শনিবার , ২১শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ , ৬ই আশ্বিন, ১৪৩১ , ১৭ই রবিউল আউয়াল, ১৪৪৬

হোম > Uncategorized > জাল টাকার ৭০ গ্রুপ মাঠে

জাল টাকার ৭০ গ্রুপ মাঠে

শেয়ার করুন

বাংলাভূমি২৪ ডেস্ক ॥ ৫০ কোটির টার্গেট নিয়ে রাজধানীসহ সারা দেশে সক্রিয় জাল টাকা তৈরির কারিগর এবং বিপণনকারীসহ অন্তত ৭০টি গ্রুপ। অতীতের মতো এবারও কোরবানির ঈদ এবং দুর্গাপূজাকে সামনে রেখে এসব চক্রের সদস্যরা গোয়েন্দা নজরদারির বাইরে থেকে তাদের কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে। এরই মধ্যে টার্গেটের বেশির ভাগ জাল নোটই বাজারে চলে গেছে বলে আশঙ্কা গোয়েন্দাদের।
অন্যদিকে, জাল নোটসহ গ্রেফতার করা চক্রের বিরুদ্ধে কঠোর আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ থাকলেও এ ক্ষেত্রে জোরালো কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না বলে হতাশা প্রকাশ করেছেন অপরাধ বিশেষজ্ঞরা। তবে গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের দাবি, গ্রেফতারের কিছুদিনের মধ্যেই জাল নোট প্রস্তুতকারী এবং বিপণনকারীরা জামিনে বেরিয়ে আসার কারণে তাদের মধ্যে ভীতি কাজ করছে না।অপরাধ বিশেষজ্ঞ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক হাফিজুর রহমান কার্জন বলেন, জাল টাকার বিষয়ে সচেতনতা বাড়ানো, আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর বাহিনীর কার্যক্রম এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মনিটরিংয়ের বিষয়টি আরও শক্তিশালী করা প্রয়োজন। দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করার জন্য প্রয়োজনে আইনের সংশোধন করা যেতে পারে।
একই সঙ্গে এসব মামলা পরিচালনার জন্য পৃথক আদালতের ব্যবস্থা করা যেতে পারে।আদালত সূত্র জানায়, বিচ্ছিন্নভাবে যেসব জাল নোট উদ্ধার করা হয় এবং ওই সব মামলায় যাদের সাক্ষী করা হয় তারা নিয়মিত সাক্ষ্য দিতে আসেন না। ফলে মামলাগুলো নিষ্পত্তি হচ্ছে না। আর যেগুলোর নিষ্পত্তি হচ্ছে সেগুলোয় সাজা হচ্ছে না। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বরাবরের মতোই এবারও জাল টাকার ব্যবসায়ীদের মূল নজর হলো পশুর হাট এবং বিপণিবিতানগুলো। ৫০টি গ্রৃপের সদস্যদের মধ্যে অসাধু ব্যাংক কর্মকর্তারাও রয়েছেন। এসব ব্যাংক কর্মকর্তা সময়-সুযোগ বুঝেই তারা ৫শ’ ও এক হাজার টাকার বান্ডিলে দুই থেকে চারটি করে জাল টাকা দিয়ে দিচ্ছেন। এসব ব্যাংকের এটিএম বুথ থেকে টাকা ওঠানোর পর তা জাল নোট বলে শনাক্ত হওয়ার পরও সংশ্লিষ্ট ব্যাংক এর দায় না নিয়ে উল্টো গ্রাহককেই হয়রানি করছেন। এর ভয়ে অনেকে অভিযোগ দেওয়া থেকেও নিজেদের বিরত রাখছেন। তবে ভয়ঙ্কর এসব প্রতারণামূলক কাজে জড়িয়ে গ্রেফতার হওয়ার পরও তারা জামিনে বের হয়ে আসছে।
সবচেয়ে আঁতকে ওঠার মতো বিষয়টি হচ্ছে, উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহারে অধিকাংশ ক্ষেত্রে পুরনো টাকার ওপর ছাপ বসানো হয়, যা জাল টাকা শনাক্তকারী মেশিন ধরতে পারে না। অনেক গোয়েন্দা কর্মকর্তাও জাল নোট নিয়ে গোলক ধাঁধায় পড়ে যাচ্ছেন। আসল নোট চিনতে রীতিমতো হিমশিম খেতে হচ্ছে তাদের। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) যুগ্ম-কমিশনার মনিরুল ইসলাম বলেন, আমরা আমাদের দায়িত্ব পালন করছি। তবে দুঃখের বিষয় হলো গ্রেফতারের কিছুদিন পরই জাল টাকা তৈরির সঙ্গে জড়িতরা জামিনে বের হয়ে পুনরায় একই অপরাধে জড়িয়ে পড়েছে। তাদের অনেককেই চার/পাঁচবার গ্রেফতার করা হয়েছিল। বর্তমানে রাজধানীসহ সারা দেশে অন্তত ৩০টির মতো গ্র“প জাল টাকা তৈরি এবং বিপণনের সঙ্গে জড়িত বলে আমাদের কাছে তথ্য রয়েছে। র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার মুফতি মাহ্মুদ খান জানান, রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় জাল টাকা শনাক্তকরণ মেশিন নিয়ে র‌্যাবের টিম পশুর হাটে থাকবে। অতীতের মতো জনগুরুত্বপূর্ণ এ বিষয়টির ব্যাপারে র‌্যাবের প্রতিটি ব্যাটালিয়নকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
একই সঙ্গে জাল নোটের কারিগর এবং এর বিপণনকারীদের গ্রেফতারে গোয়েন্দা কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে।সূত্র জানায়, চক্রগুলো বাজারে এক লাখ জাল টাকার নোট বিক্রি করছে ২০ হাজার টাকায়, আর ৫০ হাজার টাকা বিক্রি করছে ১০ হাজার টাকায়। তৈরিকৃত জাল টাকা বিভিন্ন সিন্ডিকেটের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ছে সারা দেশে। জাল টাকা তৈরি থেকে শুরু করে বাজারজাত করা পর্যন্ত কয়েকটি ভাগে তারা এ কাজ করে থাকে। প্রথমে অর্ডার অনুযায়ী জাল নোট তৈরি, দ্বিতীয় পর্যায়ে এই টাকাগুলো যে অর্ডার দেয় তার কাছে পৌঁছে দেওয়া, তৃতীয় পর্যায়ে জাল টাকা বাজারে ছড়িয়ে দেওয়া হয়। সূত্র জানায়, আসন্ন ঈদ ও পুজোকে সামনে রেখে তারা বাজারে জাল টাকা ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে। জাল টাকার চক্রগুলো বাজারে জাল টাকা ছড়িয়ে দেওয়ার পাশাপাশি এটিএম বুথেও আসল টাকার সঙ্গে জাল টাকা মিশিয়ে ব্যবসা করছে বলে জানা গেছে।
এদিকে, জাল টাকা তৈরির কারিগরদের (মাস্টার) মধ্যে সগির, কামাল, হুমায়ূন, জাকির, কাওসার, মাহ্বুব মোল্ল্যা, আলাউদ্দীন, বাবু, রহিম বাদশার মতো অন্তত ২০ জন জাল টাকার কারিগর রয়েছে। এদের মধ্যে সগির, হুমায়ূন, আলাউদ্দীনের তৈরি জাল নোটের চাহিদা অনেক বেশি। এদের তৈরিকৃত টাকায় আসল টাকার অনেক বৈশিষ্ট্যই বিদ্যমান থাকছে। এগুলো যাচাই করতে কেবল সাধারণ মানুষ নন, টাকা শনাক্তকারী বিশেষজ্ঞদেরও রীতিমতো হিমশিম খেতে হয়। জাল টাকা তৈরির কারিগরদের মধ্যে চাঁপাইনবাবগঞ্জের বাসিন্দা দুরুজ্জামান এবং তার ভাই খালেকুজ্জামান অন্যতম পথিকৃত হলেও বর্তমানে কিছুদিন তারা এ কাজের সঙ্গে নেই বলে সূত্র নিশ্চিত করেছে। এ ছাড়া রাজধানীসহ সারা দেশে অন্তত ৫০টি জাল টাকার ডিলার রয়েছে। প্রত্যেক ডিলারের সঙ্গে কমপক্ষে পাঁচ/ছয়জন বাজারজাতকারী রয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর আবু হেনা মো. রাজী হাসান বলেন, প্রতিবারের মতো এবারও সব পশুর হাটে জাল নোট শনাক্তকারী মেশিন সরবরাহ করা হয়েছে। এ ছাড়া সব আইন শৃঙ্খলা বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থার সমন্বয়ে কাজ করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। জাল নোট সরবরাহকারী এবং উৎপাদনকারীদের ঠেকাতে সব ধরনের ব্যবস্থা নিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।ডিবির সহকারী কমিশনার মাহ্বুুবুর রহমান জনি জানান, জাল টাকা তৈরির কারিগররা বাজারে পাওয়া যায় এক ধরনের লাল রঙের কালির (ইপসন) রীতিমতো সংকট তৈরি করে ফেলে। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এসব কারিগরের জাল নোটে সাধারণ মানুষদের বিভ্রান্ত হওয়ার অনেক কারণ থেকে যাচ্ছে। তবে তাদের জালনোটে অনেক সময়ই জল ছাপের প্লেসমেন্ট ঠিক হয় না।
