শনিবার , ২১শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ , ৬ই আশ্বিন, ১৪৩১ , ১৭ই রবিউল আউয়াল, ১৪৪৬

হোম > Uncategorized > চার নদীর ভরাটে দখলে ডুবছে ঢাকা

চার নদীর ভরাটে দখলে ডুবছে ঢাকা

শেয়ার করুন

বাংলাভূমি২৪ ডেস্ক ॥

ঢাকা: প্রকৃতির আশীর্বাদ ছিল ঢাকার ওপর। চারটি নদী এ শহরকে ঘিরে রেখেছে চারদিক দিয়ে। পৃথিবীর খুব কম শহরই আছে এ রকম নদীঘেরা। বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, শীতলক্ষ্যা, বালু- এই চারটি নদী একদিকে যেমন হতে পারত ঢাকাবাসীর প্রয়োজনীয় পানির উৎস, তেমনি আবার হতে পারত শহর থেকে পানি নিষ্কাশনের আধার। তাহলে ঢাকাবাসীর মতো সুখী মানুষ আর কোন শহরে থাকত? কিন্তু দুঃখের বিষয়, তা না হয়ে হয়েছে উল্টোটা। মানুষেরই কোপানলে পড়ে নদীর আশীর্বাদ আজ হয়ে উঠেছে অভিশাপ। দখল আর ভরাট হতে হতে নদী চারটি এখন মৃতপ্রায়। না পারছে শহরবাসীর পানি জোগান দিতে; না পারছে শহরের নিষ্কাশিত পানি ধারণ করতে। তাই পানি বের হওয়ার পথ না থাকায় একটু বৃষ্টিতেই পথ-ঘাট ডুবে, যানজট বেধে ঢাকা হয়ে পড়ছে অচল। দুর্বিষহ হয়ে উঠছে ঢাকাবাসীর জীবন। এমন অবস্থার মধ্যে পড়েও স্বার্থবাজরা মেতে রয়েছে নদী চারটি দখল আর ভরাটের ‘উৎসবে’।

ষাটোর্ধ্ব মো. আবদুল মন্নাছ বুড়িগঙ্গা নদীর কামরাঙ্গীরচর লোহার ব্রিজের ওপর দাঁড়িয়ে বলছিলেন নিজের স্মৃতিবিজড়িত নদী কিভাবে সময়ের বিবর্তনে খালে পরিণত হলো তার গল্প। এক সময়ের মিঠা পানির নদীতে ময়লা-আবর্জনার স্তরের ওপর শত শত ঘরবাড়ি দেখিয়ে বললেন প্রভাবশালী মহলের ক্ষমতার দাপটের কথা। বললেন, এরশাদের শহর রক্ষা বাঁধ, নদীর ওপর সরকারি বেশ কয়েকটি স্থাপনাই নদী দখলের পথকে ত্বরান্বিত করেছে। তবে সবচেয়ে বেশি দখল হয়েছে ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত সরকার ক্ষমতায় আসার পর। সেই সময় রাতারাতি দখলে মেতে ওঠে ক্ষমতাসীন দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীরা। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পরও স্থানীয় প্রভাবশালীরা বসে নেই। তারাও যে যার মতো করে দখল করে নিচ্ছে নদীর অংশ। এদের বিরুদ্ধে উচ্ছেদ অভিযান চললেও তা তেমন কাজে আসে না।

স্থপতি মোবাশ্বের হোসেন বলেন, ‘পৃথিবীতে ঢাকাই একমাত্র রাজধানী শহর, যার চারপাশে চারটি নদী রয়েছে। আমরা ভাগ্যমান যে আমাদের এ চার নদীর পানিই স্বাদু পানি। এদিক দিয়েও আমরা বিশ্বে তৃতীয় স্থানে রয়েছি। কিন্তু দুঃখের বিষয়, এ নদীর পানি আজ খাওয়া তো দূরের কথা; দুর্গন্ধে এর কাছেও যাওয়া যায় না। আবার ভারি বর্ষণে নগরীর পানির রিজার্ভার হিসেবেও কাজে লাগছে না। সরকার দখল-ভরাট ও দূষণকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিলে এসব নদী বাঁচানো সম্ভব হবে না।’

