রবিবার , ২২শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ , ৭ই আশ্বিন, ১৪৩১ , ১৮ই রবিউল আউয়াল, ১৪৪৬

হোম > Uncategorized > ঘুরে দাঁড়ানো ‘সহজ’ নয় বিএনপির

ঘুরে দাঁড়ানো ‘সহজ’ নয় বিএনপির

শেয়ার করুন

বাংলাভূমি২৪ ডেস্ক ॥

ঢাকা : আন্দোলনের ব্যর্থতার পর হামলা-মামলায় জর্জরিত বিএনপি আসন্ন কাউন্সিলের মধ্য দিয়ে ঘুরে দাঁড়াতে চায়। কেন্দ্রসহ সারা দেশের সংগঠন গুছিয়ে সময়মতো জনসম্পৃক্ত ও কার্যকরী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে নির্দলীয় সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচনের দাবি আদায় করাই তাদের লক্ষ্য।

মামলায় জর্জরিত দলীয় নেতা-কর্মীদের আপাতত আর নতুন করে মামলার মুখে ঠেলে দিতে চায় না বিএনপি। এজন্য তারা আন্দোলন থেকেও আপাতত সরে এসেছে। সংগঠন গোছানোকেই এখন সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে বিএনপি।

তবে নানা সঙ্কটে জর্জরিত বিএনপির ঘুরে দাঁড়ানো নিয়ে সংশয়ে রয়েছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। তারা মনে করেন, এ লক্ষ্যে বিএনপির অভ্যন্তরে ও জোট রাজনীতিতে ব্যাপক সংস্কার প্রয়োজন। অন্যথায় তরী যে কিনারে ছিল সেখানেই থেকে যাবে।

আসন্ন ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনে দলীয় চেয়ারম্যান প্রার্থীদের মনোনয়নপত্র জমাদানে ব্যাপকহারে বাধা দেয়ার অভিযোগ করলেও শেষ পর্যন্ত নির্বাচনী লড়াইয়ে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএনপি। কাউন্সিল ও ইউপি নির্বাচনকে কেন্দ্র করে নেতা-কর্মীদের আত্মগোপন থেকে বেরিয়ে এসে স্বাভাবিক কার্যক্রমে ফেরার অবস্থা ধরে রাখতে চায় দলটি।

২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জন করে তা প্রতিহতে আন্দোলনে নামে বিএনপি। কিন্তু নির্বাচন প্রতিহত করতে ব্যর্থ হয় দলটি। ফলে আন্দোলন চলাকালে ও পরবর্তীতে সারা দেশের নেতা-কর্মীরা আত্মগোপনে চলে যায়, বন্ধ হয়ে যায় দলীয় কার্যালয়গুলোও।

ধীরে ধীরে এ অবস্থার পরিবর্তন হলে সারা দেশে বিএনপি ও ২০ দলীয় জোট গণসংযোগসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করে। এর মধ্য দিয়ে পরিপূর্ণ স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসতে না আসতেই দশম জাতীয় নির্বাচনের বর্ষপূর্তিকে কেন্দ্র করে দেশব্যাপী আবারও অনির্দিষ্টকালের অবরোধ কর্মসূচিতে নামে বিএনপি।

বিএনপির ওই কর্মসূচিকে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা ‘হটকারী সিদ্ধান্ত’ হিসেবেই আখ্যায়িত করেন। ৯২ দিনের ওই আন্দোলনের ফলে নেতা-কর্মীরা আবারও আত্মগোপনে চলে যান। চরম বিপর্যয়ের মুখে পড়ে দলটি। আন্দোলন চলাকালে জ্বালাও-পোড়াও, পেট্রোল বোমা নিক্ষেপের মাধ্যমে মানুষ হত্যার ঘটনায় দেশে-বিদেশে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়ে বিএনপি। তবে দলটির পক্ষ থেকে এ অভিযোগ বার বার অস্বীকার করা হলেও সরকারের প্রচার-প্রপাগাণ্ডায় তা প্রমাণ করতে ব্যর্থ হয় বিএনপি।

