শনিবার , ২১শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ , ৬ই আশ্বিন, ১৪৩১ , ১৭ই রবিউল আউয়াল, ১৪৪৬

হোম > গ্যালারীর খবর > গোলাম আযমের ৯০ বছর কারাদণ্ড

গোলাম আযমের ৯০ বছর কারাদণ্ড

শেয়ার করুন

স্টাফ রিপোর্টার ॥ শেষ হলো প্রতীার। অধ্যাপক গোলাম আযমের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় ঐতিহাসিক রায় ঘোষণা করলো ট্রাইব্যুনাল। রায়ে ৯০ বছর কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে বহুল আলোচিত-সমালোচিত জামায়াতের এই সাবেক আমীরকে। এ সময় অথবা আমৃত্যু কারাভোগ করতে হবে তাকে। তার বিরুদ্ধে
মানবতাবিরোধী অপরাধের পরিকল্পনা, ষড়যন্ত্র, উস্কানি, পাকিস্তানি সেনাদের সাহায্য করা এবং হত্যা-নির্যাতনে বাধা না দেয়ার ৫ ধরনের অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে। তাকে প্রথম অভিযোগের জন্য ১০ বছর, দ্বিতীয় অভিযোগের জন্য ১০ বছর, তৃতীয় অভিযোগের জন্য ২০ বছর, চতুর্থ অভিযোগের জন্য ২০ বছর ও পঞ্চম অভিযোগের জন্য ৩০ বছর কারাদণ্ড দেয়া হয়। ট্রাইব্যুনাল বলেছেন, মৃত্যুদণ্ড প্রাপ্য হলেও বয়স ও স্বাস্থ্যগত দিক বিবেচনায় তাকে কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে। গোলাম আযমের মামলাটিকে ব্যতিক্রম হিসেবে আখ্যায়িত করেছে ট্রাইব্যুনাল। মুক্তিযুদ্ধের সময় জামায়াত অপরাধী সংগঠন হিসেবে কাজ করেছে বলেও রায়ে বলা হয়েছে। বিচারপতি এটিএম ফজলে কবীরের নেতৃত্বাধীন ট্রাইব্যুনাল-১ গতকাল দুপুরে চূড়ান্ত রায় ঘোষণা করে। বেঞ্চের অন্য দুই সদস্য ছিলেন বিচারপতি মো. জাহাঙ্গীর হোসেন এবং বিচারপতি মো. আনোয়ারুল হক। রায় ঘোষণার সময় সাদা ধূসর নীল রঙের চেক লুঙ্গি-পাঞ্জাবি ও টুপি পরা ৯১ বছর বয়সী গোলাম আযম কাঠগড়ায় উপস্থিত ছিলেন। রায়ের খবর আসা মাত্রই ট্রাইব্যুনালের ফটকে উপস্থিত মুক্তিযোদ্ধারা রায় প্রত্যাখ্যান করে স্লোগান দেন। তারা এ রায়কে সমঝোতার রায় হিসেবে অভিহিত করেন। প্রগতিশীল ছাত্র মোর্চা ও গণজাগরণ মঞ্চ এ রায় প্রত্যাখ্যান করে আজ সারা দেশে সকাল-সন্ধ্যা হরতাল ডেকেছে। রায় প্রত্যাখ্যান করেছে জামায়াতে ইসলামীও। তারাও আজ সারা দেশে হরতাল আহ্বান করেছে। তবে সরকার ও আওয়ামী লীগের প থেকে রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করা হয়েছে। আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বলেছেন, রায় সঠিক ও স্বচ্ছ হয়েছে। আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আনম হানিফ সবাইকে ধৈর্য ধারণের আহ্বান জানিয়েছেন। প্রসিকিউশন রায়ে হতাশা ব্যক্ত করেছে। গোলাম আযমের প্রধান আইনজীবী ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাক রায়ে অসন্তোষ প্রকাশ করে এ রায়ের বিরুদ্ধে আপিল দায়েরের ঘোষণা দিয়েছেন।
রায়ের মূল অংশ পড়ার সময় বিচারপতি এটিএম ফজলে কবীর বলেন, অধ্যাপক গোলাম আযমের বিরুদ্ধে চার্জে উল্লিখিত প্রত্যেকটি অপরাধ প্রমাণিত হয়েছে। মৃত্যুদণ্ডই এ অপরাধের সর্বোচ্চ শাস্তি। কিন্তু তার বয়স বর্তমানে ৯১ বছর। শারীরিকভাবেও তিনি অসুস্থ। এ কারণে ঢাকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি চিকিৎসাধীন আছেন। এ অবস্থা বিবেচনা করে তাকে কারাদণ্ড দেয়া হলো। এর আগে রায় ঘোষণাকে কেন্দ্র করে পুরো ট্রাইব্যুনাল এলাকাকে নিরাপত্তা চাদরে ডেকে ফেলা হয়। আইন-শৃঙ্খলা রাকারী বাহিনীর বিপুল সংখ্যক সদস্য পুরো এলাকা কর্ডন করে ফেলে। সকাল ১০টা ৫ মিনিটে গোলাম আযমকে কড়া নিরাপত্তায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ)’র প্রিজন সেল থেকে  ট্রাইব্যুনালে আনা হয়। হুইল চেয়ারে বসা জামায়াতের এই সাবেক আমীরকে কিছুণ পর হাজতখানা থেকে তাকে ট্রাইব্যুনালের কাঠগড়ায় হাজির করা হয়। ঘড়ির কাঁটায় তখন সকাল ১০টা ৪৬ মিনিট। বিচারপতি এটিএম ফজলে কবীরের নেতৃত্বে অন্য দুই বিচারক এজলাসে আসন গ্রহণ করেন। এরই মধ্যে কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে যায় এজলাস ক। শিক, সাংবাদিক, সাহিত্যিক, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, মুক্তিযোদ্ধা সহ বিপুল সংখ্যক মানুষ রায়ের জন্য অধীর আগ্রহে অপো করছিলেন। পিনপতন নীরবতায় ১০টা ৫৬ মিনিটে ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি এটিএম ফজলে কবীর রায় ঘোষণার আগে তার বক্তব্য শুরু করেন। এ সময় তিনি বলেন, আজ একটি বিশেষ মামলার রায় ঘোষণার দিন। যার বিরুদ্ধে রায় ঘোষণা করা হবে তিনি বাংলাদেশের একজন অতি সুপরিচিত ব্যক্তি। বিশেষ করে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান জামায়াতের আমীর ও তখনকার শান্তি কমিটির একজন প্রভাবশালী নেতা হিসেবে তিনি পরিচিত। প্রসিকিউশন মামলায় তার বিরুদ্ধে ৫টি অভিযোগ দাখিল করেছে। তিনি বলেন, এই মামলায় বিশেষ কিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে। এটা স্বীকৃত যে, ১৯৭১ সালে অধ্যাপক গোলাম আযম জামায়াতে ইসলামের একজন নেতৃস্থানীয় নেতা ছিলেন। জামায়াতে ইসলামের সদস্যদের নিয়ে গঠিত বিভিন্ন বাহিনী পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর সহায়তায় হত্যা, গণহত্যা, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ, নির্যাতন, লুণ্ঠন সহ নানা অপরাধ করেছে। প্যারামিলিশিয়া বাহিনী ও অক্সিলারি ফোর্স হিসেবে তারা তখন কাজ করেছে। ট্রাইব্যুনাল বলেন, যে কোন সম্মিলিত অপরাধ কর্মকাণ্ড বন্ধ করার জন্য হাই অথরিটির সিগন্যাল, আদেশ প্রয়োজন। দলের কর্তৃত্ব তখন ছিল তার (গোলাম আযম) হাতে। কিন্তু তিনি বাহিনীর সদস্যদের অপরাধ করতে কোন বাধা দেন নাই। নিষেধ করেন নাই। ফলে সুপিরিয়র রেসপন্সিবিলিটি ও দলের নেতা হিসেবে এই দায়ভার তার ওপর বর্তায়। যা ১৯৭৩ সালের আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইনের ৪(২) ধারার অপরাধ। তবে আসামির বিরুদ্ধে এমন কোন অভিযোগ প্রমাণ করা যায়নি যে, তিনি এসব ঘটনায় প্রত্যভাবে উপস্থিত ও জড়িত ছিলেন। ট্রাইব্যুনাল বলেন, প্রসিকিউশন ঘটনার সময়কার বিভিন্ন দৈনিক পত্রিকার কপি দাখিল করেছেন। পত্রিকায় গোলাম আযম কখন কোথায় কার সঙ্গে পরামর্শ, বক্তৃতা ও