স্টাফ রিপোর্টার ॥
ঢাকা : গাজীপুর সিটি নির্বাচনে সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের নাটকীয় ঘটনায় জাতীয় পার্টিতে চরম অসন্তোষ বিরাজ করছে। এ নিয়ে দলটির দুই গ্রুপ এখন মুখোমুখি। যে কোন সময় তাদের মধ্যে অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটতে পারে।
পার্টির নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, গাজীপুর সিটি নির্বাচন নিয়ে স্থানীয় নেতাকর্মীদের মতো দলের কেন্দ্রীয় নেতারাও বিভক্ত হয়ে পড়েন। পার্টির সাধারণ নেতাকর্মীরা চেয়েছিলেন কাউকেই সমর্থন না দিতে।
অন্যদিকে মহাজোটের পক্ষে-বিপক্ষে সমর্থন আদায়ে তত্পর ছিলেন দলের মহাজোটপন্থী ও বিএনপিপন্থীরা। দুই গ্রুপের নেতাদের ইন্ধনে দুই জোটের প্রার্থী সমর্থন আদায়ে এরশাদের কাছে ধরনা পর্যন্ত দেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত প্রভাব বিস্তার করে মহাজোটের পক্ষে এরশাদের সমর্থন আদায় করে নেন জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলুসহ অন্যরা।
এ কারণে গুলশানে অনুষ্ঠিত এইচ এম এরশাদের প্রেস কনফারেন্সে বিএনপিপন্থী গ্রুপটি অনুপস্থিত ছিল। সেখানে দেখা যায়নি দলের মহাসচিব এবিএম রুহুল আমিন হাওলাদারকেও।
গাজীপুর নির্বাচনে মহাজোটের পক্ষে সমর্থন দেয়ায় দলের মহাজোটপন্থী নেতারা খুশি হলেও এইচ এম এরশাদের ওপর জাতীয় পার্টির সাধারণ নেতাকর্মী এবং বিএনপিপন্থী গ্রুপটি প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ।
প্রভাব সৃষ্টি করে শেষ পর্যন্ত আজমতউল্লাহর পক্ষে এরশাদের সমর্থন আদায় করতে পারায় মহাজোটপন্থী নেতা বাণিজ্যমন্ত্রী জিএম কাদের, ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ এমপি, জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলু, এসএম ফয়সল চিশতী ফুরফুরে মেজাজে আছেন।
অন্যদিকে বিএনপিপন্থী হিসেবে পরিচিত দলের শীর্ষ পর্যায়ের নেতা সাবেক প্রধানমন্ত্রী কাজী জাফর আহমদ, অ্যাডভোকেট কাজী ফিরোজ রশীদ, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) কাজী মাহমুদ হাসান, এসএমএম আলম, গোলাম হাবিব দুলাল, সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা, মোস্তফা জামাল হায়দাররা ক্ষুব্ধ হয়ে প্রায় তিনদিন এইচ এম এরশাদের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ রাখেননি। অভিমান করে রোববার এরশাদের ছেলের বিয়েবার্ষিকীতেও যাননি অনেকেই।
বিএনপিপন্থী নেতাদের কয়েকজন অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকলেও দলীয় চেয়ারম্যানের সঙ্গে তাদের ঘনিষ্ঠ হতে দেখা যায়নি বলে জানিয়েছেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পার্টির এক প্রভাবশালী নেতা।
তিনি বলেন, ‘গাজীপুর ইস্যুতে জাতীয় পার্টির শীর্ষপর্যায়ের নেতারা বিভক্ত। এই গ্রুপিংয়ের প্রভাব পড়েছে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ-উত্তরসহ তৃণমূল পর্যায়ে। গ্রুপিং শক্ত হাতে সামাল দেয়া না গেলে ভবিষ্যতে জাতীয় পার্টিতে ভাঙনের পাশাপাশি বড় ধরনের সংঘাত-সংঘর্ষের আশঙ্কাও রয়েছে।’
সূত্র আরও জানায়, গাজীপুর সিটি নির্বাচনে শেষ মুহূর্তে সিদ্ধান্ত বদল করায় জাতীয় পার্টির সাধারণ নেতাকর্মীরা ক্ষুব্ধ। ১৪ দল ও ১৮ দল কাউকে সমর্থনের পক্ষেই ছিল না তারা। মহাজোটের পক্ষে সমর্থনে এরশাদের ঘোষণার পরপরই ক্ষোভে ফেটে পড়েন এসব নেতাকর্মী। জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলুসহ মহাজোটপন্থী নেতাদের গালিগালাজ করে তারা দলের তোপখানা রোডস্থ কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখান। এ সময় তাদের সঙ্গে যোগ দেয় বিএনপিপন্থী গ্রুপটি।
অভিযোগ আছে, মহাজোটপন্থী নেতাদের কোণঠাসা করতে বর্তমানে এই গ্রুপটি ব্যাপক তত্পরতা চালিয়ে যাচ্ছে। দলের বিক্ষুব্ধ সাধারণ নেতাকর্মীদের উসকে দিয়ে তারা এখন ফায়দা লোটার চেষ্টা করছে। এরশাদের পাশ থেকে মহাজোটপন্থী নেতাদের সরিয়ে দিতেও তত্পর এই গ্রুপটি। আগামীতে পার্টির সভা-সমাবেশে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত-অপদস্থ হওয়ার মতো যে কোনো ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটতে পারে বলে জানা গেছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে জাতীয় পার্টির এক নেতা জানান, ‘গাজীপুর ইস্যুতে বিএনপিপন্থী গ্রুপটি এখন মহাজোটপন্থী নেতাদের বিরুদ্ধে দলের সাধারণ নেতাকর্মীদের ক্ষেপিয়ে তুলছে। শারীরিকভাবে অপদস্থ করার জন্যও উসকে দিচ্ছে কর্মীদের।’
জানা যায়, বিএনপিপন্থীদের ইন্ধনে সাধারণ নেতাকর্মীরা ‘লাঙ্গল সমর্থকগোষ্ঠী’ নাম দিয়ে গতকাল রবিবার দুপুরে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে মহাজোটপন্থীদের কুশপুত্তলিকা দাহ করার কর্মসূচি দিয়েছিল। পরে বিষয়টি জানাজানি হওয়ায় কেন্দ্রীয় নেতাদের হস্তক্ষেপে কর্মসূচি থেকে পিছু হটেন তারা।
বিএনপিপন্থী দলের এক প্রেসিডিয়াম সদস্য অভিযোগ করেন, ‘বাবলু-আনিসের মতো সুবিধাবাদি নেতারা জাতীয় পার্টিকে নিয়ে খেলছেন। তারা স্যারকে (এরশাদ) জিম্মি করে রেখেছেন।’
এসব নেতার কারণে জাতীয় পার্টির ভবিষ্যত্ বিপর্যয়ের মুখে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
তবে এরশাদপন্থী হিসেবে পরিচিত দলের এক যুগ্ম মহাসচিব ভিন্নমত প্রকাশ করে বলেন, ‘মহাজোটপন্থী আর বিএনপিপন্থীদের টানাটানিতে স্যার এখন অস্থির। তারাই জাতীয় পার্টিকে ব্র্যাকেটবন্দি করে রেখেছে। স্যারকে ব্যবহার করে এক গ্রুপ মহাজোট থেকে সুবিধা নিয়েছে। বিএনপি গ্রুপটি ভবিষ্যতে জাপাকে ১৮ দলীয় জোটে নিয়ে গিয়ে সুবিধা নিতে চাইছে।’
সূত্র আরও জানায়, গাজীপুর ইস্যুতে দলীয় নেতাদের পক্ষ-বিপক্ষ নিয়ে প্রচণ্ড চাপের মুখে রয়েছেন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। গত দুই দিন তিনি বনানী কার্যালয়ে আসেননি। পারিবারিক কাজ ছাড়া বাসার বাইরে খুব একটা যাননি সাবেক এই রাষ্ট্রপতি। মন খারাপ দলের জ্যেষ্ঠনেতা বেগম রওশন এরশাদেরও।
রোববার ছেলে সাদ এরশাদের বিয়ে বার্ষিকী অনুষ্ঠানে তার মুখে হাসি ছিল না। নেতাকর্মীদের সঙ্গেও খুব একটা কথা বলতে দেখা যায়নি তাকে। বর্তমান পরিস্থিতি, দলীয় নেতাদের গ্রুপিং ও পার্টির ভবিষ্যত্ নিয়ে চিন্তিত সাবেক এই ফার্স্টলেডি।