বুধবার , ১৩ই নভেম্বর, ২০২৪ , ২৮শে কার্তিক, ১৪৩১ , ১০ই জমাদিউল আউয়াল, ১৪৪৬

হোম > গ্যালারীর খবর > কেলেঙ্কারিতে দেশ সেরা, তবুও ধরাছোঁয়ার বাইরে তারা

কেলেঙ্কারিতে দেশ সেরা, তবুও ধরাছোঁয়ার বাইরে তারা

শেয়ার করুন

বাংলাভূমি২৪ ডেস্ক ॥ দেশের সেরা দুর্নীতিবাজ ও লুটেরা এখন কারা? এ প্রশ্নের উত্তরে যাদের নাম প্রথমেই সামনে আসে তারা হলেন- সাবেক গৃহায়ন ও গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রী আবদুল মান্নান খান, সচিব ড. শওকত হোসেন ও রাজউকের সাবেক চেয়ারম্যান নুরুল হুদা।

কেলেঙ্কারির শেষ নেই তাদের। কিন্তু এ ত্রিরতেœর টিকির নাগাল এখনো ধরতে পারেনি কেউ। তাদের নজিরবিহীন অনিয়ম, দুর্নীতি ও লুটপাটকে ‘রাষ্ট্রদ্রোহিতা’ আখ্যা দেওয়া হলেও আইনি ব্যবস্থা কার্যকর হচ্ছে না এখনও। দুদক দফতরে এ তিনজনের বিরুদ্ধেই শত শত অভিযোগ, চলছে একের পর এক তদন্ত। প্রমাণিত দুর্নীতি ও লুটপাটের ঘটনায় মামলাও রুজু করা হয়েছে।

পাঁচ বছর লুটপাট চালিয়ে দেশের উন্নয়ন খাত ক্ষতিগ্রস্ত করার কারণে তাদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা হওয়ার কথা থাকলেও এখনো রয়েছেন সদাপটে, বহাল তবিয়তে। এমনকি তাদের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত দুর্নীতির মামলাগুলোর গতিও ধীর। কেন তারা ধরাছোঁয়ার বাইরে- এ প্রশ্নের কোনো উত্তর মিলছে না।

আওয়ামী লীগ সরকারের আগের দফায় আবদুল মান্নান খান গৃহায়ন ও গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পরপরই তিনি ওই মন্ত্রণালয়ের সচিব ড.
শওকত হোসেনকে সঙ্গে নিয়ে দুর্নীতি-লুটপাটের সংঘবদ্ধ চক্র গড়ে তোলেন। মন্ত্রণালয়ভুক্ত সব দফতর, অধিদফতরে দুর্নীতির বিষবৃক্ষ রোপণের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় সম্পদের হরিলুট চালাতে থাকেন তারা। কিছু দিনের মধ্যেই আবদুল মান্নান খানের লুটেরা চক্রে যুক্ত হন আরেক সাঙ্গাত রাজউক চেয়ারম্যান নুরুল হুদা।

বেশভূষায় নিজেকে নব্য দরবেশরূপে জাহির করলেও নুরুল হদা ছিলেন দুর্নীতি আর লুটপাটে সিদ্ধহস্ত। ত্রিরতেœর এই দুর্নীতিবাজ চক্র শুধু সরকারি সম্পদ লুটপাটেই ব্যস্ত ছিলেন না, বেসরকারি আবাসন শিল্প খাত থেকে নানা ছলে-বলে-কৌশলে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়ে এ শিল্পকে ধ্বংসের পাঁয়তারায় মেতে উঠেছিলেন।

বিএলডিএ সূত্র জানায়, দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনৈতিক আয়ের খাত হিসেবে ‘আবাসন শিল্প’ জাতীয় অর্থনীতিতে অবদান রাখছে ২১ শতাংশ। এর সঙ্গে যুক্ত ৩০০টি শিল্প খাতে বিনিয়োগের পরিমাণ প্রায় ১৭৫ হাজার কোটি টাকা। প্রবাসী বাঙালিদের পাঠানো অর্থের প্রায় ৫০ ভাগ এ খাতে বিনিয়োগ হয়। এ খাতের ওপর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে নির্ভরশীল প্রায় আড়াই কোটি মানুষ।

