শনিবার , ২১শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ , ৬ই আশ্বিন, ১৪৩১ , ১৭ই রবিউল আউয়াল, ১৪৪৬

হোম > গ্যালারীর খবর > জাতীয় স্বার্থবিরোধী: টিআইবি ॥ ক্রেস্ট জালিয়াতির অনুসন্ধান বন্ধ, রেহাই পাচ্ছেন জড়িতরা

জাতীয় স্বার্থবিরোধী: টিআইবি ॥ ক্রেস্ট জালিয়াতির অনুসন্ধান বন্ধ, রেহাই পাচ্ছেন জড়িতরা

শেয়ার করুন

বাংলাভূমি২৪ ডেস্ক ॥

ঢাকা: মহান মুক্তিযুদ্ধে অবিস্মরণীয় অবদানের জন্য বিদেশি বন্ধু ও সংগঠনকে দেওয়া সম্মাননা ক্রেস্টে স্বর্ণ জালিয়াতির (পরিমাণে কম দিয়ে আত্মসাৎ) অভিযোগের অনুসন্ধান বন্ধ করে দিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।

অনুসন্ধানে জালিয়াতির তথ্য-প্রমাণ হাতে পাওয়ার পরও বহুল আলোচিত এই অনুসন্ধানের কার্য্যক্রম বন্ধ করে দেয় রাষ্ট্রীয় দুর্নীতি বিরোধী সংস্থাটি। এর মাধ্যমে কার্যত এ দুর্নীতির সঙ্গে জড়িতদের রেহাই দিচ্ছে দুদক।

বৃহস্পতিবার (০৩ ডিসেম্বর) সকালে অনুসন্ধান কার্য্যক্রমের বিষয়টি জানতে চাইলে দুদক চেয়ারম্যান মো. বদিউজ্জামান বাংলানিউজকে বলেন, ‘অভিযোগটি আমরা আপাতত অনুসন্ধান করছি না’। কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এটা মিনিস্ট্রি তাদের মতো করে তদন্ত করছে। তারা করুক’।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকারি অর্থ লোপাট হওয়ায় এ বিষয়ে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার এখতিয়ার দুদকের। সেজন্যই দুদক এ অনুসন্ধান কাজ শুরু করেছিলো। দেশের ও সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করেছে যে ঘটনাটি, তার অনুসন্ধান কাজ বন্ধ করা হলে দুদকের কার্য্যক্রম সমালোচনার মুখে পড়বে বলে তারা মনে করেন।

এদিকে একটি দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, যেসব বিদেশি ‘মুক্তিযুদ্ধ মৈত্রী সম্মাননা’ নামে এ পুরস্কার পেয়েছেন তারাও ইতিমধ্যে জেনে গেছেন, তাদের ক্রেস্টে যে পরিমাণ স্বর্ণ থাকার কথা ছিল তা দেওয়া হয়নি। রুপার বদলে দেওয়া ছিলো পিতল, তামা ও দস্তামিশ্রিত শঙ্কর ধাতু।

মুক্তিযুদ্ধে অবদানের জন্য সম্মাননাপ্রাপ্ত এসব বিদেশিরা এটাও জেনেছেন, এ ঘটনায় বাংলাদেশের দুর্নীতি দমন সংস্থা অনুসন্ধান করছে। তারাও আশা করছেন, এ দুর্নীতিতে যারা জড়িত তাদের বিরুদ্ধে দুদক আইনি ব্যবস্থা নিক। তাদের এমন প্রত্যাশার মুখে বন্ধ হয়ে যায় দুদকের অনুসন্ধান কার্য্যক্রম।

জানা গেছে, দুদকের সংশ্লিষ্ট অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তাকে কমিশন থেকে এ অনুসন্ধান কার্য্যক্রম বন্ধ রাখতে বলা হয়।

অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তা ও দুদকের উপ-পরিচালক মির্জা জাহিদুল আলম মন্তব্য করবেন না জানিয়ে বলেন, ‘অন দ্য রেকর্ড বা অব দ্য রেকর্ড কোনো বক্তব্য আমার নেই। নো কমেন্টস।’

দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, দুদকের অনুসন্ধান টেবিলে ইতোমধ্যে এ জালিয়াতির বেশ কিছু দালিলিক তথ্য এসেছে। এসব তথ্যের ভিত্তিতে অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তা ঘটনায় জড়িতদের জিজ্ঞাসাবাদের প্রস্তুতি নিলে তাকে কমিশন থেকে অনুসন্ধান কার্য্যক্রম বন্ধ রাখতে বলা হয়।

এর মাধ্যমে এ ঘটনায় জড়িতরা দুদকের আইনি ব্যবস্থা থেকে রেহাই পেয়ে যান।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বাংলানিউজকে বলেন, ‘স্বর্ণের ক্রেস্ট জালিয়াতির ঘটনা জাতীয় স্বার্থের সঙ্গে জড়িত। দুদক যদি এ ঘটনায় অনুসন্ধান কার্য্যক্রম বন্ধ করে দেয় এতে তাদের ভাবমূর্তি আরও প্রশ্নবিদ্ধ হবে। দেশকে বিদেশি বন্ধুদের কাছে ছোট করা হবে। এটা হবে জাতীয় স্বার্থবিরোধী’।