অনুসন্ধানে জানা গেছে, ঢাকার চারপাশের নদী দখলে রয়েছে অর্ধশতাধিক বড় প্রতিষ্ঠান। পিছিয়ে নেই সরকার ও প্রভাবশালীদের একটি অংশ। আর নদী ব্যবস্থাপনা নিয়ে টালবাহানার কারণ হলো সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষগুলোর গাফিলতি ও সমন্বয়হীনতা। জানা যায়, নদীতীরের অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের দায়িত্ব বিআইডাব্লিউটিএর, নদীর পানির মালিক পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়, তলদেশের মালিক ভূমি মন্ত্রণালয় আর পাড়ের মালিক নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় এবং নদীর পানি দূষণরোধের দায়িত্ব পরিবেশ অধিদপ্তরের। কিন্তু ঢাকাঘেরা এই চার নদী নিয়ে তাদের খুব একটা তৎপরতা চোখে পড়ে না। শহর রক্ষাবাঁধের স্লুইস গেটগুলোতে স্থায়ী কর্মী না থাকায় জলাবদ্ধতা দেখা দেয় নদীর আশপাশের এলাকায়। একটু বৃষ্টি হলেই রাজধানী পানিতে তলিয়ে যায়।

সরেজমিনে দেখা যায়, বুড়িগঙ্গার ইসলামবাগ অংশে নদীর ভেতরে প্রায় ২০০ ফুট আর দৈর্ঘ্যে প্রায় ৩০০ ফুট ভরাট করে ১০টি গোডাউন বানানো হয়েছে। সেখানে ভাঙারি মালামালের জন্য ভাড়া দেওয়া হয়েছে। দুই বছর আগে স্থানীয় মনির চেয়ারম্যানের ছেলে নদী দখল করে এ গোডাউন নির্মাণ করেন। আবার বাবুবাজারে বুড়িগঙ্গার শ্মশানঘাট এলাকায় প্রায় তিন বিঘা নদী দখল করে আছেন সেলিম নামের এক প্রভাবশালী। লোহার ব্রিজের পূর্বপাশের অংশে নদী খালের মতো ছোট হয়ে গেছে। এলাকাবাসী জানায়, সেলিম বুড়িগঙ্গা নদী দখল করে বেশ কয়েকটি স্থানে ঘর তুলে ভাড়া দিয়েছে। কামরাঙ্গীরচর লোহার ভাঙা ব্রিজ থেকে সামনের দিকে এগোলে ছোট-বড় শতাধিক অবৈধ স্থাপনা দেখা যায় নদীর অংশে। বুড়িগঙ্গার শাখা নদীর বুকে বালু ফেলে ভরাট করে দখল করে যাচ্ছে প্রভাবশালী মহল।

