শনিবার , ২১শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ , ৬ই আশ্বিন, ১৪৩১ , ১৭ই রবিউল আউয়াল, ১৪৪৬

হোম > Uncategorized > গঠনতন্ত্র বদলাচ্ছে জামায়াত

গঠনতন্ত্র বদলাচ্ছে জামায়াত

শেয়ার করুন

স্টাফ রিপোর্টার ॥ গঠনতন্ত্র পরিবর্তন করতে যাচ্ছে জামায়াতে ইসলামী। দলটি এখন তাদের ‘পুরোনো’ নেতাদের নিয়ে আর চলতে চায় না। একাত্তরের বিতর্কিত ভূমিকার জন্য তারা নতুন প্রজন্মের কাছে প্রশ্নবানে জর্জরিত হতে চায় না। তাই নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের মাধ্যমে তারা একটি কল্যাণ রাষ্ট্র গঠনের দিকে অগ্রসর হওয়ার পরিকল্পনা করছে। দলটির গঠনতন্ত্রেও এমন ধারা সংযুক্ত করে ব্যাপক রদ-বদল আনার পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে।

বিদেশনীতির বেলায়ও ভারতসহ সকল প্রতিবেশীর সঙ্গে সুসম্পর্কের আলাদা একটি ধারা যুক্ত হচ্ছে। গঠনতন্ত্র থেকে বাদ পড়ছে সংবিধানের সাথে সাংঘার্ষিক কয়েকটি ধারাও। সারা দেশে জামায়াতের সক্রিয় কর্মী, রুকন ও পদস্থ নেতাদের মধ্যে পরিচালিত সাম্প্রতিক একটি পর্যালোচনামূলক প্রতিবেদনে এমন দাবি উঠে এসেছে বলে দলটির কয়েকজন নেতা জানিয়েছেন। ওই প্রতিবেদনের দাবির প্রেক্ষিতে যুদ্ধাপরাধে অভিযুক্ত শীর্ষ নেতাদের দল থেকে বাদ দেয়ারও চিন্তা-ভাবনা করছে বর্তমান নেতৃত্ব। একই সঙ্গে ‘রাজাকার’ তকমা নেই এমন নেতাদের শীর্ষ স্থানে পদায়ন করার বিষয়ে জামায়াত চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে বলেও জানা গেছে।

জামায়াত সূত্রে জানা গেছে, দশম সংসদ নির্বাচনের পরই দলটির বর্তমান নেতৃত্ব রাজধানীতে একটি বৈঠক করেন। ওই বৈঠকে দলের ভারপ্রাপ্ত আমির মকবুল আহমদ, ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল শফিকুর রহমান, নির্বাহী পরিষদের সদস্য রফিকুল ইসলাম মিয়া, হামিদুর রহমান আযাদ, কর্মপরিষদের সদস্য এটিএম মাসুম, আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের, আব্দুল হালিম, রেদোয়ানুল্লাহ শাহেদী, মজলিসে শুরার সদস্য, সেলিম উদ্দিন, শফিকুল ইসলাম মাসুদ, মঞ্জুরুল ইসলাম ভুইয়্যা ও রেজাউল করিম উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী গত ১৩ জানুয়ারি থেকে ‘পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে করণীয় ও ভাবনা’ শীর্ষক একটি পর্যালোচনামূলক প্রতিবেদন সারা দেশে জামায়াতের বাছাইকৃত কর্মী, রুকন ও পদস্থ নেতাদের কাছে পাঠানো হয়।

প্রতিবেদনে নেতা-কর্মীদের সুপারিশও চাওয়া হয়। এরই মধ্যে সারা দেশের প্রতিবেদন এখন জামায়াতের শীর্ষ পর্যায়ে পৌঁছানো হয়েছে। এরপরই দলটির শীর্ষ নেতৃত্ব রাজধানীতে সম্প্রতি একটি পর্যালোচনামূলক বৈঠকও করেন। বৈঠকে সারা দেশে পরিচালিত প্রতিবেদনের চিত্র নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হয়। ওই বৈঠক থেকেই কারাবন্দি শীর্ষ নেতাদের কাছেও মাঠ পর্যায়ের নেতা-কর্মীদের ভাবনা সংবলিত কয়েকটি প্রতিবেদন আইনজীবী ও সংশ্লিষ্ট নেতাদের পরিবারের সদস্যদের মাধ্যমে পাঠানো হয়েছে। তবে গঠনতন্ত্র পরিবর্তন ও দলের শীর্ষ নেতাদের বাদ দেয়া সংক্রান্ত চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে আরো কয়েক মাস সার্বিক পরিস্থিতি পর্যালোচনার সিদ্ধান্ত নেয়া হয় বৈঠকে।

বৈঠকে উপস্থিত দু’জন নেতার উদ্ধৃতি দিয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ঢাকা মহানগর জামায়াতের এক নেতা বলেন, ‘পরিবর্তিত পরিস্থিতি নিয়ে দলের মাঠ পর্যায়ের নেতা-কর্মীদের পরামর্শ শীর্ষ নেতারা পর্যালোচনা করছেন। ধাপে ধাপে সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে অনেক প্রস্তাবনা বাস্তবায়ন করা হবে।’

গত বৃহস্পতিবার রাজধানীর ধানমণ্ডিতে একটি বাসায় নগর জামায়াতের এই নেতার সঙ্গে প্রায় ঘণ্টা দুয়েক আইপোর্ট প্রতিবেদকের কথা হয়। এ সময় তিনি জামায়াতের নেতা-কর্মীদের মধ্যে পরিচালিত প্রতিবেদনের হুবহু বিবরণ তুলেন ধরেন। তবে প্রতিবেদনের ফটোকপি দিতে অস্বীকৃতি জানান।

প্রতিবেদনে মূলত ৫টি বিষয় গুরুত্ব পেয়েছে। প্রথমটি হচ্ছে, দ্রুত দলকে ঢেলে সাজানোর উদ্যোগ নেয়া। এ ক্ষেত্রে জামায়াতের কেন্দ্রীয় কমিটিসহ সারা দেশে বিভাগ, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে নেতৃত্বে রদ-বদল আনা। এখানে দলের সিংহভাগ নেতারা মত দেন, এই মুহূর্তে ‘একাত্তরের ভূমিকার’ জন্য কারাগারে আটক দলের শীর্ষ নেতাদের বাদ দেয়াই শ্রেয়। তবে তাঁদের প্রতি নেতা-কর্মীদের যে শ্রদ্ধা আছে তাতে যেন বিচ্যুতি না ঘটে এজন্য শীর্ষ নেতাদের মুক্তির দাবিতে নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেয়া হয়। পাশাপাশি পরিচ্ছন্ন ও একাত্তরে কোনো ভূমিকা নেই এমন নেতাদের সামনের সারিতে নিয়ে আসা।

দ্বিতীয়টি হচ্ছে, সাম্প্রতিক আন্দোলনে ‘শহীদ’ নেতাদের পরিবারের কাছে দলের শীর্ষ নেতাদের পক্ষ থেকে একজন প্রতিনিধি পাঠানো। অথবা স্থানীয় নেতৃত্বের মাধ্যমে ‘শহীদ পরিবারের’ সঙ্গে কথা বলে তাদেরকে সহযোগিতা করা। এ ছাড়া জামায়াতসহ সংখ্যালঘুদের ভাঙচুর হওয়া বাড়ি ঘর মেরামতে সংগঠনের পক্ষ থেকে উদ্যোগ নেয়া।

তৃতীয়টি হচ্ছে, নির্বাচন কমিশনে দলের নিবন্ধন ফিরে পেতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া। এ ক্ষেত্রে ইসলামের মৌলিক বিধান সমুন্নত রেখে দেশের সংবিধানের সাথে মানানসই ধারা গঠনতন্ত্রে সম্পৃক্ত করা।

চতুর্থটি হচ্ছে, বিদেশনীতির বেলায় আঞ্চলিক ভূ-রাজনীতি মেনে নিয়ে ভারতসহ সকল প্রতিবেশীর সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখা। জামায়াতের ব্যাপারে ভারতের ‘নেতিবাচক’ দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করতে ভারতে লবিস্ট নিয়োগ করা। মধ্যপ্রাচ্যসহ পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্ক আরো জোরদার করা। বিদেশি কূটনীতিকদের ব্রিফ করে দেশের রাজনীতি ও জামায়াতের দলীয় অবস্থান তুলে ধরা।

পঞ্চমটি হচ্ছে, এই মুহূর্তে বিএনপির সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদ না করা। এ ক্ষেত্রে বিএনপি কৌশলী ভূমিকা নিলেও তাদের বিরুদ্ধে না যাওয়া।

জামায়াতের কারাবন্দি নেতাদের পক্ষে আইনি লড়াই করছেন, দলটির এমন একজন আইনজীবীও সাম্প্রতিক পর্যালোচনামূলক প্রতিবেদনের সত্যতা নিশ্চিত করে বলেন, ‘কারাগারে আটক জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের বাদ দেয়ার বিষয়টি খুবই স্পর্শকাতর। তবে উপায়ন্তর না থাকলে বাস্তবতা মেনে বাদ দিতে হবে।’

দলীয়সূত্রে জানা গেছে, ২০০৯ সালে সর্বশেষ রুকন সম্মেলন (কাউন্সিল) হয় জামায়াতের। ওই কাউন্সিলে মতিউর রহমান নিজামী চতুর্থবারের মতো জামায়াতের আমির হন। সেক্রেটারি জেনারেল হন আলী আহসান মুজাহিদ। নায়েবে আমির হন আবুল কালাম আজাদ, মকবুল আহমদ, মাওলানা মুহাম্মদ সোবহান, একেএম নাজির আহমদ ও দেলোয়ার হোসেন সাঈদী। সহকারী সেক্রেটারি হন মুহাম্মদ কামারুজ্জামান, আব্দুল কাদের মোল্লা, এটিএম আজহার, মুজিবুর রহমান, শফিকুর রহমান। এর মধ্যে নাজির আহমদ সম্প্রতি রাজধানীর একটি হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন। মানবাতবিরোধী অপরাধের দায়ে ফাঁসি হয় কাদের মোল্লার। সাঈদী, মুজাহিদ ও কামারুজ্জামানকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে ট্রাইব্যুনাল। এই বিষয়ে এখন উচ্চ আদালতে আপিল চলছে। নিজামীর মামলায় ট্রাইব্যুনালের বিচার এখন চূড়ান্ত পর্যায়ে। জামায়াতের কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের প্রভাবশালী সদস্য মীর কাসেম আলীসহ অন্যদের বিচারও চলছে।

এই কমিটির মেয়াদ ২০১২ সাল পর্যন্ত হলেও এখনো নতুন কোনো কাউন্সিল হয়নি। তাই নেতৃত্বে কোনো পরিবর্তন আসেনি। দলের রুকন সম্মেলনও হয়নি প্রায় তিন বছর। এমন অবস্থায় দলের তৃণমূল পর্যায়ের নেতা-কর্মীরা শিগগির রুকন সম্মেলনের মাধ্যমে পুরোনোদের বাদ দিয়ে নতুন নেতৃত্ব সামনে আনার পক্ষে। জামায়াত সূত্রের দাবি, এ ক্ষেত্রে মকবুল আহমদ জামায়াতের আমির ও ডা. সফিকুর রহমানকে ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি করার পক্ষে প্রায় সব নেতা-কর্মীরা ইঙ্গিত দিয়েছেন।