শনিবার , ২১শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ , ৬ই আশ্বিন, ১৪৩১ , ১৭ই রবিউল আউয়াল, ১৪৪৬

হোম > Uncategorized > ক্লোন সিমে হুমকির হিড়িক, দিশাহারা গোয়েন্দারা

ক্লোন সিমে হুমকির হিড়িক, দিশাহারা গোয়েন্দারা

শেয়ার করুন

স্টাফ রিপোর্টার ॥
মোবাইলের সিমকার্ড ক্লোন করে এবং নতুন নতুন কৌশলে সন্ত্রাসীরা দেশের বিশিষ্ট নাগরিকসহ তাদের টার্গেটকৃত বিভিন্ন ব্যক্তিকে হুমকি দেয়ায় দোষীদের খুঁজে বের করতে পুলিশ ও গোয়েন্দারা হিমশিম খাচ্ছেন। তাই হুমকির ঘটনা ক্রমেই বেড়ে চলেছে।
এরই মধ্যে প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, আইজিপি, এটর্নি জেনারেল, লেখক-প্রকাশক, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বসহ বিপুল সংখ্যক বিশিষ্টজন প্রাণনাশের হুমকি পেয়েছেন। হুমকি পাওয়া সাধারণ মানুষের সংখ্যাও কম নয়।
জানা গেছে, প্রাণনাশের হুমকি পাওয়ার পর থেকে অনেকেই উদ্বেগ ও আতঙ্কের মধ্যে দিন পার করছেন। শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবাল ও তার স্ত্রী অধ্যাপক ড. ইয়াসমিন হক সর্বশেষ প্রাণনাশের হুমকির তালিকায় স্থান পেয়েছেন।
তবে পুলিশ কর্মকর্তারা দাবি করছেন, মোবাইল ফোন, ই-মেইল ও ফেসবুকে হুমকিদাতাদের বেশির ভাগই গ্রেপ্তার হয়েছে। বাকিরাও গোয়েন্দা জালে রয়েছে। সময়, সুযোগ ও পর্যাপ্ত প্রমাণসাপেক্ষে তাদের যে কোনো সময় গ্রেপ্তার করা হবে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, অবাধ তথ্যপ্রবাহ ও যোগাযোগ সহজ করতে দেশে তথ্যপ্রযুক্তির উন্নয়ন ঘটানো হয়। অথচ এই প্রযুক্তির অপব্যবহার করেই একাধিক চক্র প্রাণনাশের হুমকি, চাঁদাবাজি ও বস্ন্যাকমেইলিংসহ
বিভিন্ন সাইবার ক্রাইমে মেতে ওঠে। এ পরিস্থিতিতে মোবাইল সিমের প্রতিটি গ্রাহকের বায়োমেট্রিক বাধ্যতামূলক করা হয়। তবে তাতেও সাইবার ক্রাইম নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়নি। বরং তাতে পরিস্থিতি আরও গোলমেলে হয়ে উঠেছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, অপরাধীচক্র অন্যের সিম ক্লোন করে কিংবা ওই ফোন নাম্বার দিয়ে ভুয়া ফেসবুক আইডি খুলে হুমকিধমকি দেয়ার পর গোয়েন্দারা ওই সিমের প্রকৃত মালিককে ধরছেন। অথচ যার নাম্বার ব্যবহার করে হুমকি দেয়া হচ্ছে তিনি এর কিছুই জানেন না। ফলে ঘুরেফিরে তাকে নানাভাবে হয়রানি হতে হচ্ছে। কিন্তু যে ব্যক্তি এ অপকর্ম ঘটাচ্ছে তিনি ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছেন।
আইটি বিশেষজ্ঞরা জানান, অনলাইনে বিনু ও স্কুপিংসহ অনেক অ্যাপস রয়েছে, যা একজন ব্যবহার করে আরেকজনের মোবাইল নাম্বার থেকে এসএমএস (খুদেবার্তা) পাঠাতে পারে। বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠন এসব অ্যাপস ব্যবহার করছে। সাম্প্রতিক তেল গ্যাস বিদ্যুৎ বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির সদস্য সচিব ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষক আনু মুহাম্মদ এবং শাহাজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও লেখক জাফর ইকবাল দম্পতিসহ দেশের বেশ কিছু মানুষকে এসব অ্যাপস ব্যবহার করে হত্যার হুমকির প্রেক্ষিতে বিষয়টি বড় করে নজরে এসেছে।
বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসির একাধিক কর্মকর্তা জানান, বিষয়টি সম্পর্কে তারা অবগত। এ অপকৌশল কিভাবে বন্ধ করা যায় তা গুরুত্বের সঙ্গে খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
এদিকে আইটি বিশ্লেষকরা বলছেন, এসব অ্যাপস ব্যবহার করে জঙ্গিরা অন্যের নাম্বার ব্যবহার করে বিভিন্ন জনকে হত্যার হুমকি দিতে থাকে। তবে তা সত্যিই উদ্বেগের বিষয়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ বিষয়ে এখনি কার্যকরী ব্যবস্থা না নিলে তা বড় ধরনের সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ইতিপূর্বে দেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার হুমকি দেয়া হয়েছে। মোবাইলের সিমকার্ড ক্লোন করে আইজিপিকে হুমকি দেয়া হয়েছে। গত দুই বছরে হুমকির ঘটনা সবচেয়ে বেশি ঘটেছে। এই সময়েই সবচেয়ে বেশি বিশিষ্ট ব্যক্তি প্রাণনাশের হুমকি পেয়েছেন। তবে এর আগেও এ ধরনের হুমকির ঘটনা ঘটেছে। প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিকসহ ১০ বিশিষ্ট নাগরিককে চিঠি দিয়ে হুমকি দেয়া হয়। অন্যরা হলেন- ডাক ও টেলিযোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিম, ঢাকা বিশ্ববিদালয়ের জগন্নাথ হলের প্রভোস্ট ড. অসীম সরকার, গণজাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র ডা. ইমরান এইচ সরকার, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক কাবেরী গায়েন, সরকারদলীয় এমপি ইকবালুর রহিম এবং শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক মুহাম্মদ জাফর ইকবাল। এই হুমকির পর ড. অসীম সরকার রাজধানীর শাহবাগ থানায় সাধারণ ডায়েরি করেন। ২০১৫ সালের শুরুতেই প্রাণনাশের হুমকি দেয়া হয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালকে। ৪ জানুয়ারি জঙ্গি সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিম-১৩ নামে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ সাতজন বিশিষ্ট নাগরিককে চিঠিতে প্রাণনাশের হুমকি দেয়া হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক এ কে আজাদ চৌধুরীকে এই চিঠি পাঠানো হয়। সে সময় প্রাণনাশের হুমকি পাওয়া বিশিষ্ট নাগরিকদের মধ্যে আছেন সুপ্রিম কোর্টের অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম, আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ও ডিআইজি প্রিজন। তবে অ্যাটর্নি জেনারেলকে হুমকিদাতা বাবুল আহমেদকে গোয়েন্দা পুলিশ সিলেটের বিয়ানীবাজার থেকে গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হয়। অন্যদের হুমকিদাতারা এখনো লাপাত্তা। একই বছরের ২০ মে আল-কায়দা ও বাংলাটিম-১৩ পরিচয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক, অধ্যাপক মুহাম্মদ জাফর ইকবালসহ ১০ জন বিশিষ্ট নাগরিককে প্রাণনাশের হুমকি দেয়া হয়। ওই বছরের ১৭ জুন আনসারুল্লাহ বাংলা টিম তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনুসহ ২৫ জনকে এক চিঠিতে হত্যার হুমকি দেয়। এদের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক সৈয়দ আনোয়ার হোসেন, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মুহাম্মদ জাফর ইকবাল, বিশিষ্ট সাংবাদিক আবেদ খান, সাংবাদিক মঞ্জুরুল আহসান বুলবুল, ভোরের কাগজের সম্পাদক শ্যামল দত্ত, ইত্তেফাকের নির্বাহী সম্পাদক শাহীন রেজা নূর, একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির আহ্বায়ক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব শাহরিয়ার কবির, মুক্তিযোদ্ধা জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব রামেন্দু মজুমদার, এটিএন নিউজের সাংবাদিক মুন্নি সাহা, গণজাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র ইমরান এইচ সরকার, কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক সিদ্দিকী নাজমুল আলম, বাংলাদেশ ছাত্রমৈত্রীর সাবেক সভাপতি বাপ্পাদিত্য বসু, বস্নগার কানিজ আকলিমা সুলতানা, আমেরিকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির শিক্ষক আরাফাত রহমান অন্যতম। এ ছাড়া শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ, আওয়ামী লীগের উপদেষ্টাম-লীর সদস্য সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, সিপিবি সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম এবং বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ অধ্যাপক জাফর ইকবালসহ ১৯ বিশিষ্ট ব্যক্তিকে হত্যার হুমকি দেয়া হয়।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের উপ-কমিশনার (মিডিয়া) মাসুদুর রহমান এ প্রসঙ্গে বলেন, কোনো হুমকির ঘটনাই পুলিশের পক্ষে খাটো করে দেখার সুযোগ নেই। সন্ত্রাসীরা অনেক সময় হীন স্বার্থ চরিতার্থ করতে প্রাণনাশের হুমকি দেয়। আবার অনেক সময় ব্যক্তিকে অথবা জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টি করার জন্যও হুমকি দিয়ে থাকে। পুলিশ ও গোয়েন্দা সব হুমকির ঘটনার তদন্ত গুরুত্বের সঙ্গে সম্পন্ন করে এবং অপরাধীদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চালায়।
গোয়েন্দা পুলিশের অপর একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এ প্রসঙ্গে বলেন, যে কোনো ধরনের হুমকির ঘটনায় সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করা হয়। হুমকিদাতাকে গ্রেপ্তারের লক্ষ্যে সব ধরনের ব্যবস্থা নেয়া হয়। বিশিষ্ট ব্যক্তিদের হুমকির ঘটনাগুলো সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া হয়। এ ধরনের বেশিরভাগ ঘটনায় পুলিশ ও গোয়েন্দারা অপরাধীকে শনাক্ত ও গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হয়েছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে অপরাধীদের গ্রেপ্তার করা সহজেই সম্ভব হয় না বা বিলম্ব ঘটে। তাই বলে তদন্ত থেমে থাকে না। অপরাধীকে শনাক্ত করতে তদন্ত অব্যাহত থাকে। গত দুই বছরে দেশের বিশিষ্টজনদের হুমকির তদন্ত করতে গিয়ে দেখা গেছে, বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠনের নামেই বেশি হুমকি দেয়া হয়েছে। এসব হুমকির অনেকগুলোরই কোনো ভিত্তি খুঁজে পাওয়া যায়নি। আতঙ্ক ছড়ানোর জন্যই হুমকি দেয়া হয়েছে। তারপরেও তদন্ত হচ্ছে। এসব ঘটনায় অনেক সময় অপরাধীকে গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়নি। তদন্তকালে পুলিশকে বিভ্রান্তির মধ্যেও পড়তে হয়। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ ও শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. জাফর ইকবাল দম্পতিকে নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের (এবিটি) নামে মোবাইল ফোনে প্রাণনাশের হুমকি দেয়া হয়। ওই একই মোবাইল নাম্বার দিয়ে ফোনে মঈনুল আহসান সাবেরকে আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন আইএস-এর নামে হুমকি দেয়া হয়েছে। অন্যদিকে জেএমবি-২ পরিচয়ে অধ্যাপক শামসুজ্জামান খানের কাছে হুমকি দেয়া হয়।