আলোচনা করেছেন তার উল্লেখ রয়েছে। বিচারিক বিষয় সুনিশ্চিত করার জন্য প্রসিকিউশন আরও কিছু বিশ্বাসযোগ্য ডকুমেন্ট (দলিল) দাখিল করলে ভাল হতো। আমরা জানি দৈনিক পত্রিকার অনেক রিপোর্ট নিয়ে কখনও কখনও বিশ্বাসযোগ্যতার প্রশ্ন ওঠে। ট্রাইব্যুনাল জানান, আমরা প্রায় তিন মাস পর এই মামলার রায়ের জন্য দিন ধার্য করেছি। আমাদের প্রচুর ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত সমস্যা ছিল। রায় প্রস্তুত করতে গত ৪২ বছর আগে সংঘটিত ঘটনার উল্লিখিত শ’ শ’ বই, রেফারেন্স সংগ্রহ করতে হয়েছে। এটিএম ফজলে কবীর বলেন, আন্তর্জাতিক আইনের বৈশিষ্ট্য হলো মানবতাবিরোধী যে কোন অপরাধের কিছু কিছু বিষয় জুডিশিয়াল নোটিশ ও প্রসেসের মাধ্যমে সংগ্রহ করা যায়। এর জন্য সুস্পষ্ট প্রমাণের প্রয়োজন নেই। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে লাখ লাখ মানুষ গণহত্যার শিকার হয়েছে। এটা প্রমাণ করার দরকার নেই। জুডিশিয়াল নোটিশ ও প্রসেসে তা প্রমাণিত হয়। তারপরও কিছু বিষয়ে আমরা সময় কম পেয়েছি। এ কারণে রায় প্রস্তুত করতে কিছুটা দেরি হলো। তার বক্তব্যের পর ২৪৩ পৃষ্ঠার রায়ের ৭৫ পৃষ্ঠা পড়ে শোনানো হবে বলে উল্লেখ করেন ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান। এর মধ্যে রায়ের প্রথম অংশ পড়ে শোনান ট্রাইব্যুনালের অন্য সদস্য বিচারপতি আনোয়ারুল হক। এসময় তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রোপট, ১৯৭০ সালে গণপরিষদ ও প্রাদেশিক নির্বাচন, তাতে আওয়ামী লীগের জয়লাভ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের স্বাধীনতা ঘোষণা, মুজিবনগর সরকার গঠন, প্রায় ৩০ লাখ মানুষকে হত্যা, নারী নির্যাতন, ১ কোটি লোকের শরণার্থী হিসেবে ভারতে আশ্রয় গ্রহণ ও স্বাধীনতা অর্জন বিষয়ে রায়ে উল্লিখিত বিষয় পড়ে শোনান। এছাড়া, গোলাম আযমের জন্ম, শিা গ্রহণ, কর্মময় জীবন, জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতিতে যোগদান, আমীরের পদ গ্রহণ সহ ১৯৭৮ সালে পাকিস্তানি পাসপোর্টে বাংলাদেশে তার ফিরে আসার প্রসঙ্গও উল্লেখ করেন তিনি। রায়ের দ্বিতীয় অংশ পড়েন বিচারপতি মো. জাহাঙ্গীর হোসেন। গোলাম আযমের বিরুদ্ধে আনীত ৫টি অভিযোগের মধ্য তৎকালীন মোহাম্মদপুর থানার দারোগা সিরু মিয়ার হত্যার বিষয়ে রায়ের একটি অংশে তিনি বলেন, মুক্তিযোদ্ধা সিরু মিয়াকে তিনি বাঁচাতে পারতেন। কিন্তু তা না করে তাকে হত্যার জন্য রাজাকার পেয়ারা মিয়াকে তিনি সিগন্যাল দেন। তাকে উদ্বুদ্ধ করেন। দুপুর ১টা ৮ মিনিটে ৭৫ পৃষ্ঠা রায়ের মূল অংশ ও মামলায় গোলাম আযমকে দণ্ডদানের আদেশ পড়া শুরু করেন ট্রাইব্যুনাল চেয়ারম্যান বিচারপতি এটিএম ফজলে কবীর। এ সময় তিনি গোলাম আযমের বিরুদ্ধে প্রসিকিউশনের আনা ৫টি অভিযোগ সহ দণ্ডদানের বিষয়ে রায় পড়ে শোনান। রায়ে তিনি উল্লেখ করেন, প্রসিকিউশন প এটা প্রমাণ করতে সম হয়েছে যে, ১৯৭১ সালে জামায়াতে ইসলাম বাংলাদেশের জাতীয়তাবাদ মেনে নিতে রাজি ছিলেন না। গোলাম আযম বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে প্ল্যানিং, ষড়যন্ত্রে অ্যাকটিভ ছিলেন তা-ও প্রমাণ হয়। এমনকি এই এলাকায় তিনি রাজাকার, আলবদর, আলশামস, শান্তিবাহিনী, ইসলামী ছাত্রসংঘ গঠনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন তা-ও প্রসিকিউশন প্রমাণ করতে সম হয়েছে। পরে একে একে তিনি গোলাম আযমের বিরুদ্ধে ৫টি অভিযোগে দণ্ডদানের ঘোষণা দেন।
রায়ে ুব্ধ প্রতিক্রিয়া: গোলাম আযমের বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালের দেয়া রায়ে ুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন প্রসিকিউশন ও আসামিপ উভয়ই। ট্রাইব্যুনালের প্রধান সমন্বয়ক অতিরিক্ত এটর্নি জেনারেল এম কে রহমান বলেন, বিচারে শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের আশা করেছিলাম। কিন্তু ট্রাইব্যুনাল গোলাম আযমের বয়স ও শারীরিক অবস্থা বিবেচনা করে তাকে সর্বমোট ৯০ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছেন। এ রায়ে আমরা সন্তুষ্ট নই। রাষ্ট্রপরে কৌঁসুলি জেয়াদ আল মালুম তার প্রতিক্রিয়ায় জানান, বহুপ্রতীতি এ রায়ে আমরা সন্তুষ্ট নই। প্রত্যাশিত ছিল তার মৃত্যুদণ্ড হবে। তার বিরুদ্ধে আনা ৬১টি চার্জে ১টি অভিযোগ অপ্রমাণিত হয়েছে এমন কথাও ট্রাইব্যুনাল বলেন নি। ফরমাল চার্জেও সবগুলো অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে। গোলাম আযমের বয়স ও শারীরিক অবস্থা বিবেচনা করে এ রায় দেয়া হয়েছে। এটি সংপ্তি রায়। রায়ের পূর্ণ কপি না পাওয়া পর্যন্ত এর বেশি কিছু বলতে পারছি না। গোলাম আযমের বিরুদ্ধে রায়ের প্রতিক্রিয়ায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক ও গবেষক ড. মুনতাসীর মামুন বলেন, প্রত্যাশা করেছিলাম গোলাম আযমের মৃত্যুদণ্ড হবে। কিন্তু তার বয়স ও অসুস্থতা বিবেচনায় তাকে এই সাজা দেয়া হয়েছে। এই রায় কোন রাজনৈতিক ইস্যু নয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, সব সম্ভবের বাংলাদেশে তা-ও ৪২ বছরে এটা সম্ভব হয়েছে। তরুণ প্রজন্মের উচিত দ্রুত এই রায় কার্যকর করার জন্য এগিয়ে আসা। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর অধ্যাপক ড. আনোয়ার হোসেন বলেন, এই রায়ে আমি সন্তুষ্ট নই। ট্রাইব্যুনাল নিজেই যেখানে উল্লেখ করেছে গোলাম আযমের বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ড যোগ্য অপরাধ প্রমাণিত হয়েছে, সেখানে মৃত্যুদণ্ড না হওয়া খুবই হতাশাজনক। ন্যুরেমবার্গ ও টোকিও ট্রায়ালে কমান্ড রেসপন্সিবিলিটির জন্য মৃত্যুদণ্ড হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন- প্রত্যাশা পূরণ না হওয়া এই রায়ে আমি ুব্ধ। সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি নাসিরউদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু রায়ের প্রতিক্রিয়ায় বলেন, এই রায়ে আমি হতাশা ও ােভ প্রকাশ করছি। রায় গ্রহণ করার মতো মানসিক অবস্থা আমার নেই। বিচারক বলেছে গোলাম আযমের নেতৃত্বেই মানবতাবিরোধী সকল অপরাধ সংঘটিত হয়েছে। মৃত্যুদণ্ডই ছিল তার শাস্তি। কিন্তু শুধুমাত্র বয়সের বিবেচনায় এই রায় মানতে পারছি না। আসামিপরে প্রধান আইনজীবী ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাক তার ধানমন্ডির বাসায় এক প্রেস ব্রিফিংয়ে বলেন, পাকিস্তানের প্রতি সমর্থন আর গণহত্যায় জড়িত থাকা এক কথা নয়। গোলাম আযমের বিরুদ্ধে গণহত্যায় জড়িত থাকার কোন অভিযোগ প্রমাণ করতে প্রসিকিউশন ব্যর্থ হয়েছে। তারপরও গোলাম আযমকে কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে। আমরা এ রায়ের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে যাবো।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সবচেয়ে ভয়ানক হত্যাযজ্ঞ: রায়ে বলা হয়, মুক্তিযুদ্ধের সময় দেশ দুই ভাগে ভাগ হয়ে গিয়েছিল। একদিকে ছিল আওয়ামী লীগ ও অন্যান্য স্বাধীনতাকামী সংগঠন এবং ধর্মীয়ভাবে হিন্দু সমপ্রদায়। অন্যদিকে ছিল কিছু ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল এবং বিহারিরা। এসব দলের মধ্যে বিশেষ করে জামায়াতে ইসলামী ব্যাপক বাংলাদেশবিরোধী তৎপরতা চালায়। একাত্তরে ম্যাসিভ জেনোসাইড হয়েছে যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সবচেয়ে বড় হত্যাযজ্ঞ। এটাকে কেবল নাৎসি হত্যাকাণ্ডের সঙ্গেই তুলনা করা যায়। আর সেই হত্যাযজ্ঞ চালায় পাকিস্তান ও তাদের এ দেশীয় দোসররা।
পাঁচ অভিযোগই প্রমাণিত: পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সঙ্গে পরিকল্পনা ও ষড়যন্ত্র সংক্রান্ত ছয়টি, তাদের সহযোগিতা করার তিনটি, উস্কানি দেয়ার ২৮টি, তাদের সঙ্গে সম্পৃক্ততা ও হত্যা-নির্যাতনে বাধা না দেয়ার ২৩টি এবং হত্যা ও নির্যাতনের একটি অভিযোগ রয়েছে। প্রসিকিউশনের আনা অভিযোগে বলা হয়েছে, ১৯৭১ সালের ৪ঠা এপ্রিল গোলাম আযম, নুরুল আমীন, মৌলভী ফরিদ আহমেদ, খাজা খয়ের উদ্দিন, একেএম শফিকুল ইসলাম, মাওলানা নুরুজ্জামান, হামিদুল হক চৌধুরী, মোহসিনউদ্দিন আহমেদ, সাদীসহ ১২ সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের ‘খ’ অঞ্চলের সামরিক আইন প্রশাসক টিক্কা খানের সঙ্গে দেখা করে নাগরিক শান্তি কমিটি গঠনের ষড়যন্ত্র করেন। তারই সূত্র ধরে ৬ই এপ্রিল গোলাম আযম আবারও টিক্কা খানের সঙ্গে দেখা করেন এবং ওই ষড়যন্ত্রে অংশ নেন। এই ষড়যন্ত্রের ধারাবাহিকতায় ১৯শে জুন রাওয়ালপিন্ডিতে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে উচ্চপর্যায়ের একটি বৈঠক করেন গোলাম আযম। ১লা ডিসেম্বর ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে দেখা করে রাজাকার বাহিনীর শক্তি বাড়ানোর পরামর্শ দেন তিনি।
১৯৭১ সালের ৪ঠা এপ্রিল টিক্কা খানের সঙ্গে বৈঠকে সারা দেশে শান্তি কমিটি গঠনের পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ৯ই এপ্রিল গোলাম আযম ও অন্যরা ঢাকায় ১৪০ সদস্যের নাগরিক শান্তি কমিটি গঠন করেন। এরপর ৪ঠা মে রাজধানীর এলিফ্যান্ট রোডে একিউএম শফিকুল ইসলামের বাসভবনে গোলাম আযমের উপস্থিতিতে শান্তি কমিটির সভা হয়। খাজা খয়েরউদ্দিনের সভাপতিত্বে ওই সভায় ঢাকা মহানগরের বিভিন্ন ইউনিয়নের শান্তি কমিটি গঠনের পরিকল্পনা করা হয়।
মানবতাবিরোধী অপরাধে উস্কানি দেয়ার ২৮টি ঘটনার কথা বলা হয়েছে প্রসিকিউশনের অভিযোগে। এতে বলা হয়েছে, ১৯৭১ সালের ৭ই এপ্রিল গোলাম আযম এক যুক্ত বিবৃতিতে বাংলাদেশের স্বাধীনতাকামী মানুষকে ভারতীয় অনুপ্রবেশকারী আখ্যায়িত করে তাদের ধ্বংস করার আহ্বান জানান। ২২শে এপ্রিল শান্তি কমিটির সভা শেষে এক বিবৃতিতে গোলাম আযমের নিয়ন্ত্রণে থাকা সংগঠনগুলোর সদস্যদের দেশপ্রেমিক নাগরিক উল্লেখ করে দেশের সাধারণ নাগরিকদের ধ্বংস করার আহ্বান জানানো হয়। ১৭ই মে গোলাম আযম ঢাকায় এক সভায় স্বাধীনতা আন্দোলনকে রাষ্ট্রবিরোধী কার্যকলাপ এবং মুক্তিযোদ্ধাদের বিশ্বাসঘাতক আখ্যায়িত করেন। সেই ২৫শে মার্চের অপারেশন সার্চলাইটেরও প্রশংসা করেন তিনি। তার বিরুদ্ধে আরও বেশ কয়েকটি জনসভায় উস্কানিমূলক বক্তব্য দেয়ার অভিযোগ রয়েছে।
গোলাম আযমের বিরুদ্ধে চতুর্থ অভিযোগে মানবতাবিরোধী অপরাধে সহযোগিতা বা সম্পৃক্ততার ২৩টি ঘটনা তুলে ধরা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, গোলাম আযমসহ অন্যরা একাত্তরের ৪ এবং ৬ই এপ্রিল টিক্কা খানের সঙ্গে দেখা করে সহযোগিতার আশ্বাস দেন। গোলাম আযমের সহযোগিতায় ৯ই এপ্রিল নাগরিক শান্তি কমিটি গঠিত হয়। এরপর ১৫ই এপ্রিল এর নাম বদলে কেন্দ্রীয় শান্তি কমিটি করা হয়। শান্তি কমিটির ২১ সদস্যের কার্যকরী কমিটিরও সদস্য ছিলেন তিনি। ১৮ই জুন পাকিস্তানের লাহোর বিমানবন্দরে গোলাম আযম বলেন, জনগণ সেনাবাহিনীর সঙ্গে সম্পূর্ণ সহযোগিতা করতে চায়।
গোলাম আযমের বিরুদ্ধে পঞ্চম অভিযোগে হত্যা ও নির্যাতনের একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করেছে প্রসিকিউশন। এতে বলা হয়, কুমিল্লার হোমনা থানার রামকৃষ্ণপুর গ্রামের সিরু মিয়া একাত্তরে ঢাকার মোহাম্মদপুর থানায় দারোগা হিসেবে কর্মরত ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ২৮শে মার্চ তিনি স্ত্রী আনোয়ারা বেগম ও ১৪ বছরের ছেলে আনোয়ার কামালকে নিয়ে কুমিল্লায় নিজের বাড়িতে যান। সেখানে শরণার্থীদের ভারতে যাতায়াতে সহযোগিতা করতেন সিরু মিয়া। সিরু মিয়া ও তার ছেলেসহ ছয় জন ভারতে যাওয়ার সময় ১৯৭১ সালের ২৭শে অক্টোবর সকাল ১০টার দিকে কসবা থানার তন্তর চেকপোস্টের কাছে রাজাকারদের হাতে ধরা পড়েন। স্বামী-সন্তানের ধরা পড়ার খবর পেয়ে সিরু মিয়ার স্ত্রী গোলাম আযমের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। সিরু মিয়ার ভগ্নিপতি ছিলেন গোলাম আযমের দুই ছেলে আযমী ও আমীনের শিক। তিনি গোলাম আযমের কাছে সিরু মিয়া ও তার ছেলেকে মুক্তি দেয়ার অনুরোধ করেন। বিষয়টি নিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার শান্তি কমিটির নেতা পেয়ারা মিয়াকে চিঠি পাঠান গোলাম আযম। যে চিঠিতে সিরু মিয়া এবং তার ছেলেকে হত্যার নির্দেশ দেয়া হয়। এর প্রেেিত সিরু মিয়াসহ ৩৯ জনকে কারাগার থেকে পৈরতলা রেল সেতুর কাছে নিয়ে যায় পাকবাহিনী। সেখানে হানাদারদের গুলিতে ৩৮ জন মারা গেলেও একজন প্রাণে বেঁচে যান।