রবিবার , ২২শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ , ৭ই আশ্বিন, ১৪৩১ , ১৮ই রবিউল আউয়াল, ১৪৪৬

হোম > গ্যালারীর খবর > জামায়াত নিষিদ্ধ:সিদ্ধান্ত পেতে ৪ মাস সময় লাগবে

জামায়াত নিষিদ্ধ:সিদ্ধান্ত পেতে ৪ মাস সময় লাগবে

শেয়ার করুন

বাংলাভূমি২৪ ডেস্ক ॥ জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ করার বিষয়ে আদালতের সিদ্ধান্ত পেতে আরো তিন থেকে চার মাস অপো করতে হতে পারে। দলটিকে বিচারের মুখোমুখি করতে দুটি আইনি প্রক্রিয়া একযোগে চলছে। এর একটি চলছে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে। অন্যটি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে। এ ট্রাইব্যুনাল জামায়াতের সাবেক আমির গোলাম আযমকে যে সাজা দিয়েছেন, তার বিরুদ্ধে সরকারপরে করা আপিলে জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ করার আবেদনও জানানো হয়েছে। আর মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের দেওয়া একাধিক রায়ে জামায়াতকে অপরাধী ও সন্ত্রাসী দল হিসেবে অভিমত দেওয়া হয়। এর পরিপ্রেেিত ট্রাইব্যুনালের প থেকে বিষয়টি নিয়ে তদন্ত চলছে। এ দুটি উদ্যোগের গতি-প্রকৃতি পর্যালোচনা করে তথ্য মিলেছে, জামায়াত নিষিদ্ধের ব্যাপারে আদালতের সিদ্ধান্ত পেতে আরো তিন-চার মাস লাগতে পারে।

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে রাষ্ট্রপরে আইনজীবী (প্রসিকিউশন) টিমের সমন্বয়কারী ও অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল এম কে রহমান এবং ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার প্রধান সমন্বয়কারী আবদুল হান্নান খানের বক্তব্যেও এ রকম আভাস পাওয়া গেছে। অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল এম কে রহমান বলেন, ট্রাইব্যুনাল একাধিক রায়ে জামায়াতে ইসলামীকে অপরাধী সংগঠন বলে অভিমত দিয়েছেন।

বিশেষ করে গোলাম আযমের মামলার রায়ে দেওয়া অভিমতে বলা হয়েছে, দলটি গত ৪২ বছরেও স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় তাদের ভূমিকার জন্য মা চায়নি বা অনুশোচনা করেনি। একই সঙ্গে এ দলটির কোনো সদস্য যাতে কোনো প্রতিষ্ঠানের পদে থাকতে না পারে সেজন্য সরকারের পদপে নেওয়া উচিত বলেও আদালত অভিমত দিয়েছেন। এ অবস্থায় দলটি নিষিদ্ধ করার জন্য আপিল বিভাগে সরকারের প থেকে আবেদন করা হয়েছে। সংবিধানের ১০৪ অনুচ্ছেদের আওতায় এ আবেদন করা হয়েছে।

তিনি বলেন, ‘গোলাম আযমের পওে একটি আপিল করা হয়েছে। এ দুটি আপিলের সারসংপে কোনো পই জমা দেয়নি। আমাদের আপিলের সারসংপে শিগগিরই জমা দেওয়া হবে। এরপর শুনানির জন্য আদালতে আবেদন করা হবে।’ তিনি বলেন, সারসংপে ছাড়া শুনানি হবে না।

এ প্রক্রিয়া অনুসরণ করে সরকারের করা আপিল নিষ্পত্তি হতে কত দিন লাগতে পারে- এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, দিনণ বলা যাবে না। তবে যত দ্রুত সম্ভব শুনানির চেষ্টা করা হবে। তিনি বলেন, আদালতে জামায়াতকে নিষিদ্ধ করার পে চূড়ান্ত রায় পাওয়া গেলেও দলটি নিষিদ্ধ করে সরকারকে গেজেট প্রকাশ করতে হবে।

ট্রাইব্যুনালের তদন্ত কার্যক্রমের অগ্রগতি সম্পর্কে তদন্ত সংস্থার প্রধান সমন্বয়কারী আবদুল হান্নান খান বলেন, ‘ট্রাইব্যুনালের একাধিক রায়ের পর আমরা গত মাসে জামায়াতের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিকভাবে তদন্ত শুরু করেছি। এ দলটির বিরুদ্ধে তথ্য-প্রমাণ জোগাড় করা হচ্ছে।’ তিনি বলেন, দলটি অতীতেও মানুষের রগ কেটেছে। এখনো রগ কাটছে। এসব তথ্য-প্রমাণ জোগাড় করা হচ্ছে। তাই তদন্ত শেষ করতে দু-তিন মাস লাগতে পারে। এরপর ট্রাইব্যুনালে অভিযোগ দাখিল করা হবে।