একই সঙ্গে জাল নোট অনেকটাই ঝকঝকে এবং ঝলমলে। তবে জাল টাকার কারিগর এবং বাজারজাতকারীদের ওপর আমাদের নজরদারি অব্যাহত রয়েছে।জাল টাকার মামলা ও নিষ্পত্তি : বাংলাদেশ ব্যাংকের দেওয়া তথ্যে দেখা গেছে, ব্যাংক কাউন্টার, নোট পরীক্ষণ হল ও ভল্ট পরিদর্শনে এক হাজার টাকার নোটই জাল বলে ধরা পড়ছে বেশি। ২০১১ সালে ২১৩টি ১০০ টাকার নোট, ৪৭টি ৫০০ টাকার নোট ও ২৩২টি এক হাজার টাকার জাল নোট ধরা পড়ে। ২০১২ সালে ১০৩টি ১০০ টাকার নোট, ৩৪টি ৫০০ টাকার নোট ও ৪০টি এক হাজার টাকার জাল নোট ধরা পড়ে। ২০১৩ সালে তিনটি ১০০ টাকার নোট, ৩৩টি ৫০০ টাকার নোট ও ৫১টি এক হাজার টাকার নোট জাল বলে ধরা পড়ে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কর্তৃক জাল টাকা উদ্ধারের পর এ নিয়ে করা মামলার খুব কমই নিষ্পত্তি হয়েছে। ২০১১ সালে ৫৯১টি মামলা হলেও নিষ্পত্তি হয় মাত্র ৭৭টি। এ সময় ৬ হাজার ৪৪২টি ১০০ টাকার নোট, ২ হাজার ৪৭৪টি ৫০০ টাকার নোট ও ২ হাজার ৬৪০টি এক হাজার টাকার জাল নোট ধরা পড়ে। ২০১২ সালে ৪৪৬টি মামলা হলেও নিষ্পত্তি হয় ৮২টি। এ সময় ধরা পড়ে ১০০ টাকার নোট দুই হাজার ৪৭১টি, ৫০০ টাকার নোট এক হাজার ৬৬৬টি ও এক হাজার টাকার নোট ৭ হাজার ২৫৯টি। ২০১৩ সালে ৩১১টি মামলা হয় কিন্তু নিষ্পত্তি হয় ৯০টি। এ সময় এক হাজার ৪৫১টি ১০০ টাকার নোট, দুই হাজার ৪৬টি ৫০০ টাকার নোট ও ৪ হাজার ৭৪৮টি এক হাজার টাকার জাল নোট ধরা পড়ে।জালনোট চেনার উপায় : জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতি সংবলিত ১০০, ৫০০ ও এক হাজার টাকার নোটেই মূল্যবান এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের লোগো সংবলিত নিরাপত্তা সুতা রয়েছে। নোটের মূল্যমান এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের লোগো নিরাপত্তা সুতার চারটি স্থানে মুদ্রিত আছে। নোট চিৎ করে ধরলে নিরাপত্তা সুতায় মূল্যমান এবং লোগো দেখা যাবে। কিন্তু কাত করে খাড়াভাবে ধরলে তা কালো দেখা যাবে। এ নিরাপত্তা সুতা অনেক মজবুত বা নোটের কাগজের অবিচ্ছেদ্য অংশ। নখের আঁচড়ে বা মুচড়িয়ে ওই নিরাপত্তা সুতা কোনোক্রমেই উঠানো সম্ভব নয়। জালনোটের নিরাপত্তা সুতা সহজেই নখের আঁচড়ে বা মোচড়ানোতে উঠে যায়।
অন্যদিকে, প্রত্যেক প্রকার নোটের উপরের ডানদিকে কোনায় ইংরেজি সংখ্যায় লেখা নোটের মূল্যমান রং পরিবর্তনশীল কালিতে মুদ্রিত রয়েছে। ১০০ ও ১০০০ টাকা মূল্যমানের নোট আস্তে আস্তে নড়াচড়া করলে নোটের মূল্যমান লেখাটি সোনালি হতে ক্রমেই সবুজ রঙে পরিবর্তিত হয়। একইভাবে ৫০০ টাকা মূল্যমানের নোটে ৫০০ মূল্যমান লেখাটি লালচে হতে পরিবর্তিত হয়ে সবুজ হয়। জালনোটে ব্যবহৃত এ রঙ চকচক করলেও তা পরিবর্তিত হয় না। এ ছাড়া, প্রত্যেক প্রকার নোটের সম্মুখ ও পশ্চাৎ পৃষ্ঠের ডিজাইন, মধ্যভাগের লেখা, নোটের মূল্যমান এবং সাতটি সমান্তরাল সরলরেখা উঁচু-নিচু (খসখসে)ভাবে মুদ্রিত আছে। তা ছাড়া নোটের ডানদিকে ১০০ টাকার নোটে তিনটি, ৫০০ টাকার নোটে চারটি এবং ১০০০ টাকার নোটে পাঁচটি ছোট বৃত্তাকার ছাপ আছে, যা হাতের স্পর্শে উঁচু-নিচু (খসখসে) অনুভূত হয়। চার. প্রত্যেক প্রকার নোটে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি, বাংলাদেশ ব্যাংকের মনোগ্রাম এবং নোটের মূল্যমান জলছাপ হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের মনোগ্রাম এবং নোটের মূল্যমান প্রতিকৃতির তুলনায় উজ্জ্বল দেখাবে।