শনিবার , ২১শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ , ৬ই আশ্বিন, ১৪৩১ , ১৭ই রবিউল আউয়াল, ১৪৪৬

হোম > Uncategorized > ক্লাসের লাজুক ছেলেই ফুটবলের মহানায়ক

ক্লাসের লাজুক ছেলেই ফুটবলের মহানায়ক

শেয়ার করুন

স্পোর্টস ডেস্ক ॥

ঢাকা: রোজারিও থেকে ৫০ কিলোমিটার দূরে কারখানাটি। ইস্পাতের ওই কারখানায় কাজ করতেন হোর্হে মেসি। কর্মস্থলে যেতে যেতেই সেলিয়ার সঙ্গে পরিচয়। সেলিয়া কাজ করতেন চুম্বক তৈরির একটি কারখানায়। ১৯৭৮ সালের ১৭ জুন বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন তাঁরা । সেলিয়ার পৈতৃক আদিনিবাস ইতালির পোর্তো রিসানাতি শহরে। তাঁর পূর্বপুরুষদের একজন অ্যাঞ্জেলো মেসি ১৮৮৩ সালে ভাগ্যপরিবর্তনের আশায় সেখান থেকে আর্জেন্টিনায় পাড়ি জমান।
আর্জেন্টিনার সান্তা ফে প্রদেশের সবচেয়ে বড় শহর রোজারিও। রাজধানী বুয়েনস এইরেস থেকে ৩০৫ কিলোমিটার দূরে শহরটিতে ১০ লাখ মানুষের বসবাস। তাঁদের একটা বড় অংশ ইতালি ও স্পেন থেকে আসা অভিবাসীদের নাতিনাতনি। অর্থাৎ ভাগ্য অন্বেষণকারীদের তৃতীয় প্রজন্ম৷ মেসির মা-ও এমনই একটা পরিবারের৷
হোর্হে ও সেলিয়া দম্পতি চেয়েছিলেন, দুই ছেলের পর তাঁদের তৃতীয় সন্তান যেন মেয়ে হয়৷ কিন্তু ঈশ্বর মনে হয়, তাঁদের সঙ্গে একটু হেঁয়ালি করলেন৷ সেলিয়ার কোলজুড়ে এল আরেকটি পুত্রসন্তান৷ নাদুসনুদুস, ফুটফুটে, গোলাপি বর্ণের নবজাতককে দেখে পেছনের সব চাওয়া যেন নিমেষে ভুলে গেলেন মা-বাবা৷ তাঁদের আনন্দ দেখে কে!
১৯৮৭ সালের ২৪ জুন৷ ঘড়ির কাঁটা সকাল ছয়টা ছুঁই-ছুঁই৷ চারদিকে সকালের নির্মল পরিবেশ৷ একটা কোমল স্নিগ্ধ প্রভাত স্বাগত জানাল সর্বকালের অন্যতম সেরা ফুটবলারকে৷ রোজারিওর গারিবালদি হাসপাতালে ভূমিষ্ঠ হলেন লিওনেল আন্দ্রেস মেসি৷ ৪৭ সেন্টিমিটার লম্বা ছোট্ট মেসির ওজন তিন কেজি। শারীরিক অন্য কোনো সমস্যা না থাকলেও তাঁর একটি কানে সম্পূর্ণ ভাঁজ পড়েছিল। পরে অবশ্য কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই তা আপনা-আপনি ঠিক হয়ে যায়।
জন্ম থেকেই সুস্থ-সবল দেহের অধিকারী মেসি। এতটাই যে, মাত্র ১০ মাস বয়সেই সে তার দুই ভাইয়ের সঙ্গে ধস্তাধস্তি শুরু করে দেয়। বয়স বাড়ে৷ খেলার সাথিও জুটতে থাকে৷ বন্ধুদের সঙ্গে পিকচার কার্ড ও মার্বেল দিয়ে খেলতেই সবচেয়ে পছন্দ ছিল তার৷ ফুটবলের সঙ্গে সখ্যের শুরু চার বছর বয়সে। ওই বছর জন্মদিনে মা-বাবার কাছ থেকে লাল ডায়মন্ডযুক্ত একটি সাদা বল উপহার পায় সে। সেই থেকে ওই বলটি নিয়েই সারাক্ষণ মেতে থাকা।
মেসির ফুটবল-জীবনের প্রথম কোচ সালভাদর রিকার্দো অ্যাপারিসিয়ো৷ মাত্র পাঁচ বছর বয়সে রোজারিওভিত্তিক ক্লাব গ্রানদোলিতে যাওয়া-আসা শুরু মেসির। তখন ওই ক্লাবের কোচ ছিলেন অ্যাপারিসিয়ো, যাঁর কাছে শত শত শিশু ফুটবল শিখেছে। ওই ক্লাবেই মেসির বাবাও কোচিং করাতেন৷ মেসির দুই ভাইও একই ক্লাবের ছাত্র। প্রতি মঙ্গল ও বৃহস্পতিবার বিকেলে তাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো। একদিন বিকেলে মেসিও তাদের সঙ্গে গেল। ফুটবলার মেসির আনুষ্ঠানিক আত্মপ্রকাশ সেখান থেকেই৷
গল্পটা শুনুন অ্যাপারিসিয়োর মুখেই, “আমার ’৮৬ দল (জন্মসালভিত্তিক একটি দল) গঠনে একজন েেখলায়াড় বাকি ছিল৷ পাশেই দেখলাম, একটি ছেলে বল নিয়ে কারিকুরি করছে। আমি জানতাম না, সে খেলতে পারে কি না। তবু আমি তার দাদির কাছে গিয়ে ছেলেটিকে ধার দেওয়ার কথা বললাম। এর আগে ছেলেটির দাদিও বহুবার আমার কাছে তাঁর নাতিকে খেলার সুযোগ করে দেওয়ার অনুরোধ করেছিলেন। নাতির ফুটবলশৈলীতে তিনি নাকি মুগ্ধ। কিন্তু ছেলেটির মা অথবা খালা চাইতেন না, সে খেলুক। কারণ সে ছিল অন্যদের তুলনায় খুবই ছোট। কিন্তু আমি তাঁদের বলেছিলাম, আমি ওর পাশে দাঁড়িয়ে থাকব। কেউ ওকে মারলে খেলা বন্ধ করে দেব এবং ওকে তুলে নেব।”
গল্পটা মেসির মা-বাবার কাছে আবার অন্য রকম৷ ’৮৬ দলে একজন খেলোয়াড় কম হওয়ায় মেসিকে দলে নেওয়ার জন্য সেলিয়াই অ্যাপারিসিয়োকে জোর করেছিলেন। মেসি খুবই ছোট হওয়ায় কোচ তাকে দলে নিতে চাইতেন না। মেসির দাদি পীড়াপীড়ি করতেন, ‘ওকে দলে নাও এবং দেখো, ছোট্ট ছেলেটাই কী করে!’ অবশেষে কোচের মন গলে। তবে তিনি বলে রাখেন, ‘আমি ওকে টাচলাইনের কাছে রাখব, যাতে কাঁদলে তুলে নেওয়া যায়৷’
এরপর অবশ্য যা ঘটেছে, তা নিয়ে কারও দ্বিমত নেই। কোচ মেসিকে দলে নেন এবং খেলতেও নামান। তবে ওই ম্যােচ মেসি গোল পেয়েছিলেন কি না তা কারও মনে নেই, এমনকি কোচ অ্যাপারিসিয়োরও নয়। কিন্তু মেসির খেলা দেখে মুগ্ধতার কথা এখনো মনে আছে কোচের, ‘আমি এর আগে কখনো এমন কিছু দেখিনি। এমন কখনো ঘটেওনি৷ আমি ওকে মাঠ থেকে তুলেও নিইনি৷’
স্নেহের সেই শিষ্যকে আজও ভুলতে পারেননি অ্যাপারিসিয়ো। টেলিভিশনে বার্সেলোনার হয়ে মেসির প্রথম গোল দেখে আবেগে কেঁদে ফেলার কথাও জানিয়েছেন নিজেই, ‘বার্সার জার্সিতে মেসিকে প্রথম গোল করতে দেখে আমি কান্না জুড়ে দিই। পাশের রুম থেকে কান্না শুনে আমার মেয়ে এসে বলল, কী হয়েছে? আমি বললাম, কিছুই না।’
ফুটবলার হিসেবে শৈশবেই বড় কিছু হওয়ার ইঙ্গিত দিলেও ছাত্র হিসেবে মেসি খুব একটা ভালো ছিলেন না। লেখাপড়ায় খুব আগ্রহও ছিল না। প্রথম থেকে তৃতীয় গ্রেড পর্যন্ত মেসির শিক্ষক মনিকা দোমিনা স্মৃতিচারণা করেন, ‘লেখাপড়ায় ভালো করতে না পারলেও লিওর অবস্থান ছিল গ্রহণযোগ্য পর্যায়ে। শুরুতে কোনো কিছু পড়তে ওর খুব সমস্যা হতো। আমি ওর মাকে ওকে একজন বাকবিশেষজ্ঞের কাছে নেওয়ারও পরামর্শ দিই৷ অন্য বিষয়গুলোতে সে অল্প অল্প করে উন্নতি করলেও কোনোটাতেই চমক-জাগানিয়া নম্বর পায়নি। তবে সে ছিল খুবই শান্ত, ধীরস্থির আর লাজুক। আমি আমার গোটা শিক্ষকতা জীবনে এমন লাজুক ছাত্র দেখিনি। ক্লাসে সব সময় পেছনে নীরবে বসে থাকত।’
সেদিনের সেই গড়পড়তা ছাত্রটিই আজ বিশ্ব ফুটবলের মহানায়ক৷
সূত্র: বিভিন্ন সময়ে প্রথম আলোয় প্রকাশিত প্রতিবেদন, একাধিক ওয়েবসাইট ও লুকা কাইয়োনির বই মেসি৷
আইএস