তিনি বলেন, ‘ক্রেস্ট জালিয়াতির ঘটনায় বিভাগীয় তদন্ত হতে পারে। কিন্তু দুদকের কাজ দুদক করবে। দুদকের কাজ তো আর মন্ত্রণালয় করবে না। অনুসন্ধানের এখতিয়ার আছে বলেই তো তারা অনুসন্ধান শুরু করেছে। এখন অনুসন্ধান বন্ধ করে দিলে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়তে হবে দুদককে’।

‘এটা সাধারণ দুর্নীতির বিষয় না। এটা ১৬ কোটি মানুষের আবেগের একটি জায়গা। মুক্তিযুদ্ধে অবদানের জন্য আমরা বিদেশি বন্ধুদের ক্রেস্ট দিলাম আর তাতেই ভেজাল ছিলো’- বলেও মন্তব্য করেন ড. ইফতেখারুজ্জামান।

দুদককে ব্যক্তি পরিচয়ের দিকে না তাকিয়ে জাতীয় স্বার্থের দিক চেয়ে গুরুত্ব দিয়ে এ অনুসন্ধান কাজ সুষ্ঠুভাবে শেষ করার পরামর্শ দেন টিআইবি’র অন্যতম এ প্রধান।

দুদকে আসা অভিযোগ সূত্রে জানা গেছে, স্বাধীনতার চার দশক পূর্তি উপলক্ষে বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রনায়ক, রাজনীতিবিদ, দার্শনিক, শিল্পী-সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী, বিশিষ্ট নাগরিক ও সংগঠনকে সম্মাননার সময় দেওয়া ক্রেস্টে যে পরিমাণ স্বর্ণ থাকার কথা ছিল তা দেয়া হয়নি। আর ক্রেস্টে রুপার বদলে দেওয়া হয় পিতল, তামা ও দস্তামিশ্রিত শঙ্কর ধাতু।

পরে জালিয়াতির অভিযোগ উঠলে সাত পর্বে দেওয়া ওই সম্মাননার তৃতীয় পর্বে ৬১ ব্যক্তি ও সংগঠনের জন্য তৈরি করা ক্রেস্ট জাতীয় মান সংস্থা বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশনের (বিএসটিআই) কাছে পরীক্ষার জন্য পাঠায় মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়।

সম্মাননা প্রদান সংক্রান্ত নীতিমালায় বলা ছিল, প্রতিটি ক্রেস্টে ১ ভরি (১৬ আনা) স্বর্ণ ও ৩০ ভরি রূপা থাকবে। কিন্তু মন্ত্রণালয়ের অনুরোধে করা বিএসটিআইয়ের পরীক্ষায় দেখা যায়- এক ভরির (১১ দশমিক ৬৬৪ গ্রাম) জায়গায় ক্রেস্টে স্বর্ণ পাওয়া গেছে মাত্র ২ দশমিক ৩৬৩ গ্রাম বা সোয়া তিন আনা অর্থাৎ এক ভরির মধ্যে প্রায় ১২ আনাই নেই। আর রূপার বদলে দেওয়া হয়েছিল ৩০ ভরি বা ৩৫১ গ্রাম পিতল এবং তামা ও দস্তামিশ্রিত শঙ্কর ধাতু।

দুদকের অনুসন্ধান সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, এমিকন নামের সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানকে একটি ক্রেস্টের জন্য অন্যান্য খরচের সঙ্গে ২ ভরির বেশি (২৩ দশমিক ৫ গ্রাম) স্বর্ণ ও ৩০ ভরি রুপার দাম পরিশোধ করা হয়েছে। আর ৩৩৮টির মধ্যে ৬০টি ছাড়া বাকি সব ক্রেস্ট সরবরাহ করেছে প্রতিষ্ঠানটি।

জানা গেছে, ইন্দিরা গান্ধীকে দেওয়া স্বাধীনতা সম্মাননা ক্রেস্টটি ২ ভরি স্বর্ণ দিয়ে তৈরি করার কথা ছিল। এটিও সরবরাহ করে এমিকন। ২৪ ক্যারেটের (বিশুদ্ধতার সূচক) স্বর্ণ দিয়ে এটি তৈরি করার কথা থাকলেও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় পরমাণু শক্তি কমিশন ওই ক্রেস্টটি পরীক্ষা করে দেখে- তাতে ১০ দশমিক ১১ ক্যারেট স্বর্ণ রয়েছে। আর বাকিটা খাদ।

দুদকে আসা মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের এক প্রতিবেদনে এ জালিয়াতির সঙ্গে মন্ত্রণালয়েরই ১২ কর্মকর্তা জড়িত ছিলেন বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

উপহার তৈরির জন্য নিম্নমানের ধাতব পাত কেনার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের শনাক্তকরণে গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে সাবেক মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী তাজুল ইসলামসহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের আরো ১২ কর্মকর্তার নাম উঠে এসেছে। তারা হলেন— মন্ত্রণালয়ের সচিব মিজানুর রহমান, সাবেক সচিব কেএইচ মাসুদ সিদ্দিকী, অতিরিক্ত সচিব গোলাম মুস্তাফা, যুগ্ম সচিব আবদুল কাশেম তালুকদার, উপ-সচিব এনামুল কাদের খান ও জ্যেষ্ঠ সহকারী সচিব বাবুল মিয়া প্রমুখ।

সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে গত বছরের জুন মাসে ক্রেস্ট জালিয়াতির অভিযোগ অনুসন্ধান শুরু করে অনুসন্ধান শুরু করে দুদক। দুর্নীতির তথ্য-প্রমাণ হাতে আসার পর এ অভিযোগের অনুসন্ধান কার্যত বন্ধ হয়ে যায়। বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম