শনিবার , ২১শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ , ৬ই আশ্বিন, ১৪৩১ , ১৭ই রবিউল আউয়াল, ১৪৪৬

হোম > শীর্ষ খবর > গাজীপুর সিটি নির্বাচন > প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে পারবেন তো!

গাজীপুর সিটি নির্বাচন > প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে পারবেন তো!

শেয়ার করুন

মোঃ হাজিনুর রহমান শাহীন ॥

আগামী ১৫ মে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন। ইতোমধ্যে নগরীতে শুরু হয়েছে প্রার্থীদের প্রচার-প্রচারণা। তাঁরা নানা প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন ভোটারদেরকে, নির্বাচিত হলে সিটি কর্পোরেশনের উন্নয়নে কী কী কাজ করবেন, সেসব ফিরিস্তি আকারে তুলে ধরছেন ভোটারদের সামনে। দেশের বৃহত্তম সিটি কর্পোরেশন হবার কারণে এখানকার ভোটারদেরও রয়েছে অনেক চাহিদা। যেখানে রয়েছে হাজারো সমস্যা, যা অনেক প্রার্থী অকপটে স্বীকারও করেছে ইতোমধ্যে । তবে সেসব সমস্যা ও ভোটারদের চাহিদার কতটুকু পূরণ করতে পারবেন নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা? প্রতিবার নির্বাচনের আগে প্রার্থীদের প্রতিশ্রুতি শুনতে শুনতে অভ্যস্থ ভোটারদেরও মনে স্বাভাবিকভাবেই এমন প্রশ্ন আসাটাই স্বাভাবিক।
দ্বিতীয়বারের মতো অনুষ্ঠিত হচ্ছে গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের এ নির্বাচন। প্রথমবার তুমুল প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচনে সরকারি দলের প্রতিদ্বন্দ্বি প্রার্থীকে বিপুল ভোটের ব্যবধানে পরাজিত করে ভোটাররা বিজয়ী করেছিল দেশের অন্যতম বৃহত্তম দল বিএনপির মনোনীত প্রার্থী অধ্যাপক এম এ মান্নানকে। বিগত নির্বাচনেও প্রতিদ্বন্দ্বি প্রার্থীরা ভোটারদের সামনে নানা ধরনের প্রতিশ্রুতি উত্থাপন করেছিলেন। কিন্ত নির্বাচনের পর সে সব প্রতিশ্রুতির বিশাল অংশই অপূর্ণ থেকে যায় । নানা কারণে নির্বাচিত মেয়র ও কাউন্সিলররা তাঁদের প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে পারেননি। এবারও নির্বাচনের পর নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা তাঁদের দেয়া প্রতিশ্রুতি কতটুকু রক্ষা করতে পারবেন- সেটাই দেখার বিষয়। তবে ভোটারদের প্রত্যাশা পূরণ করতে না পারলে, প্রার্থীদের এসব প্রতিশ্রুতি বিগত নির্বাচনের মত শুধু প্রতিশ্রুতি হিসেবেই থাকবে, যা আমাদের মত সাধারণ নাগরিকদের জন্য দুর্ভাগ্য হিসেবেই পরিগনিত হবে।
বিগত নির্বাচনে গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের প্রধান সমস্যা হিসেবে জলাবদ্ধতার ইস্যুটি সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পেয়েছিল। অপরিকল্পিত নগরায়ন ও অপর্যাপ্ত ড্রেনেজ ব্যবস্থার কারণে সামান্য বৃষ্টি হলেই নগরীর বেশীর ভাগ এলাকা পানির নীচে তলিয়ে যায়, বাধাগ্রস্থ হয় পয়নিস্কাশন। ৫ বছর বয়সী সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনের পূর্বে এবার এ ইস্যুটি একটি অন্যতম প্রধান ইস্যু হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে ভোটারদের কাছে। এবারের নির্বাচনে যিনি নগর পিতা নির্বাচিত হবেন এবং তাঁর সাথে যে সব কাউন্সিলররা নির্বাচিত হবেন, তাঁরা কতটুকু এ সমস্যাটি সমাধান করতে পারবেন? স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের জনপ্রতিনিধিদের কতটুকু ক্ষমতা আছে বা সমস্যা সমাধানে তারা কতটুকু আন্তরিক, তবে নগরবাসী চায় জলাবদ্ধতার সমাধান।
এবারের নির্বাচনে আরো একটি ইস্যু যুক্ত হয়েছেÑ বর্জ্য অব্যবস্থাপনা। কারণ নগরীর গুরুত্বপূর্ণ সড়ক-মহাসড়ক যেন একেকটি ডাম্পিং স্পট হিসেবে পরিণত হয়েছে। বিগত ৫ বছরেও বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য কোন একটি নির্দিষ্ট স্থান নির্বাচন করতে পারেনি সিটি কর্তৃপক্ষ। ঢাকা-ময়মনসিংহ, ঢাকা-টাঙ্গাইল ও ঢাকা-গাজীপুর মহাসড়কসহ নগরীর অলিতে-গলিতে নির্দিষ্ট ডাস্টবিন না থাকায় উন্মুক্ত স্থানে ময়লা আবর্জনা ফেলছে নগরবাসী। সিটি কর্পোরেশনের অব্যবস্থাপনাজনিত কারণে উন্মুক্ত ডাস্টবিনে পরিণত হয়েছে গোটা নগর। দূষিত হচ্ছে বায়ু, বিষাক্ত হচ্ছে পরিবেশ। ফলে রোগাক্রান্ত হচ্ছে নগরবাসী। যা এবার ভোটারদের কাছে বড় ইস্যু হয়ে দাঁড়িয়েছে। পরিবেশবাদীরাও এটিকে বড় ইস্যু হিসেবে দেখছেন। যে কারণে বড় দুদলের মেয়র প্রার্থীই এবার নগরীকে গ্রীণ ও ক্লিন সিটি হিসেবে গড়ে তোলার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করছেন। সাথে সাথে আধুনিক ও পরিকল্পিত বাসযোগ্য সিটি গড়ারও অঙ্গীকার রয়েছে তাদের। তবে নির্বাচিত হবার পর তাঁরা এসব প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে কতটুকু আন্তরিকতকার সাথে কাজ করবেন, সেটাই দেখার বিষয়।
নগরের বিভিন্ন এলাকার নাগরিকবৃন্দ, ব্যবসায়ী, দোকানদার, ছাত্র-ছাত্রী ও সাধারণ মানুষদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, জলাবদ্ধতা ও বর্জ্য অব্যবস্থাপনার পাশাপাশি এখানকার রাস্তাঘাটের অবস্থা খুবই খারাপ। নগরীর অধিকাংশ রাস্তাঘাটই চলাচলের অনুপযোগি। প্রতিদিন নাগরবাসীকে ভোগান্তিতে পড়তে হয় সংস্কারবিহীন এসব বেহাল রাস্তার কারণে। এর সাথে আছে তীব্র যানজট। রাস্তার বেহাল অবস্থার কারণেই তীব্র যানজট দিনের পর দিন আরো তীব্রতর হচ্ছে। এতে অতিষ্ট হয়ে পড়েছে নগরবাসী ।
বিশেষ করে নগরীর প্রাণকেন্দ্রে একটি রেলক্রসিং থাকায় প্রতিদিন এখানে যানজটে আটকা পড়ে সীমাহীন কষ্ট করতে হয় অফিসগামী লোকজন, স্কুল-কলেজের ছাত্র-ছাত্রী ও সাধারণ মানুষদের। গত নির্বাচনের পূর্বেও এটি আলোচনার বিষয়ে পরিণত হয়েছিল। ভোটারদের অনেক প্রত্যাশা ছিল, এখানে একটি ওভারব্রিজ নির্মাণ করে নগরবাসীকে দুঃসহ যানজট থেকে মুক্ত করবে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা। কিন্ত সে প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। এবারও নির্বাচনের আগে ভোটারদের অনেকেই এ বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করতে দেখা যাচ্ছে। নাগবাসীর ধারনা দৃশ্যমান ও প্রকট সমস্যাগুলির সমাধানে জনপ্রতিনিধিদের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কাজ করা দরকার। যিনি এসব সমস্যা সমাধানে কার্যকরী ভূমিকা পালন করতে পারবেন, নগরবাসী সে ধরনের প্রতিনিধি নির্বাচন করবে। প্রতিদিন ঘন্টার পর ঘন্টা যানজটে সময় অতিবাহিত করতে হয়। একটি ফ্লাইওভার নির্মাণ করে এ যানজট থেকে নগরবাসীকে মুক্ত করা খুব কঠিন কোন কাজ নয়। কিন্ত জনপ্রতিনিধিরা সেদিকে যেন কোন নজর-ই দেন না।
শিল্পসমৃদ্ধ গাজীপুর মহানগরীতে হাজার হাজার কলকারখানায় কর্মরত রয়েছে লাখ লাখ শ্রমিক। বিশেষ করে এখানে রয়েছে দেশের সবচেয়ে বেশী সংখ্যক তৈরী পোষাক শিল্প। এসব পোষাক কারখানায় কর্মরতদের জন্য কোন আবাসন ব্যবস্থা এখনো গড়ে উঠেনি।
গড়ে উঠেনি তাদের জন্য বিশেষ কোন পরিবহন ব্যবস্থা। প্রতিদিন নগরীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে গণপরিবহনে এসব শ্রমিকরা কর্মক্ষেত্রে যাতায়াত করে। এতে করে নানা ধরনের ভোগান্তিতে পড়তে হয় বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের সাথে জড়িত পোষাক শ্রমিকদের। বিশেষ করে, আবাসন ও পরিবহন সমস্যার কারণে সবচেয়ে বেশী ভোগান্তি পোহাচ্ছে মহিলা শ্রমিকরা। গার্মেন্টস ব্যবসায়ীদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, এখনো গাজীপুরে শিল্পবান্ধব পরিবেশ গড়ে উঠেনি। অতিরিক্ত যানজটের কারণে পণ্য পরিবহনে অনেক সময় নষ্ট হয়। সঠিক সময়ে পণ্য জাহাজীকরণ ব্যহত হয় । এরপর মরার উপর খাড়ার ঘা এর মত তাদের উপর চাপিয়ে দেয়া হয়েছে করের বোঝা। এসব সমস্যার সমাধান করা প্রয়োজন। যিনি পরবর্তী মেয়র বা নগর পিতা হবেন, তাঁর কাছে একটি শিল্প বান্ধব নগরী গড়ে তোলার প্রত্যাশা শিল্প মালিকদের। পরিকল্পিত নগরায়নের সমস্যা এ সিটিতে প্রকট আকার ধারন করেছে। গাজীপুর পৌরসভা সিটি কর্পোরেশনে উন্নীত হবার পর নগরবাসীর প্রত্যাশা ছিল একটি আধুনিক ও সুপরিকল্পিত নগরের। কিন্ত বিগত ৫ বছরে নগরবাসী অনেক ভোগান্তিতে ছিল বাসা বাড়ীর ডিজাইন ও প্ল্যান পাশ নিয়ে । নতুন বাসা-বাড়ি করতে তাদেরকে যেতে হয় ঢাকায় রাজউক এর অনুমোদনের জন্য, যেখান থেকে ডিজাইন অনুমোদন অনেক কষ্টসাধ্য বিষয়। পদে পদে নানা বিড়ম্বনার শিকার হতে হয়েছে বিগত দিনে। আর তাই অনেকেই ডিজাইন অনুমোদন ছাড়াই বাড়ি করেছে। যারা অনুমোদন নিয়েছেন, তারা চরম ভোগান্তি ভোগেই এ কাজটি করেছেন।
অথচ বাড়ি করার নকশা অনুমোদনের ক্ষমতা সিটি করপোরেশনের থাকলে এ ভোগন্তিতে পড়তে হতো না নাগরিকদের। তাই পরবর্তী মেয়রের কাছে আমাদের প্রত্যাশা থাকবে, একটি সুন্দর নগরী গড়ে তোলার স্বার্থে বাড়ি তৈরীর নকশা যেন আমরা সিটি কর্পোরেশন থেকে করতে পারি।
গাজীপুর সিটিতে গড়ে উঠেনি ভাল কোন বিনোদন কেন্দ্র। এখানে নেই সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড বিকাশের কোন ব্যবস্থা। এছাড়া কোন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় বা বেসরকারি কোন বিশ্ববিদ্যালয়ও নেই এ নগরীতে। ফলে প্রতিদিন হাজার হাজার ছাত্র-ছাত্রীদেরকে নানা প্রতিবন্ধকতা ডিঙ্গিয়ে ঢাকার কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চ শিক্ষার জন্য যাতায়াত করতে হয়। মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বি দ্ইু বৃহৎ দলের দুইজন মেয়র প্রার্থীই শিক্ষানুরাগি নেতা হিসেবে পরিচিত। তাঁদের মধ্যে যিনিই নির্বাচিত হোন না কেন, শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড বিস্তারে যেন কার্যকরী ভূমিকা পালন করবেন বলে নাগরবাসীর বিশ্বাস।
মাদকের ব্যবহার ও মাদক ব্যবসা গাজীপুর মহানগরীর আরো একটি বড় সমস্যা। মাদকের ছোবলে যুব সমাজের একটি বড় অংশ বিপথগামী হচ্ছে। তাদেরকে এ বিপদ থেকে রক্ষা করা দরকার । এজন্য মাদকের উৎস বন্ধ করার পাশাপাশি এ সিটি যেন মাদকের ট্রানজিট পয়েন্টে পরিণত না হতে পারে, তার জন্য ব্যবস্থা নিতে হবে।
নির্বাচনের আগে প্রার্থীরা প্রতিশ্রুতি দেবেন- এটাই স্বাভাবিক। নির্বাচনী বৈতরণী পার হবার জন্য হয়তো এটা তাদের নির্বাচনী কৌশল হতে পারে। তবে নগরের নাগরিকরা এটাকে কৌশল হিসেবে দেখতে চায় না। তাঁরা চায় এসব প্রতিশ্রুতির সফল বাস্তবায়ন। নাগরিকরা চায় নগরের সমস্যা সমাধান। তাদের স্বপ্ন একটি সুন্দর বাসযোগ্য নগরীর। নাগরিকদের এ স্বপ্ন যেন পূরণ হয় আগামী দিনের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে- এটাই সবার কাম্য।