মোহাম্মদপুর, লালবাগ, হাজারীবাগ ও কামরাঙ্গীরচর এলাকার ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া বুড়িগঙ্গার শাখা নদীর প্রায় ৩৫০ একর দখল হয়ে গেছে। স্থানীয়রা জানায়, বিগত জোট সরকারের আমলে গাবতলী থেকে শুরু করে লালবাগ নবাবগঞ্জ সেকশন পর্যন্ত পশ্চিমের শাখা নদীর বুকে বালু দিয়ে ভরাট করে দখল দেওয়া হয়েছে। হাক্কুল এবাদ লোহার ব্রিজ থেকে ব্যাটারিঘাট, কুড়ারঘাট ও শহীদনগর বালুর ঘাটসংলগ্ন বুড়িগঙ্গার অংশে বালু দিয়ে ভরাট করা হয়েছে। নবাবগঞ্জ, হাজারীবাগ, গাবতলী, মিরপুর হয়ে টঙ্গী ব্রিজ পর্যন্ত বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ নির্মাণ করায় বাঁধটির ভেতরে বুড়িগঙ্গার বিশাল এলাকা পড়ে যায়। এ জমির পুরোটা বেদখল হয়ে গেছে। সোয়ারীঘাট থেকে দক্ষিণ-পশ্চিমে বড়গ্রাম, কুড়ারঘাট, পূর্ব রসুলপুর, পশ্চিম রসুলপুর এলাকা ঘেঁষে বুড়িগঙ্গা নদীর একটি শাখা বেরিয়ে গেছে; লালবাগ, নওয়াবগঞ্জ বড় মসজিদ ঘাট বেড়িবাঁধ বাজার, হাজারীবাগের ট্যানারি, রায়েরবাজার, বসিলা, কাটাসুর হয়ে আবার মূল নদীতে এসে পড়েছে। এতে সিটি করপোরেশনে ময়লা-আবর্জনা ফেলে ভরাটের পর তা দখল হয়ে গেছে। কামরাঙ্গীরচর ২ নম্বর পূর্ব রসুলপুর হাফেজ মুসা পাকা ব্রিজ ঘেঁষে নদী দখল করে দোকানপাট বসানো হয়েছে। নওয়াবগঞ্জ সেকশন ও কামরাঙ্গীরচর রনি মার্কেট সংযোগস্থলে পাকা ব্রিজ ঘেঁষে নদীর অংশ দখল করে মার্কেট ও বসতঘর করা হয়েছে। এর পাশে মেটাডোর কম্পানি নদীতে বালু ফেলে ভরাট করে বানিয়েছে ফ্যাক্টরি। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন আবার রায়েরবাজার এলাকায় নদীর বিশাল এলাকাজুড়ে আধুনিক কবরস্থান নির্মাণ করছে।

শীতলক্ষ্যায় থাবা বালু ব্যবসায়ীদের: শীতলক্ষ্যা নদীর অংশেও পড়েছে দখলদারদের থাবা। কয়েকটি প্রতিষ্ঠান অল্প জমি কিনে পরে বালু ও মাটি ফেলে নদীর জায়গা ভরাট করে। স্থানীয় এক বাসিন্দা জানান, শীতলক্ষ্যা নদীর তীর দখল করে বালু ব্যবসায়ীরাই মূল দখলকারী। দুই বছর আগে নদী দখলের অভিযোগে ১৭ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেছিল বিআইডাব্লিউটিএ। মামলায় আসামিদের বিরুদ্ধে হাইকোর্টের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করা, সরকারি জমি দখল করে বালুর ব্যবসা করাসহ নদী ও পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ভঙ্গ করার অভিযোগ আনা হয়েছে।

দখলে দখলে বিপন্ন তুরাগ : প্রায় ৪৩টি ছোট-বড় ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, ৪০টি বালুমহাল এবং শতাধিক ব্যক্তির দখলে থাকলেও মূলত মোটাদাগে ১০টি প্রতিষ্ঠানই তুরাগ নদ দখলের শীর্ষে। এসব প্রতিষ্ঠানের বেশির ভাগই কনস্ট্রাকশনের (রেডিমিক্স) কারখানা। এর মধ্যে গত কয়েক বছরের ব্যবধানে প্রায় বড় পাঁচটি প্রতিষ্ঠান নতুন করে নদী দখল করেছে। এ ছাড়া দিয়াবাড়ী থেকে আশুলিয়া হয়ে টঙ্গী ব্রিজ পর্যন্ত ৪০টি বালুমহাল রয়েছে, যার প্রতিটিই তুরাগ নদের মধ্যে ১৫০ থেকে ২০০ ফুট দখল করেছে। বড় প্রতিষ্ঠান ছাড়াও সমবায় সমিতি, ছোট মার্কেট, মাছের খামার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কিছু অংশও রয়েছে নদীর জায়গায়।

মিরপুর দ্বিগুন মৌজায় মির্জা মৎস্য খামার নামের একটি সাইনবোর্ড টাঙানো হয়েছে। এ খামারের পক্ষ থেকে মাটি ফেলে বিশাল আকৃতির একটি মৎস্য খামার তৈরি করা হয়েছে, যার পুরোটাই হয়েছে পিলারের ভেতরে অর্থাৎ তুরাগের অংশে। এ মৎস্য খামার করেছেন গাবতলী এলাকার বাসিন্দা মির্জা ইকবাল হোসেন। নদের পিলারের ভেতরে আরো ৩০ ফুট দখল করে রেখেছে টাইগার রেজিস্ট্রেশন ওয়ার্ল্ড; রুস্তমপুরে সোনার বাংলা স্টোন ক্রাশার এবং শারফিন ট্রেডিং সিন্ডিকেট নামের একটি প্রতিষ্ঠান প্রায় ২০টি সীমানা পিলার ভেঙে ৪০ ফুট তুরাগ দখল করেছে। ভূমি মন্ত্রণালয়ের এক তদন্ত প্রতিবেদনেও তুরাগ নদ দখলকারী কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের নাম উঠে এসেছে। নদীর সীমানা পিলার বসানোর ক্ষেত্রে আদালতের নির্দেশনা মানা হয়নি বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। এ ছাড়া কাউন্দিয়া মৌজায় ১৫০ থেকে ১৭০ ফুট অভ্যন্তরে এবং ভাটুলিয়া মৌজায় ৮০ থেকে ১০০ ফুট ভেতরে সীমানা পিলার স্থাপন করা হয়েছে।

দখলদারদের জন্য নদী সংকুচিত হওয়ায় বিরুলিয়া এলাকায় পাশাপাশি একাধিক নৌযান চলারও সুযোগ হারাচ্ছে বলে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। তুরাগ থানার ভাটুলিয়ায় আবদুল্লাহপুর-আশুলিয়া সড়কসংলগ্ন এলাকায় আনুমানিক ১০০ ফুট দখল করা হয়েছে। এখানে প্রস্তাবিত মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের নামে ভরাট করা হয়েছে। আশুলিয়া-মিরপুর সংযোগ সড়ক থেকে নদীর পূর্ব প্রান্তে সিমরান কম্পোজিট লিমিটেড ও জারা নিট কম্পোজিট লিমিটেড নামে দুটি প্রতিষ্ঠান নদীর অংশ ভরাট করেছে।

সরেজমিন উত্তরা স্লুইসগেটে গিয়ে নদীর তীরবর্তী এলাকায় শত শত অবৈধ দখলদার দেখা যায়। দোকানপাট, কাঁচাবাজার, মাছের আড়ত, মিল-কারখানা, হাসপাতাল, মেডিক্যাল কলেজ, আবাসন কম্পানি থেকে শুরু করে মসজিদ, মাদ্রাসা, বালুর গদি, পরিবহন কম্পানির বাস ডিপো, মেরামত কারখানা- সব কিছুই তুরাগ নদকেন্দ্রিক। এসব স্থাপনা থেকে প্রতিদিন শত শত টন বর্জ্য নদের পানিতে মিশে ভরাটদূষণ চলছে। স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, রাস্তার জন্য বেড়িবাঁধের জমি লিজ দেওয়ার কারণেই নদীর জায়গা দখল ও ভরাটের কাজটি ত্বরান্বিত হয়েছে। তা না হলে এত ব্যাপক হারে স্থাপনা নির্মাণ করা হতো না।