তিনি বলেন, ‘গত ১৮ ফেব্রুয়ারি ট্রাইব্যুনাল আইন সংশোধনের মাধ্যমে সংগঠনের বিচারের সুযোগ সৃষ্টি করা হয়েছে। ট্রাইব্যুনালের দেওয়া একাধিক রায়ে জামায়াতকে অপরাধী সংগঠন হিসেবে অভিমত দেওয়া হয়েছে। ট্রাইব্যুনালের এ অভিমত আমাদের সহায়ক হিসেবে কাজ করছে।’

একাত্তরে জামায়াতে ইসলামী, নেজামে ইসলাম, মুসলিম লীগসহ বিভিন্ন সংগঠন স্বাধীনতাযুদ্ধের বিরোধিতা করে। এসব দল পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে সমর্থন দেয় এবং ওই সব রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মী নিয়ে রাজাকার, আলবদর, আলশামস ও শান্তি কমিটি গঠন করার মধ্য দিয়ে ব্যাপক হারে গণহত্যা, হত্যা, ধর্ষণ, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ, ধর্মান্তরকরণ চলে এবং এক কোটিরও বেশি মানুষ দেশান্তর হয়। এসব অপরাধে জড়িত ব্যক্তিদের বিচারের আওতায় আনতে ১৯৭৩ সালের আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইনের অধীনে ২০১০ সালের ২৫ মার্চ ও ২০১২ সালের ২২ মার্চ দুটি ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়।

এ ট্রাইব্যুনালে বিভিন্ন ব্যক্তির বিচার শুরু হয়। ইতিমধ্যে গোলাম আযম, দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী, আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদ, মুহাম্মদ কামারুজ্জামান, আবদুল কাদের মোল্লা ও মাওলানা আবুল কালাম আযাদের বিচার শেষে ট্রাইব্যুনাল রায় দিয়েছেন। জামায়াতের আমির মতিউর রহমান নিজামী, বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী এমপি, আবদুল আলীমসহ আরো বেশ কয়েকজনের বিচার চলছে।

ট্রাইব্যুনাল আইনে ব্যক্তির বিচার করার সুযোগ সৃষ্টি হলেও কোনো সংগঠনের বিচারের সুযোগ ছিল না। এ জন্য সম্প্রতি ব্যাপক গণ-আন্দোলনের মুখে সংবিধানের ৪৭(৩) অনুচ্ছেদ সংশোধনের মাধ্যমে ব্যক্তির পাশাপাশি সংগঠনকেও বিচারের আওতায় আনা হয়।

এরপর গত ১৮ আগস্ট থেকে জামায়াতে ইসলামীর বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা আনুষ্ঠানিকভাবে তদন্ত শুরু করে। ১৯ আগস্ট তদন্ত কর্মকর্তা হিসেবে মো. মতিউর রহমানকে নিয়োগ দেওয়া হয়। তাঁর তদন্ত শেষ হতে আরো দুই মাস সময় লাগতে পারে। এ তদন্ত শেষে ট্রাইব্যুনালে অভিযোগ দাখিল করা হবে।এরপর বিচারপ্রক্রিয়া শুরু হবে। স্যা-প্রমাণ হাজির করা, যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষে রায় পেতে ২০১৪ সাল পর্যন্ত অপো করতে হবে।

গত ১৫ জুলাই ট্রাইব্যুনালের রায়ে গোলাম আযমকে ৯০ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। তবে গোলাম আযমের রায়ে বলা হয়, মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি কারাবন্দি থাকবেন। গোলাম আযমকে মৃত্যুদণ্ড না দেওয়ায় ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিরুদ্ধে সরকার গত ১২ আগস্ট আপিল করে। এ আপিলের সঙ্গে জামায়াতকে নিষিদ্ধ করার জন্যও আবেদন করা হয়েছে। তবে সরকারপ আপিলের সারসংপে এখনো জমা দেয়নি।

সরকারপরে সারসংপে জমা দেওয়ার পর শুনানির দিন ধার্য হবে। গোলাম আযমের মামলায় আপিলের শুনানি করার আগে আরো দুটি মামলায় করা আপিল নিষ্পত্তির জন্য অপো করতে হবে। কারণ প্রধান বিচারপতি মো. মোজাম্মেল হোসেনের নেতৃত্বে আপিল বিভাগের ১ নম্বর বেঞ্চে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় করা আপিলের শুনানি হচ্ছে। এ আদালতে আগে করা আপিল আগে নিষ্পত্তি হবে। সে কারণে প্রথমে জামায়াতের নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী, এরপর মুহাম্মদ কামারুজ্জামনের আপিলের শুনানি হবে। এরপর গোলাম আযমের আপিলের শুনানি। এ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে কয়েক মাস লেগে যেতে পারে।

প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, আগামী ২২ সেপ্টেম্বর থেকে এ বছরে আর মাত্র ৪৪ কার্যদিবস সুপ্রিম কোর্ট খোলা থাকবে। এর মধ্যে চলতি মাসে ১২ কার্যদিবস, অক্টোবরে আট কার্যদিবস, নভেম্বরে ১৯ এবং ডিসেম্বরে ১০ কার্যদিবস আদালত বসবে। এর মধ্যে হরতাল হলে সেই দিনগুলোও কার্যদিবস থেকে বাদ পড়বে।এ ছাড়া আসামিপ শুনানির জন্য সময়ের আবেদন করলে তাতে আপিলের শুনানি আরো পিছিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থেকে যায়।

এসব হিসাবে গোলাম আযমের বিরুদ্ধে করা আপিলে জামায়াত নিষিদ্ধ করার আবেদন নিষ্পত্তি হতে আরো কয়েক মাস লেগে যাবে। সব মিলে এ বছর জামায়াত নিষিদ্ধ করার সরকারি আবেদনের ফল না পাওয়ার আশঙ্কাই বেশি।

উল্লেখ্য, গত ১৫ জুলাই গোলাম আযমের বিরুদ্ধে দেওয়া রায়ের অভিমতে জামায়াতে ইসলামী সম্পর্কে বলা হয়, অসাম্প্রদায়িক ও গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার জন্য সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, সামাজিক ও রাজনৈতিক সংগঠনের নেতৃস্থানীয় পদ থেকে জামায়াতে ইসলামীর সদস্যদের সরিয়ে দিতে সরকারের প্রয়োজনীয় পদপে নেওয়া উচিত।

ওই সব স্থানে স্বাধীনতাবিরোধী লোক থাকা উচিত হবে না। রায়ে আরো বলা হয়, নতুন প্রজন্ম মনে করে, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের জন্মলগ্নে গোলাম আযমের নেতৃত্বে জামায়াতে ইসলামী ও তাদের অঙ্গসংগঠনের সদস্যদের ভূমিকা এবং এর ৪২ বছর পরও তাদের স্বাধীনতাবিরোধী মনোভাব ও সাম্প্রদায়িক মনোভাবের পরিবর্তন হয়নি। এটা জাতির জন্য উদ্বেগজনক।

রায়ে বলা হয়, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে গোলাম আযম তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান (বাংলাদেশ) জামায়াতের প্রধান হিসেবে সর্বোচ্চ নেতৃত্বের আসনে আসীন ছিলেন। তাঁর নিজের ব্যক্তিগত এবং জামায়াতের সাংগঠনিক পরিকাঠামোর মধ্যে আরো যেসব সংগঠন বা বাহিনী ছিল এর প্রতিটির ওপরই তাঁর প্রত্য বা পরো সাংগঠনিক নিয়ন্ত্রণ ছিল।

জামায়াতে ইসলামী ও এর সহযোগী ছাত্রসংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘের সদস্যদের নিয়ে আলবদর, আলশামস ও রাজাকার বাহিনী গঠিত হয়। এ বাহিনী একাত্তরে বুদ্ধিজীবী, নিরস্ত্র বাঙালিদের হত্যায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে সহযোগিতা করে। নিজেরা এসব হত্যা, গণহত্যায় সরাসরি জড়িত ছিল।

এসব বাহিনী সহযোগী বাহিনী (অক্সিলারি ফোর্স) হিসেবে পাকিস্তানি বাহিনীর সব ধরনের মানবতাবিরোধী অপরাধে সহায়তা করেছে, প্রত্য-পরোভাবে জড়িত থেকে নিজেরাও অপরাধ সংঘটন করেছে।এর মধ্যে জামায়াত ও এর ছাত্রসংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘের মাধ্যমেই আদর্শিক ও সাংগঠনিকভাবে অপরাধ হয়েছে সবচেয়ে বেশি।