স্পোর্টস ডেস্ক ॥
আইসিসি ইভেন্ট বিশেষ করে বিশ্বকাপ ক্রিকেটে বাংলাদেশের পয়মন্ত দল ইংল্যান্ড। পরিসংখ্যান জানাচ্ছে ২০১১ আর ২০১৫ দুই বিশ্বকাপে পরপর টাইগারদের কাছে হেরেছে ইংলিশরা। পরিসংখ্যান নিয়ে যারা ঘাটাঘাটি বেশি করেন আর বাংলাদেশ সমর্থকদের যে অংশটি সংস্কারবাদী তারা একটু বেশিই আশাবাদী আজ ওভালে জিতবে মাশরাফির দল। তা জিততেই পারে। শুধু শেষ দুই বিশ্বকাপেই নয়। ইতিহাস জানাচ্ছে এইতো সাত মাস আগে গত ৯ অক্টোবর হোম অফ ক্রিকেট শেরেবাংলায় আবার ইংলিশ বধের রেকর্ড আছে মাশরাফির দলের।
গত দুই বছরে যে দলটি দুই দুই বার ৪০০ রানের হিমালয় সমান স্কোর গড়েছে, ৩০০ যাদের প্রায় নিয়মিত স্কোর- সেই দলকে তাদের মাটিতে হারানো সহজ কাজ নয়। তাও চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির মতো অভিজাত আসরের প্রথম দিনে। কিন্তু নিকট অতীত ও সাম্প্রতিক সাফল্যের কারণে অনেক বোদ্ধা-বিশেষজ্ঞ আজ বিশ্ব ক্রিকেটের অন্যতম প্রাচীন ও অভিজাত ভেন্যু ওভালে বাংলাদেশকেও পিছিয়ে রাখছেন না।
বরং বাংলাদেশও জিততে পারে- এমন কথাও উচ্চারিত হচ্ছে অনেকের মুখে। এটা সত্যি, আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে অনেক বেশি ইতিবাচক মানসিকতা ও আক্রমণাত্মক এখন ইংলিশরা। তাদের বধ করতে হলে সামর্থ্যের সেরাটা উপহারের বিকল্প নেই। তাই টাইগারদের জিততে চাই সম্মিলিত প্রয়াস। কম-বেশি সবার অবদান। ক্রিকেটীয় পরিভাষায় যাকে বলে টিম পারফরম্যান্স। অর্থাৎ ব্যাটিং ও বোলিং ও ফিল্ডিংয়ে গড়পড়তা কম-বেশি সবাই কিছু কিছু অবদান রাখবেন। তবেই ধরা দিতে পারে বহুল কাঙিক্ষত জয়ের দেখা।
গত দুই বছরের বেশি সময় ধরে মাশরাফির নেতৃত্বে তামিম, সৌম্য, ইমরুল, সাব্বির, সাকিব, মুশফিক, মাহমুদউল্লাহ, মোস্তাফিজ ও রুবেলরা মাঝেমধ্যে টিম পারফরম্যান্স করে দেখিয়েছেন। তবে একটা আশার কথা, ইতিহাস জানাচ্ছে ইংল্যান্ডের সাথে বাংলাদেশ যে গত তিন ম্যাচ জিতেছে, তাতে কারো একার চেয়ে কয়েকজনের সামষ্টিক পারফরম্যান্সই ছিল মূখ্য।
তিন ম্যাচেই বেশ কজন পারফরমার ভালো খেলেছেন। তাদের সস্মিলিত প্রচেষ্টা ও কার্যকর অবদানেই ধরা দিয়েছে জয়। কাকতালীয়ভাবে তিনটি ম্যাচেই একটি দৃশ্য চোখে পড়েছে। তা হলো- ম্যাচ সেরা হয়েছেন একজন, আর দল জয়ের বন্দরে পৌঁছেছে অন্য কারো হাত ধরে। তবে একজন ঠিক হিমালয়ের দৃঢ়তায় ব্যাট হাতে দাঁড়িয়ে দলের সাফল্যে রেখেছেন গুরুত্বপূর্ণ অবদান। তিনি মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ।
গত দুই বছরের বেশি সময় বাংলাদেশ যে তিনবার ইংল্যান্ডকে হারিয়েছে, তিন জয়ের অন্যতম রূপকার মাহমুদউল্লাহ। ম্যাচ সেরার পুরস্কার একজন পেলেও দল জিতিয়ে মাঠ ছেড়ছেন অন্য দুজন, এর প্রথম উদাহরণটি ২০১১ সালের বিশ্বকাপে। ম্যাচ সেরার পুরস্কারটা উঠেছে ইমরুল কায়েসের হাতে।
কিন্তু ২০১১ সালের ১১ মার্চ চট্টগ্রামের জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়ামে বিশ্বকাপের গ্রুপপর্বের ম্যাচে ইংলিশদের বিপক্ষে ২ উইকেটের অবিস্মরণীয় জয়ের নায়ক আসলে দুজন; মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ ও শফিউল ইসলাম। ২২৫ রানের পিছু ধেয়ে ১৬৯ রানে ৮ উইকেট খুইয়ে হারতে বসেছিল টাইগাররা। ঠিক সেখানে ত্রাণকর্তার ভূমিকায় মাহমুদউল্লাহ-শফিউল। নবম উইকেটে অবিচ্ছিন্ন ৫৮ রানের জুটি (৯.২ ওভারে)। মাহমুদউল্লাহ সাত নম্বরে নেমে একদিক আগলে ছিলেন শেষ অবধি। তার ৪২ বলে ২১ রানের ইনিংসের অপর প্রান্তে দরকার ছিল একটি আক্রমণাত্মক ইনিংস। সেটা খেলেন শফিউল। চার বাউন্ডারি আর এক ছক্কায় বল সমান ২৪ রানের হার না মানা ইনিংস খেলেন এ পেসার।
আর তাতেই ছয় বল আগেই জয়ের বন্দরে পৌঁছে যায় বাংলাদেশ।
চার বছর পর ২০১৫ সালের ৯ মার্চ অস্ট্রেলিয়ার অ্যাডিলেডে বিশ্বকাপের গ্রুপপর্বের ম্যাচে ইংলিশদের বিপক্ষে আবার চমক বাংলাদেশের। এবারও সম্মিলিত প্রচেষ্টার জয়। আগে ব্যাটিংয়ে নেমে ২৭৫ রানের লড়িয়ে পুঁজি। অসাধারণ সেঞ্চুরি মাহমুদউল্লাহর। চার নম্বরে নেমে একদিক আগলে রাখার কাজটি করে দেন মাহমুদউল্লাহ। শুরু ভালো হয়নি মোটেই। বোর্ডে ৮ রান যোগ হতেই আউট দুই ওপেনার তামিম (২) ও ইমরুল (২)। মাত্র তৃতীয় (২.১) ওভারে গিয়ে ৪৫.৪ওভার পর্যন্ত ক্রিজে কাটিয়ে উপহার দেন এক দায়িত্বপূর্ণ শতক।
শুরুর ধাক্কা সামলাতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন সৌম্য সরকার। এ তরুণ বাঁহাতি খেলেন ৪০ রানের (৫২ বলে) ঝকঝকে তকতকে আর উজ্জীবিত ইনিংস। তাতেই শুরুর ক্ষতে লাগে প্রলেপের আঁচর। তৃতীয় উইকেটে ৮৬ রানের সময়োচিত জুটি গড়ে ওঠে সৌম্য আর মাহমুদউল্লাহর মধ্যে। সৌম্য বিদায় নিলে মাহমুদউল্লাহর সাথে জুটি গড়েন মুশফিক। দুই ভায়রার হাত ধরে বাংলাদেশ পৌঁছে যায় পৌনে তিনশোর ঘরে ২৭৫। তার ১৩৮ বলে ১০৩ রানের ইনিংস দেয় মজবুত ভিত।
তার সাথে যোগ হয় মুশফিকুর রহিমের বীরোচিত উইলোবাজি। এ পরিশ্রমী আর সাহসী যুবা উপহার দেন ৭৭ বলে ৮৯ রানের দারুণ সাহসী ও আক্রমনাত্মক ইনিংস। এরপর বল হাতে রুবেল ম্যাজিক। ৫৩ রানে ৪ উইকেট। যার দুুটি একদম ভাইটাল সময়ে। অনেক চড়াই-উৎরাই পাড় হয়ে এক সময় ইংলিশরা জয়ের কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছিল। ঠিক সেই সময় রুবেলের আঘাত। পর পর দুটি এক্সপ্রেস আর ইয়র্কার লেংথের দুর্দান্ত ডেলিভারিতে স্টুয়ার্ট ব্রড আর জেমস অ্যান্ডারসনের উইকেট উপড়ে যায়। আর তাতেই ধরা দিল ১৫ রানের অবিস্মরণীয় জয়।
ঠিক আগের ওভারেই ফাস্ট বোলার তাসকিন আহমেদকে মিডউইকেটের ওপর দিয়ে পুল করে ছক্কা হাঁকিয়ে ভয় ধরিয়ে দিয়েছিলেন ব্রড। কিন্তু ৪৯ নম্বর ওভারের প্রথম বলে রুবেলের ফুললেন্থ ডেলিভারি বোল্ড ব্রড। ১৪২ কিলোমিটার গতির ওই ডেলিভারির দুই বল পর আবার আঘাত রুবেলের। এবার তার ইয়র্কারে কিছু বুঝে ওঠার আগেই ভেঙে গেল জেমস অ্যান্ডারসনের উইকেট। এরই সঙ্গে ২০১১-র মত ২০১৫ সালের বিশ্বকাপেও ইংল্যান্ডকে হারানোর আনন্দে উদ্বেলিত মাশরাফির দল।
এরপর বাংলাদেশ আরও একবার ইংলিশদের হারিয়েছে। সেটা ২০১৬ সালের ৯ অক্টোবর ঢাকার শেরেবাংলা স্টেডিয়ামে। এবারও মাহমুদউল্লাহই জয়ের অন্যতম স্থপতি। তবে এ সাফল্যের মিশনে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিলেন অধিনায়ক মাশরাফি। ২৯ বলে ৪৪ রানের ঝড়ো ইনিংসের পর আগুন ঝড়ানো বোলিং (২৯ রানে ৪ উইকেট)। সে আগুনে পুড়ে ছাড়খার ইংলিশ ব্যাটিং। তাই বলে মাহমুদউল্লাহ রিয়াদের অবদানও কিন্তু কম নয়। এবার প্রতিষ্ঠিত ব্যাটসম্যানদের কারো ব্যাট কথা বলেনি। তামিম (১৪), ইমরুল (১১), সাব্বির (৩), মুশফিক (২১), সাকিব (৩), মোসাদ্দেক (২৯) ও নাসির (২৭) কারো ব্যাট থেকে একটি বড় ইনিংসও বেরিয়ে আসেনি।
প্রতিষ্ঠিত ব্যাটসম্যানদের সবার ব্যর্থতা ও ঘাটতি পুষিয়ে দিলেন একা মাহমুদউল্লাহ। চার নম্বরে নেমে ৮৬ বলে ৭৫ রানের দারুণ আত্ববিশ্বাসী ও দায়িত্বপূর্ণ ইনিংস খেললেন দলের প্রয়োজনে বেশির ভাগ সময় দায়িত্বসচেতনতার পরিচয় দেয়া এ অলরাউন্ডার। আর শেষ দিকে মাশরাফি ঝড়। নয় নম্বরে নেমে তিন বিশাল ছক্কা আর দুই বাউন্ডারিতে ৪৪ রানের হার না মানা ইনিংস। আর পরে বল হাতে চার ইংলিশ জেসন রয়, ভিন্স, স্টোকস আর জ্যাক বলকে আউট করে জয়ের নায়ক ও ম্যাচ সেরা টাইগার ক্যাপ্টেন।
মাঝে আকাশে অনেক মেঘ গড়িয়েছে। পদ্মা, মেঘনা, বুড়িগঙ্গা আর টেমস নদীতেও অনেক জল গড়িয়েছে। আজ নতুন দিন। ভিন্ন প্রেক্ষাপট। অন্য রকম আবহাওয়া ও আরেক নতুন লড়াই। এ লড়াইয়ে কে হবেন বাংলাদেশের কাণ্ডারি? সেই মাহমুদউল্লাহ? আবার দলের সব দায়দায়িত্ব তুলে নেবেন নিজের চওড়া কাঁধে? নাকি মনের মাঝে পুষে রাখা দুঃখ-কষ্ট আর যন্ত্রণাকে শক্তিকে রূপান্তরিত করে আবার বারুদ ঝরাবেন মাশরাফি? নাকি ইদানিং অনেক দায়িত্ববোধ জাগা তামিম ইকবালের ব্যাট কথা বলবে?
বারবার বহুবার সংকটে, বিপদে আর প্রয়োজনে যে জুটি বাংলাদেশের আস্থার প্রতীক- সেই মুশফিক-সাকিবও কিন্তু অন্যতম নির্ভরতা। তাদের দিকেও তাকিয়ে দেশ। আর কাটার মাস্টার মোস্তাফিজকেই বা পিছিয়ে রাখা কেন?
এইতো সেদিন নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ৪ উইকেট দখল করে দেখিয়ে দিলেন স্লোয়ার আর কাটারের মিশেলে এখনো তিনিপ্রতিপক্ষ ব্যাটিং লাইন আপে কাঁপন ধরাতে পারেন।
আরে রুবেল হোসেনের কথা বাদ থাকলে কি চলে? মাঝে ইনজুরি ও মাঠের বাইরের ইস্যুতে অনিয়মিত হয়ে পড়লেও নিজেকে আবার বড় মঞ্চের জন্য তৈরি করেছেন রুবেল। ভারতের সাথে দুঃস্বপ্নের ম্যাচেও রুবেল দেখিয়েছেন এখনো ‘ডেথ ওভারে’ তিনি অনেক কিছুই করতে পারেন।
বাদ থাকল সৌম্য, মোসাদ্দেক আর মিরাজের কথা। এ তিন তরুণের মাঝেও বারুদ আছে। তারাও পারেন। তাদের পর্যাপ্ত সামর্থ্য আছে দলের সাফল্যে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখার। প্রবল স্রোত আর উত্তাল ঢেউ অতিক্রম করে নৌকা পাড়ে ভেড়াতে কারো শক্ত হাতে হাল ধরতে হয়। মাহমুদউল্লাহ আর মাশরাফি আছেন হাল ধরার জন্য। বাকি মাঝি-মাল্লাও কিন্তু বেশ চৌকস। তাহলে আর ভয় কি?