॥ সৈয়দ মোকছেদুল আলম ॥
গাজীপুর: রবি ঠাকুরের ‘জল পড়ে পাতা নড়ে’Ñ চিরন্তন সত্য এই কথাটির অর্থ কী বদলে যাচ্ছে! বছরের পর বছর জল পড়ছে, পাতা যে নড়ছে না।
ভাবা যায়, এই ডিজিটাল যুগে গাজীপুরের টঙ্গী পৌর ভূমি অফিসের ছাদে ত্রিপল টানাতে হয়েছে বৃষ্টির জল থেকে রেহাই পেতে! পাকা দালান হলেও তা শতাব্দি প্রাচীন। রাজা-জমিদার আমলে নির্মিত হয়েছিল। তাদের কাচারি ঘর হিসেবে ব্যবহার হতো। সময়ের আবর্তে দালানের দেয়াল, ফ্লোর ও ছাদের ছাল-বাকল খসে খসে পড়েছে। জোড়াতালির মেরামত দিয়ে চলছে তো চলছেই। জরাজীর্ণ দশা এখন এমন পর্যায়ে যে মেরামত করার অবস্থায় নেই। নতুন অবকাঠামো নির্মাণ না হওয়া পর্যন্ত জল ত্রিপল দিয়েই গড়াবে। স্বস্তির বিষয়, জল শেষ পর্যন্ত যথাযথ কর্তৃপক্ষ পর্যন্ত গড়িয়েছে। পাতা সবে নড়তে শুরু করেছে।
গাজীপুর গণপূর্ত উপ-বিভাগ-২ কার্যালয়ের অফিস সহকারি মোঃ আঃ রাজ্জাক জানিয়েছেন, গত ফেব্রুয়ারিতে টঙ্গী পৌর ভূমি অফিস, কালীগঞ্জ পৌর ভূমি অফিস ও সফিপুর বাজার ইউনিয়ন ভূমি অফিস নির্মাণের টেন্ডার হয়েছে। পরের ধাপে কাওরাইদ, গোসিঙ্গা, রানীগঞ্জ, বরমী ও ফতেহপুর অফিস নির্মাণের টেন্ডার আহ্বানের প্রক্রিয়া চলছে। এগুলোর সয়েল টেস্ট এর কাজ চলমান আছে।
খোঁজ নিয়ে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, গাজীপুরে ৩৫টি ইউনিয়ন ও পৌর ভূমি অফিস রয়েছে। এর মধ্যে ২২টি মেরামতযোগ্য বলে চিহ্নিত করে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়। চিহ্নিত অফিসগুলো হচ্ছে- গাজীপুর সদর উপজেলা ভূমি অফিস, মির্জাপুর ইউনিয়ন ভূমি অফিস, পূবাইল ইউনিয়ন ভূমি অফিস, টঙ্গী পৌর ভূমি অফিস, সাহবাজপুর ইউনিয়ন ভূমি অফিস, মোথাজুরি ইউনিয়ন ভূমি অফিস, ফতেহপুর ইউনিয়ন ভূমি অফিস, শ্রীফলতলী ইউনিয়ন ভূমি অফিস, শ্রীপুর উপজেলা ভূমি অফিস, রাজাবাড়ি ইউনিয়ন ভূমি অফিস, গোসিঙ্গা ইউনিয়ন ভূমি অফিস, তেলিহাটি ইউনিয়ন ভূমি অফিস, কাওরাইদ ইউনিয়ন ভূমি অফিস, শ্রীপুর পৌর ভূমি অফিস, সনমানিয়া ইউনিয়ন ভূমি অফিস, কড়িহাতা ইউনিয়ন ভূমি অফিস, কাপাসিয়া ইউনিয়ন ভূমি অফিস, টোকনয়ন বাজার ইউনিয়ন ভূমি অফিস, কুশদী ইউনিয়ন ভূমি অফিস, কালীগঞ্জ পৌর ভূমি অফিস, জামালপুর ইউনিয়ন ভূমি অফিস ও তুমুলিয়া ইউনিয়ন ভূমি অফিস।
এ বছরের ১৮ জানুয়ারি এই বিষয়ে ভূমি মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন পাঠানো হয় অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব ও এলএ) কার্যালয়, গাজীপুর থেকে। গণপূর্তর তথ্যসূত্র বলছে, তিনটি অফিস নির্মাণের টেন্ডার হয়েছে এবং আরো পাঁচটি নির্মাণের কার্যক্রম প্রক্রিয়াধীন। এই আটটি বাদ দিলে ২২টি মেরামতযোগ্য অফিসের মধ্যে বাকি ১৬টি জরাজীর্ণ, ব্যবহার অনুপযোগী অফিসের ভাগ্যে তবে কী আছে!