টঙ্গী ব্রিজ থেকে পূর্ব দিকে তুরাগ নদের দুই পাশে সামান্য এলাকা পাকা করে ওয়াকওয়ে তৈরি করা হয়েছে। কিন্তু কিছুদিনের ব্যবধানে সে ওয়াকওয়ে হুমকির মুখে পড়েছে। সেখানে ময়লা-আবর্জনা এবং নির্মাণসামগ্রী রেখে পথচারীদের পথ রুদ্ধ করা হচ্ছে। অনেকে দোকানের মালপত্র ওয়াকওয়েতে রেখে ব্যবসা করছে। তবে টঙ্গী কাঁচাবাজারের দিকের ওয়াকওয়ে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে। সেখানে কাঁচাবাজার থেকে প্রতি দিন টনের পর টন বর্জ্য ফেলে তুরাগ নদ ভরাট করে ফেলা হচ্ছে।

ধউর ল্যান্ডিং স্টেশনের ১০০ গজ দক্ষিণে তুরাগের বিশাল এলাকাজুড়ে মাটি ভরাটের কাজ করছে দেশের একটি স্বনামধন্য শিল্প গ্রুপ। কামারপাড়া, তালতলা, বিরুলিয়া, ধউরসহ আরো অনেক এলাকায় বিভিন্ন সিমেন্ট ও রেডিমিক্স কম্পানি কারখানা তৈরি করে দখল করেছে।

কামারপাড়ায় পাউবোর জমিতে অবৈধভাবে একটি মেডিক্যাল কলেজ, ফিলিং স্টেশন এবং একটি ক্যান্সার হাসপাতাল নির্মাণ করা হয়েছে। বেড়িবাঁধ-সংলগ্ন বিরুলিয়া এলাকায় প্রিয়াংকা উদ্যান, বৃদ্ধাশ্রমসহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের সাইনবোর্ড চোখে পড়ে। বিরুলিয়া গ্রামের বাসিন্দা ইউনুস কাজী বলেন, ‘প্রিয়াংকা নামের প্রতিষ্ঠানটির সিংহভাগ জমি তুরাগ নদের। একসময় এখানে সাহা জমিদারদের গোচারণভূমি ছিল। জাল দলিলপত্র দিয়ে প্রিয়াংকা এসব জমির মালিকানা দাবি করছে।’

মরণদশা বালুর : বালু নদীর নাব্যতা এখন নেই বললেই চলে। দখলে-দূষণে নদীটি বর্তমানে মৃতপ্রায়। বর্ষায় এতে কিছু পানি থাকলেও শুকনো মৌসুমে হেঁটেই নদী পার হওয়া যায়। পানি আলকাতরার মতো কালো হয়ে যায়। রামপুরা খাল দিয়ে ঢাকা নগরীর শত শত টন ময়লা-আবর্জনা এ নদীতে পড়ছে। ফলে ভরাট হয়ে যাচ্ছে নদীর তলদেশ।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, পশ্চিমগাঁও, নাওরা, কায়েতপাড়া, ধীৎপুর দক্ষিণপাড়া ও কেওঢালা গ্রামের অনেক স্থানে বালু নদীর তীরবর্তী স্থান দখল-ভরাট করে বাড়িঘর নির্মাণ করা হয়েছে। স্থানীয় লোকজন জানায়, বালু নদীর নড়াইমুখ এলাকায় সবচেয়ে বেশি দখল-ভরাট হচ্ছে। এখানে অনেকটা প্রতিযোগিতা করে নদী দখল হচ্ছে; কিন্তু বাধা দেওয়ার কেউ নেই। পশ্চিমগাঁওয়ের বাসিন্দা আবুল কালাম বলেন, ‘এলাকার লোক মনে করে, নদীর কোনো মালিক নেই। তা দখল করলে কেউ ধরতে আসবে না।’

পাউবোর জমি হাতছাড়া : পাউবো সূত্রে জানা যায়, সমন্বিত বন্যা প্রতিরোধ প্রকল্পের জন্য সরকার এক হাজার ৯২৬ দশমিক ৬ বিঘা জমি বিভিন্ন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান থেকে অধিগ্রহণ করে। এর মধ্যে ৫৩৫ দশমিক ৫০ বিঘাই পাউবোর হাতছাড়া হয়ে গেছে, যার বাজারমূল্য প্রায় দুই হাজার কোটি টাকা।