এরই মধ্যে সরকার তিন সিটি (ঢাকা উত্তর-দক্ষিণ ও চট্টগ্রাম) করপোরেশন নির্বাচনের ঘোষণা দিলে ব্যর্থ আন্দোলন থেকে মুখ রক্ষায় দ্রুত শর্তহীনভাবে সে নির্বাচনে অংশ নেয় বিএনপি। তবে ব্যাপক কারচুপির অভিযোগ এনে নির্বাচন বর্জন করলেও কঠোর কোনো কর্মসূচিতে যায়নি দলটি।

পৌর নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপির অভিযোগ করলেও তখনও কোনোরকম আন্দোলনের কর্মসূচিতে যায়নি তারা। এর মধ্য দিয়ে বিএনপি প্রমাণ করেছে, তারা সরকারবিরোধী আন্দোলনের চেয়ে বিপর্যস্ত দলকে গোছানোর দিকেই মনোযোগী হতে চায়। বিষয়টি উপলব্ধি করে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দ্বিতীয় বর্ষপূতিতে সরকার বিএনপিকে রাজধানীতে সমাবেশের অনুমতি দেয় বলে মনে করেন রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা।

এরই মধ্যে একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধে দলের স্থায়ী কমিটির প্রভাবশালী সদস্য সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী এবং জোটের প্রভাবশালী শরিক জামায়াতের শীর্ষ নেতা আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদ ও মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের ফাঁসির রায় কার্যকর হয়। বিএনপি বিচারের বিরোধী নয় দাবি করলেও এ বিষয়টিতে কখনওই অবস্থান সুস্পষ্ট করেনি। ফলে দেশে-বিদেশে দলটিকে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়তে হয়।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, বিপর্যস্ত বিএনপির এমন পরিস্থিতিতে ঘুরে দাঁড়ানো মোটেই সহজ হবে না। এজন্য দলটির অভ্যন্তরে ও জোটের রাজনীতিতে ব্যাপক সংস্কার প্রয়োজন। সর্বপ্রথম একাত্তরের বিতর্কিত ভূমিকার কারণে দেশে-বিদেশে সমালোচিত ও আদালতের রায়ে নিবন্ধন বাতিল হওয়া জামায়াতে ইসলামীর বিষয়ে বিএনপির অবস্থান পরিষ্কার করতে হবে। এ ক্ষেত্রে ভারত ও পাশ্চাত্যের বন্ধু রাষ্ট্রগুলোর পক্ষ থেকে জামায়াতের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করতে বিএনপির ওপর ব্যাপক চাপ অব্যাহত রয়েছে। এমনকি দল ও জোটের ভেতরের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তিসমূহও জামায়াতের সাথে বিএনপির আঁটঘাট বাধাকে ভাল চোখে দেখে না। প্রকাশ্যে সমালোচনা না করলেও ভেতরে ভেতরে ক্ষুব্ধ তারা।

আন্তর্জাতিক বিশ্ব যখন মৌলবাদবিরোধী অবস্থানে তখন হেফাজতের মতো একটি মৌলবাদী সংগঠনের আন্দোলনকে বিএনপি সমর্থন করায় দলটির দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বন্ধুরা ক্ষুব্ধ ও বিস্মিত হন। এ বিষয়েও বিএনপিকে তার অবস্থান সুস্পষ্ট করতে হবে।

সংখ্যাতত্ত্ব ঠিক রাখতে গিয়ে জোট থেকে বেরিয়ে যাওয়া দলগুলোর খণ্ডাংশকে জোটে রাখা নিয়ে দল ও জোটের ভেতরে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়ে বিএনপি। অনেক নেতাই মনে করেন, রাজনীতিতে এটি একটি অপসংস্কৃতি। এ থেকে বিএনপিকে বেরিয়ে আসতে হবে। জামায়াতের সাথে সম্পর্কছিন্ন এবং খণ্ডাংশ, অনিবন্ধিত ও অস্তিত্বহীন দলগুলোকে বাদ দিয়ে বিএনপির ‘প্রকৃত জাতীয়তাবাদী ফ্রন্ট’ গঠন করা উচিত বলে মনে করে সুধীমহল।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা আরও মনে করেন, বিএনপির চেয়ারপারসন গুলশান কার্যালয়কেন্দ্রিক একটি সিন্ডিকেট দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। এই নিয়ন্ত্রণ থেকে তাকে মুক্ত হতে হবে। দল ও জোটের রাজনৈতিক বৈঠকগুলো দিনের মধ্যে সম্পন্ন করা উচিত। দলীয় ও জোটপ্রধান হিসেবে তাকে নেতা-কর্মীদের সহজে দেখা-সাক্ষাতের সুযোগ করে দিতে হবে। সপ্তাহে অন্তত দু’দিন নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে তার অবস্থান করা উচিত। একইসঙ্গে নেতা-কর্মীদের হতাশা কাটিয়ে উঠতে গণমুখী ও কার্যকর কর্মসূচি নিয়ে বিএনপির চেয়ারপারসনকে সারা দেশ সফর করতে হবে।

দলীয় কর্মসূচি নির্ধারণে দ্বি-কেন্দ্রিক (লন্ডন ও ঢাকা) নির্দেশনা বন্ধ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে বিএনপির ‘নবনির্বাচিত’ সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে দলের পক্ষ থেকে সুনির্দিষ্ট দায়িত্ব প্রদান করতে হবে।

এছাড়া তৃণমূলের নেতা-কর্মীরা যাতে তাদের সুখ-দুঃখের কথা দলীয় প্রধানকে অবহিত করতে পারে সেজন্য দলের মহাসচিবকে জেলা-উপজেলা পর্যায়ে ঘন ঘন সফরে যেতে হবে। জোটের কার্যক্রমকে গতিশীল করতে দলের একজন সিনিয়র নেতাকে জোটের সমন্বয়কের দায়িত্ব দিয়ে বেশি বেশি বৈঠকের ব্যবস্থা করতে হবে। জোটপ্রধান ও মহাসচিবের মাসে অন্তত দুইবার জোট নেতাদের সঙ্গে মতবিনিময় করা উচিত।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, বিএনপিকে সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী করতে সারা দেশের মহানগর-জেলা-উপজেলা সম্মেলনগুলো যথাসময়ে সম্পন্ন করা এবং দলের অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনগুলোর কমিটিও নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে পুনর্গঠন করা উচিত। বিশেষ করে দলের ভ্যানগার্ড হিসেবে পরিচিত ছাত্র ও যুব সংগঠন পুনর্গঠনের ক্ষেত্রে ‘সময় ও প্রেক্ষাপট’কে গুরুত্ব দেয়া। সেক্ষেত্রে প্রকৃত ছাত্রদেরকেই ছাত্র সংগঠনের নেতৃত্বে আনতে হবে। অন্যদিকে, যুব সংগঠনের ক্ষেত্রেও কর্মক্ষম ও মেধাবীদের দায়িত্বে আনা উচিত।

এছাড়া মূল দলসহ সকল অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের ক্ষেত্রে ‘এক নেতার এক পদ’ বাস্তবায়ন করতে হবে। এটা করা সম্ভব হলে একদিকে যেমন নেতৃত্বের বিকাশ ঘটবে, অন্যদিকে তেমনি দলও সুসংগঠিত হবে। ফলে দলে প্রতিষ্ঠিত হবে ‘চেইন অব কমান্ড’।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জেনারেল (অব.) মাহবুবুর রহমান বলেছেন, বিএনপিকে ঘুরে দাঁড়াতে দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া নিশ্চয় দল পুনর্গঠনে কাউন্সিলের মধ্য দিয়ে মেধাবী, ত্যাগী ও যোগ্যদের নেতৃত্বে আনবেন। প্রবীণ ও তরুণদের সমন্বয়ে দলের নেতৃত্ব সাজাবেন।

তিনি আরও বলেন, বিএনপির চেয়ারপারসন কাউন্সিল পরবর্তীতে জনগণের আকাঙ্ক্ষিত কর্মসূচির মাধ্যমে দেশের সকল গণতান্ত্রিক শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ করে চলমান গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে নিয়ে যাবেন।