দেখা যাচ্ছে, ওই মেরামতযোগ্যর তালিকায় বেহাল দশার কোনাবাড়ি ইউনিয়ন ভূমি অফিস এবং চাপাইর ও রায়েদ ক্যাম্প অফিসের নাম নাই। সরেজমিনে দেখা যায়, কোনাবাড়ি ইউনিয়ন ভূমি অফিসটি রাস্তা ও আশপাশের বাড়ি-ঘর, দোকান ইত্যাদি স্থাপনার সমতল থেকে প্রায় দুই থেকে তিন ফুট নীচু স্থানে অবস্থিত। ফলে আশপাশের উঁচু স্থানের পানি গড়িয়ে নীচু স্থানের কোনাবাড়ি ইউনিয়ন ভূমি অফিস চত্বরে গিয়ে জমা হয়। ভারি বৃষ্টিপাত হলে সেখানে হাটুজল জমে। আর রায়েদ ক্যাম্প অফিসের দেয়াল যখন-তখন ধসে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে বলে জানান সংশ্লিষ্ট একাধিক প্রত্যক্ষদর্শী।
এ প্রসংগে গত ১০ মার্চ কোনাবাড়ি অফিসের ভূমি সহকারি কর্মকর্তা মোঃ আব্দুল ওয়াহাব বাংলাভূমিকে জানান, বর্তমান জেলা প্রশাসক অফিসগুলো পরিস্কার পরিছন্ন এবং রং করিয়ে কাজের সুন্দর পরিবেশ তৈরি করিয়ে দিয়েছেন। প্রতিটি অফিসে অর্নার বোর্ড রাখা বাধ্যতামূলক করেছেন। তিনিই (জেলা প্রশাসক) কোনাবাড়ি অফিস সিসি ক্যামেরার আওতাভূক্ত করেন। কিন্তু অফিসের জরাজীর্ণ দশা এবং বর্ষার পানি জমে থাকার সমস্যা প্রকটভাবে কাজে বিঘœ ঘটায়। এ কারণে সেখানে তিনি নতুন অফিস ভবন নির্মাণের জোর দাবি জানান ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নিকট।
এদিকে বাংলাদেশ ভূমি অফিসার্স কল্যাণ সমিতি গাজীপুর জেলা শাখার সভাপতি মোঃ আব্দুল হামিদ সরকারের মেগা প্রকল্পের আওতায় দেশের গুরুত্বপূর্ণ জেলা হিসেবে গাজীপুরে অধিক সংখ্যক অফিস ভবন নির্মাণের দাবি জানিয়েছেন।
জরাজীর্ণ অফিসেই সিসি ক্যামেরা
ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার প্রসারিত হাত ধরেই গাজীপুরে কোন কোন ভূমি অফিসে সিসি ক্যামেরা বসানো হয়েছে। সিসি ক্যামেরার আওতাভূক্ত অফিসগুলো হচ্ছে- গাজীপুর সদর উপজেলা ভূমি অফিস, টঙ্গী পৌর ভূমি অফিস, সফিপুর ইউনিয়ন ভূমি অফিস, কোনাবাড়ি ইউনিয়ন ভূমি অফিস, কাশিমপুর ইউনিয়ন ভূমি অফিস ও মির্জাপুর ইউনিয়ন ভূমি অফিস। এর মধ্যে প্রথমোক্ত তিনটি অফিসই মেরামতযোগ্যর তালিকায় রয়েছে। এর বাইরে কোনাবাড়ি ইউনিয়ন ভূমি অফিসও জরাজীর্ণ ও ব্যবহার অনুপযোগি হিসেবে সেখানে নতুন ভবন নির্মাণের দাবি উঠেছে। ডিজিটাল সুবিধা ব্যববহারের সাথে যথোপযুক্ত অবকাঠামো থাকার প্রয়োজন রয়েছে। স্যাঁতস্যাঁতে পরিবেশে দ্রুত কার্যক্ষমতা হারায় ইলেক্ট্রনিক সরঞ্জাম। পানি হচ্ছে এর চরম শত্রু। তাই সিসি ক্যামেরা, কম্পিউটার বা ল্যাপটপ কিংবা অন্যান্য ইলেক্ট্রনিক সরঞ্জাম ব্যবহারের জন্য যথোপযুক্ত অবকাঠামোগত সুবিধা থাকা দরকার। পুরাতন জরাজীর্ণ সরকারি অফিসগুলো তাই সংস্কার, মেরামত ও নির্মাণ করা জরুরি হয়ে পড়েছে।
ভূমি অফিসের অন্যান্য সমস্যা ও দাবি
সীমানা প্রাচীর না থাকায় বিভিন্ন ভূমি অফিসের খালি জায়গা বেহাত হচ্ছে। রেকর্ডে টঙ্গী পৌর ভূমি অফিসের জায়গার পরিমান ১.৯৯ একর। কিন্তু অফিস সংলগ্ন রাস্তা, তুরাগ নদের ভাঙ্গন, সিটি কর্পেরেশনের পানির পাম্প স্থাপন ও মন্দির হওয়ার কারণে এখন সরেজমিনে আছে মাত্র .৫৫ একর। অধিকাংশ ভূমি অফিসের সীমানা প্রাচীর না থাকায় জমি বেহাত হওয়ার বিষয়টি অব্যহত আছে। এ অবস্থায় নিরাপত্তা ও জমি রক্ষার স্বার্থে ভূমি অফিসগুলোর সীমানা প্রাচীর নির্মাণের জোর দাবি উঠেছে।
মেধা ও কর্ম দক্ষতার জন্য সুপরিচিত ভূমি সহকারী কর্মকর্তা মোঃ মাহ্ আলম জানান, ২০১৫-১৬ অর্থ বছরে টঙ্গী পৌর ভূমি অফিসের ভূমি উন্নয়ন কর আদায়ের লক্ষমাত্রা হচ্ছে ৫ কোটি ২০ লাখ টাকা। গত ফেব্রুয়ারি ও চলতি মার্চের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত সময়ে তিনি ৬০ লাখ টাকা আদায় ও ব্যাংকে জমা করেছেন। প্রতিদিনের আদায় প্রতিদিনই ব্যাংকে জমা করেন। নগদ অর্থ বহন করা ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় নিরাপত্তার অভাব বোধ করেন। তাই এ রকম অফিসের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার বিষয়টি কর্তৃপক্ষের গুরুত্বপূর্ণ দিয়ে ভাবা উচিত।
এছাড়াও তিনি জানান, ভূমির কাজ অত্যন্ত জটিল বিষয়। ৫০ বছর আগে ভূমির সর্বশেষ জরিপ হয়। সেই জরিপের আরএস রেকর্ড এর উপর এখন পুরোপুরি নির্ভর করে কাজ করা আরও কঠিন। আইনও অনেক আগের আমলের। এই আইনের কারণে অনেক সময় সেবার গতি বাড়ানো যায় না কিংবা কাজের বাধা হয়ে দাঁড়ানোয় ফিরিয়ে দিতে হয় সেবা প্রার্থীকে। তাই এসব যুগোপযোগি করা দরকার। তাছাড়া জনসংখ্যা বাড়ার সাথে সাথে কাজের চাপও বেড়েছে। বর্তমান লোকবল কাঠামোয় এই চাপ সামাল দেয়া কঠিন। জন সেবার মান বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনে সৃষ্ট পদ বাড়ানোর কথা সুবিবেচনায় আনা উচিত।
গাজীপুর পৌর ভূমি অফিসের ভূমি সহকারী কর্মকর্তা মোঃ আব্দুর রাজ্জাক জানান, ভূমি মন্ত্রণালয়ের ১৯৮৮ সালের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ইউনিয়ন ভিত্তিক ভূমি অফিস এখনও হয়নি। কালিয়াকৈর পৌর ভূমি অফিসের কাজ সফিপুর, সাবাসপুর ও শ্রীফলতলী ইউনিয়ন ভূমি অফিস থেকেও হয়। সফিপুর, সাবাসপুর ও শ্রীফলতলীতে আবার একাধিক ইউনিয়নের কাজ হয়। এরকমভাবে কালীগঞ্জ পৌর ভূমি অফিসের অধীন ২টি, জামালপুরে ৩টি, কুশদীতে ২টি ও টোকনয়ন বাজার ইউনিয়ন ভূমি অফিসের অধীন ৩টি ইউনিয়নের কাজ হয়।