বাংলাভূমি২৪ ডেস্ক ॥ সবজি চাষে মরণদশা কৃষকেরসবজি চাষে মরণদশা কৃষকেরবছরের প্রথম দিনে ঈশ্বরদীর কাঁচাবাজারগুলোতে বেগুন আর শিমের খুচরা দর তিন টাকা কেজি। ফুলকপি চার টাকা। সস্তা পেলে লোকে খুশি হয়। কিন্তু দেখা গেল এ সস্তা এমনই সস্তা যে বিক্রেতা তো খুশি ননই, ক্রেতার মনেও সস্তায় কেনার সেই তৃপ্তিটি নেই। ঈশ্বরদীর নির্বাচন কমিশন অফিসের কর্মচারী শওকত হোসেন সকালে ১০ টাকায় তিন কেজি বেগুন কিনে মন্তব্য করলেন, ‘এবার কৃষক মরি যাবিনি। তিন কেজি বাগুন আনলাম দশ টাকা দিই।’
খুচরা দর দেখেই শীতের সবজির পাইকারি দর সম্পর্কে ধারণা মিলবে। আসলে পাইকারিতে সবজি বেচাকেনাই হচ্ছে না দেশের অন্যতম প্রধান সবজির পাইকারি বাজার ঈশ্বরদীতে। আড়তগুলোর ঝাঁপ বন্ধ। সামনে নেই ট্রাকের সারি। মজুরদের হাঁকডাকের পরিচিত দৃশ্য দেখা যাচ্ছে না। এখন সবজির ভরা মৌসুম। অথচ হরতাল-অবরোধে গত নভেম্বর থেকে মুখ থুবড়ে পড়েছে সবজির ব্যবসা। নতুন বছরটি শুরু হলো আরও অনিশ্চয়তা নিয়ে, অনির্দিষ্টকালের অবরোধ দিয়ে।
প্রায় ৫০০ কোটি টাকার লোকসান গুনতে হচ্ছে এবার এই অঞ্চলের সবজিচাষিদের। যা কোনোভাবেই আর পুষিয়ে নিতে পারবেন না তাঁরা। খোদ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা খুরশীদ আলম হতাশ হয়ে বলেছেন, ‘আমি কোনো আশা দেখছি না। মাঠেও যেতে ইচ্ছে করে না। মাঠ ভরা ফসল। কিন্তু বিক্রি হচ্ছে না।’
উপজেলা কৃষি বিভাগ থেকে জানা গেল, এবার শুধু ঈশ্বরদীতেই পাঁচ হাজার ৭৮৬ হেক্টর জমিতে সবজি চাষ হয়েছে। উৎপাদন এক লাখ ৮২ হাজার মেট্রিক টন। গড়ে এর পাইকারি দাম ১৬০ কোটি টাকার বেশি। এর মধ্যে শিমই উৎপাদন হয়েছে ১০০ কোটি টাকার বেশি। এ ছাড়া আশপাশের অঞ্চলের উৎপাদিত সবজি ঈশ্বরদী থেকে দেশের বিভিন্ন এলাকায় যায়। সব মিলিয়ে অক্টোবর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত প্রায় ৭০০ কোটি টাকার সবজির ব্যবসা হয় এখানে। ডিসেম্বর পর্যন্ত থাকে সবজি ব্যবসার সেরা সময়। অক্টোবর মাসের আগাম আবাদের চালানটি পাঠানো হয়েছে। তার পর থেকেই যখন ব্যাপক হারে সবজি উঠতে শুরু করেছে, তখন থেকে হরতাল-অবরোধও শুরু হয়েছে। এখন সবজি মাঠে পড়ে আছে। খুচরা আর কতটাই বা চলে।
ঈশ্বরদীতে বেশ কয়েকজন জাতীয় পর্যায়ের কৃষক আছেন। কৃষিতে অসাধারণ অবদান রাখার জন্য তাঁরা জাতীয় পুরস্কার পেয়েছেন। যিনি যে ফসলে অবদান রেখেছেন সেই ফসলের নামে নাম হয়েছে তাঁদের। যেমন কুল ময়েজ, কপি বারি, গাজর জাহিদুল, পেঁপে বাদশা। আমরা গিয়েছিলাম জগন্নাথপুরে কুল ময়েজের খামারে। তাঁর পুরো নাম সিদ্দিকুর রহমান। নিজের ৫০ ও চুক্তি নেওয়া ২৫০, মোট ৩০০ বিঘার খামার তাঁর। দেশব্যাপী কুল চাষ জনপ্রিয় করতে অসাধারণ অবদান রেখেছেন তিনি। অথচ গত বছর কুল চাষে এক কোটি আট লাখ টাকা লোকসান হয়েছে তাঁর। কুল হয়েছিল ১২ হাজার মণ। কুলের প্রধান মৌসুম জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি ঢাকা ছিল উত্তাল, ফেব্রুয়ারিতে চার দিন হরতাল ছিল। ঠিক ওই সময়টাতেই তাঁর কুল পেকেছিল। বেচা যায়নি। মনের দুঃখে ঈশ্বরদী শহরে পাকা কুল গরু-ছাগলকে দিয়ে খাইয়েছিলেন। এবার কুলের বদলে জোর দিয়েছেন পেয়ারা ও সবজিতে। পেয়ারা আছে ১০২ বিঘায়। কুল ২০ বিঘায়। বাদবাকি সবজি। এর মধ্যে ৩০ বিঘায় গাজর, ১৫ বিঘায় বেগুন, ১০ বিঘায় শিম, বাদবাকি পেঁয়াজ, রসুন ও মসুর। গাজর, বেগুন, শিম এসব জমিতে পড়ে আছে। কত লোকসান হবে ভাবতেই পারছেন না। আশা করেছিলেন, গতবারের ক্ষতি এবার কিছুটা হলেও পুষিয়ে নেবেন। কিন্তু দেশে যে অবস্থা চলছে তাতে ক্ষতির পাল্লা আরও কত ভারী হবে, সেই দুশ্চিন্তায় তিনি অস্থির। ওদিকে ব্যাংকে অনেক টাকার ঋণ। কিস্তি শোধ দিতে না পারায় সার্টিফিকেট মামলা হয়েছে। কুল ময়েজ দিনমজুর থেকে বর্গাচাষি, তারপর এত বড় খামারি হয়েছেন। সব করেছেন নিজের অক্লান্ত চেষ্টায়। জানালেন, তাঁর খামারে দুই শ মজুর কাজ করেন। এঁরা অভিজ্ঞ ও স্থায়ী। প্রতি মাসে বেতন দিতে প্রায় ১৫ লাখ টাকা খরচ হচ্ছে। এত দিনের শ্রমে-ঘামে তৈরি খামারের ভবিষ্যৎ নিয়েই তিনি শঙ্কিত হয়ে পড়েছেন।
ঈশ্বরদীতে এমন বড় খামারি আছেন ১৫-১৬ জন। প্রত্যেকেরই প্রায় একই অবস্থা। দিয়াড় সাহাপুরের গাজরচাষি রফিকুল ইসলাম জানালেন, দুই হাজার টাকা মণ দরের গাজর গতকাল বুধবার বিক্রি করেছেন আড়াই শ টাকা দরে। ছোট চাষিদের তো বলতে গেলে ‘হালে পানিই নেই।’
আড়তদারদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, ট্রাক চলছে না। এখানে সবচেয়ে বড় আড়ত মুলাডুলিতে। এ ছাড়া শহরের ঈশ্বরদী বাজার, পৌর মার্কেটসহ আশপাশের ছিলিমপুর হাট, ভারইমারি, শেখেরদাইর, বক্তারপুর, জগন্নাথপুর, মানিক নগর, জয়নগর, বড়ইচরা, সাহাপুর, আওতাপাড়া, গড়গড়ি, চর সাহাপুর, বিলকেদার এসব এলাকায় রয়েছে সবজির আড়ত। মুলাডুলির কাঁচামাল আড়তদার সমিতির কোষাধ্যক্ষ আমিনুর রহমান জানালেন, মুলাডুলি থেকে এ সময় প্রতিদিন শুধু শিমই যায় ৮০ থেকে ১০০ ট্রাক। যশোর ও খুলনা বাদে দেশের সব এলাকায় ঈশ্বরদী থেকে সবজি পাঠানো হয়। মৌসুমের এই ‘পিক টাইমে’ গোটা ঈশ্বরদী থেকে প্রতিদিন দেড় থেকে দুই শ ট্রাক পর্যন্ত সবজি যায়। তাঁর ভাষায়, ‘এখন আড়তগুলোর সামনে মাছিও নেই।’
অবরোধ দিয়ে শুরু হওয়া নতুন বছরটিও কোনো মঙ্গলের বার্তা নিয়ে এল না কৃষকদের কাছে। তাঁদের সত্যি মরে যাওয়ার মতো অবস্থা, দশ টাকায় তিন কেজি বেগুন কিনে যে কথাটি বলেছিলেন ওই ক্রেতা।