পাউবোর এক তদন্ত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, নদ-নদীর তীরবর্তী বেড়িবাঁধের ১৭৮ দশমিক ৫০ একর অব্যবহৃত জমি এবং বাঁধ ও স্থায়ী কাঠামোর ওপরে বা সন্নিকটে বিভিন্ন জবরদখল অবস্থায় বিদ্যমান আছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

এ ছাড়া এক হাজার ৮১ জন অবৈধ দখলদারের একটি তালিকা করা হয়েছে, যা ঢাকা জেলা প্রশাসনকে দেওয়া হয়েছে।

সূত্র জানায়, অবৈধ দখলদারদের তালিকা এবং মাঝেমধ্যে কিছু নোটিশ ও থানায় সাধারণ ডায়েরি করেই পাউবোর পক্ষ থেকে দায়িত্ব শেষ করা হয়।

বেড়িবাঁধ-সংলগ্ন বসবাসরতদের কাছ থেকে অভিযোগ উঠেছে, সংযোগ সড়ক নির্মাণের নামে একসনা লিজ ব্যবস্থার কারণেই পাউবোর হাজার হাজার কোটি টাকার জমি হাতছাড়া হয়ে গেছে। সড়ক নির্মাণের নামে সামান্য এক টুকরো জমি লিজ নিয়েই অবৈধ দখল শুরু হয়। তুরাগ থানাধীন ধউর গ্রামের বাসিন্দা মোশাররফ হোসেন খান বলেন, ‘পাউবোর কর্মকর্তা ও প্রকৌশলীদের যোগসাজশেই নদ-নদীর শত শত বিঘা সরকারি জমি দখলদার চক্রের হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে।’

জানা যায়, হাইকোর্টের নির্দেশনা (রিট পিটিশন নম্বর ৩৫০৩/২০০৯) অনুযায়ী অবৈধ দখলদারমুক্ত করে নদ-নদী রক্ষা করা সম্ভব হচ্ছে না নানা জটিলতার কারণে। বরং নদ-নদীতে সীমানা পিলার নির্মাণ করে ঢাকার পার্শ্ববর্তী অনেক নিচু জমি নির্বিচারে ভরাট করার সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে। এর ফলে নগরীর পানি সংরক্ষণাগার হিসেবে পরিচিত তুরাগ নদ ও বালু নদী সংকুচিত হয়ে যাচ্ছে।

রাজউক সূত্রে জানা যায়, আশুলিয়া এলাকাটি পানি সংরক্ষণের জন্য সংরক্ষিত। এ কারণে সেখানে কোনো আবাসন কম্পানির অনুমোদন দেওয়া হচ্ছে না।

অনেকেই সেখানে শত শত বিঘা জমি কিনে আবাসন কম্পানি করার পরিকল্পনা করেছিল। এ কারণে তাদের প্রকল্প বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু আবাসন কম্পানিগুলোর আশপাশে শত শত মিল-ফ্যাক্টরি, বাড়িঘর নির্মাণ করা হলেও কেউ বাধা দিচ্ছে না। এর ফলে তুরাগ নদ এবং আশুলিয়ার বিস্তীর্ণ নিচু এলাকা ভরাট হয়ে যাচ্ছে।

এ বিষয়ে পানিসম্পদমন্ত্রী ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ বলেন, ‘পাউবোর বেদখল হওয়া নদ-নদীর সম্পত্তি উদ্ধারের জন্য সব রকম ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। এ জন্য প্রয়োজনীয় বাজেট দেওয়া হবে। এ কাজ ত্বরান্বিত করার জন্য পাউবোর পরিচালনা বোর্ডকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। কোনো অবৈধ দখলদার উচ্ছেদের জন্য মন্ত্রণালয়ের অনুমতির কোনো প্রয়োজন নেই। এ ক্ষমতা পাউবোর রয়েছে।’ বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম