মধ্যেই জাহাজগুলো কর্মক্ষমতা হারিয়েছে। পুরোপুরি অকেজো হয়ে পড়লে চট্টগ্রামের এই জাহাজভাঙা শিল্প এলাকায় জাহাজগুলো বিক্রি করে দেয় মালিকেরা। আমি যেদিন পুরো ডক এলাকা দেখতে বের হলাম, সেদিন কোনো কারণে শ্রমিকদের কর্মবিরতি চলছিল। কিন্তু তারপরও বিশাল সব জাহাজের ভেতর থেকে লোহা পেটানোর শব্দ ভেসে আসছিল। বাতাসে ডিজেল আর ধোঁয়ার তীব্র ঝাঁঝালো গন্ধ নাকে এসে ঠেকছিল। একটা জাহাজের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় আমরা কিছু নগ্ন শিশু দেখতে পেলাম, যারা বিভিন্ন লোহার টুকরো নিয়ে খেলছিল আর সেই তেলচিটে জলে সাঁতার কাটছিল। সেখানকার চিত্রটা এমনই যে, একদিকে লোহার জঞ্জালের ওপর দিয়ে শিশুরা পানিতে ঝাঁপ দিচ্ছে, অন্যদিকে জেলেরা মাছের জন্য পানিতে জাল ফেলছে।

হঠাৎ করেই অজস্র আগুনের ফুলকি এসে পুরো দৃশ্যপটটা বদলে দেয়। একদল শ্রমিক চিৎকার করে আমাদের সাবধান করতে থাকে আর সরে যেতে বলে। তারা একটা জাহাজের অংশ কেটে ফেলেছে এবং সেটা ধসে পড়ছে। এমন অবস্থায় একজন শ্রমিক আমাকে বলতে থাকে, ‘সরে যান! আমরা একটা অংশ কেটে ফেলেছি, মরতে চান নাকি!’

এক একটা জাহাজ তৈরি করা হয় অনেক কিছু মাথায় রেখে, যাতে সেই জাহাজটি পৃথিবীর বুকে অনেক প্রতিকূলতা সহ্য করে ভেসে থাকতে পারে। আর এ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা হিসেবে অনেক সময় এমন অনেক উপাদান ব্যবহৃত হয় জাহাজ নির্মাণে যা অত্যন্ত বিষাক্ত এবং খালি চোখে দেখা অসম্ভব। একটা প্রশ্ন আছে: উন্নয়নশীল দেশগুলোতেই কেন জাহাজভাঙা শিল্প বেশি গড়ে ওঠে? কারণটা অর্থনৈতিক। জাহাজ ভাঙতে যেমন দরকার অনেক অর্থের, তেমনি দরকার অনেক শ্রমিকেরও। শুধু তা-ই নয়, জাহাজ ভাঙার ফলে পরিবেশে যে ক্ষতিকর পদার্থ ছড়িয়ে পড়ে, তা সামাল দিতেও অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়। যেহেতু বাংলাদেশ একটি উন্নয়নশীল দেশ এবং এখানে সস্তায় অনেক শ্রমিক পাওয়া যায়, তাই বিশ্বের অনেক দেশে জাহাজভাঙা শিল্প দিনে দিনে বন্ধ হয়ে গেলেও বাংলাদেশে এটি আরো বাড়ছে।

গত দশকেও জাহাজভাঙা শিল্পে এগিয়ে ছিল ভারত ও পাকিস্তান। কিন্তু পরিবেশগত ঝুঁকির কারণে ভারত পিছিয়ে এসেছে, তাই এখন প্রথম অবস্থানে আছে বাংলাদেশ। ২০১৩ সালে বাংলাদেশে ১৯৪টি জাহাজ ভাঙা হয়েছে।

চট্টগ্রামের অনেক পরিবেশবিদ আমাকে জানিয়েছেন, এক একটা জাহাজ ভাঙতে সময় লাগে তিন থেকে চার মাস। আর এই তিন থেকে চার মাসের মধ্যে প্রায় ১০ লাখ ডলার মুনাফা করে নেয় মালিকপক্ষ। অথচ পাকিস্তানে ঠিক একই প্রক্রিয়ায় জাহাজ ভাঙা হওয়ার পর তাদের মুনাফা হয় মাত্র দুই লাখ ডলার। আমি বাংলাদেশ জাহাজভাঙা অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক প্রধান জাফর আলমের সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলি। কিন্তু তিনি মুনাফার এই বাড়াবাড়ি মানতে নারাজ। তিনি বলেন, ‘ইস্পাতের দাম, জাহাজের আকৃতিসহ বিভিন্ন কিছুর ওপর মূলত মুনাফা নির্ভর করে।’

জাহাজ ভাঙার সঙ্গে বেশ কয়েকটি ক্ষতিকারক রাসায়নিক সংশ্লিষ্ট, যেমন- অ্যাসবেস্টস, পলিক্লোরিনেটেড বাইফিনাইলস, সীসা, ক্রোমেট, পারদ, ওয়েল্ডিংয়ের ধোঁয়া, তেজষ্ক্রিয় বিকিরণ, শব্দ, কম্পন, বায়ুদূষণ, জৈব তরল পদার্থ, ব্যাটারি, সংকুচিত গ্যাস সিলিন্ডার, অগ্নিনির্বাপক তরল পদার্থ ইত্যাদি। ক্ষতিকারক রাসায়নিক পদার্থ পরিবেশে প্রবেশ করার পর এগুলো শুধু পরিবেশেরই ক্ষতি করে না, আমাদের স্বাস্থ্যের জন্যও মারাত্মক ক্ষতি করে।

অ্যাসবেস্টসের গুঁড়োর জন্য স্থায়ীভাবে শ্বাস-প্রশ্বাসের প্রদাহ সৃষ্টি হয়, যাকে বলা হয় অ্যাসবেস্টসিস। এর পরিণামে ফুসফুসের ক্যানসার হতে পারে। শ্বাসের সময় গ্রহণ করলে অথবা খাদ্যবস্তুর সঙ্গে পেটে গেলে সীসা রক্ত ও হাড়ে জমা হয়, এজন্যে রক্তশূন্যতা সৃষ্টি হতে পারে এবং স্নায়ুতন্ত্র ও কিডনিতে বিষক্রিয়া ঘটতে পারে। অনেকগুলো রাসায়নিক পদার্থে উপস্থিত ক্রোমিয়াম একজিমা, শ্বাসতন্ত্রের রোগ এবং ফুসফুসের ক্যানসার সৃষ্টি করে। পলিনিউক্লিয়ার অ্যারোমেটিক হাইড্রোকার্বন যৌগ ফুসফুসের ক্যানসারসহ অন্যান্য ক্যানসার সৃষ্টি করে। এই যৌগের কিছু কিছু আবার বংশগতির উপাদান ডিএনএর সঙ্গে যুক্ত হয়ে প্রজন্মান্তরে কোষে ক্ষতি ছড়িয়ে দেয়, বংশগতির পরিবর্তন বা মিউটেশন ঘটায়। এর জন্যে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা পরবর্তী প্রজন্মে আরও কমে যায়। বাংলামেইল২৪ডটকম