অথচ দুর্নীতিবাজ এ তিন জনের সীমাহীন অনিয়ম-লুটপাটের কবলে পড়ে বেসরকারি আবাসন শিল্পে রীতিমতো অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। প্রতিমন্ত্রীর সীমাহীন আক্রোশ ও কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার খায়েশে কয়েক বছর ধরে এ খাতে নানামুখী হয়রানি চাপিয়ে দেওয়া হয়। ফলে, আবাসন খাতের অচলাবস্থায় বিনিয়োগের একটি বড় অংশ আটকে যায়।

ইতোমধ্যে প্রায় ২৫ লাখ শ্রমিক বেকার হয়ে পড়েছে এবং এ খাতে নতুন কর্মসংস্থানেরও সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে না। রাজউকের সাইনবোর্ড সামনে রেখে তারা বেসরকারি আবাসন বাণিজ্যের সব মুনাফা নিজেদের পকেটস্থ নিতেও শুরু করেন। নানামুখী দুর্নীতির ফাঁদ পেতে লুটেরা ত্রিরতœ কোটি কোটি টাকার পাহাড় জমিয়ে তোলেন। শুধু এ কারণেও তাদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা হতে পারে।

চৌচালা টিনের ঘর এখন সুরম্য অট্টালিকা: গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় থেকে সরিয়ে দেওয়ার পর থেকেই সাবেক প্রতিমন্ত্রী মান্নান খানের অনিয়ম-দুর্নীতির সব ভয়াবহ চিত্র বেরিয়ে আসে। মন্ত্রিত্বের সময় তার মন্ত্রণালয় এবং এর অধীন দফতরগুলোয় লুটপাটের মহোৎসব চলেছে। প্লট বরাদ্দ, অনিয়ম, ঘুষ আর দুর্নীতিতে নিমজ্জিত ছিলেন তিনি এবং তার ঘনিষ্ঠ কর্মকর্তারা। মন্ত্রণালয় ছাড়াও রাজউক, জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষ, গণপূর্ত অধিদফতর সর্বত্রই ছিল তার হাত।

ঢাকা-১ (দোহার-নবাবগঞ্জ) আসনের এমপি আবদুল মান্নান খানের প্রতিমন্ত্রী হওয়ার আগে ব্যাংকে মাত্র ১ হাজার ৭০০ টাকা গচ্ছিত থাকলেও এখন দেশ-বিদেশে স্বনামে-বেনামে শতাধিক কোটি টাকার সম্পদ গড়তে সক্ষম হয়েছেন। আগে একটা গাড়ি ব্যবহারের মতো যার আর্থিক সঙ্গতি ছিল না, এখন তিনি হাঁকান ৫০ লাখ টাকার পাজেরো, স্ত্রীর ব্যবহার করা গাড়ির দাম আরও বেশি। আগে কোনো ফ্ল্যাট ছিল না, থাকতেন কলাবাগানের ভাড়া বাসায়।

এখন সেখানে একাধিক ফ্ল্যাট। আবাসিক কাম বাণিজ্যিক দালানের (নূর আলী টাওয়ারে দুটি ফ্ল্যাট) মূল্য দেখানো হয়েছে ১ কোটি ৮১ লাখ ৮৬ হাজার টাকা।

অথচ এখানে দুটি ফ্ল্যাটের বাস্তব মূল্য কমপক্ষে ৬ কোটি টাকা। আর গ্রামের বাড়ির টিনের তৈরি চৌচালা ঘরের পাশেই তৈরি হয়েছে প্রায় ২ কোটি টাকা মূল্যের সুরম্য অট্টালিকা। স্ত্রীর নামেও জমা হয়েছে বিপুল পরিমাণ নগদ অর্থ। আছে স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ।

পাঁচ বছর আগে তার অন্য কোনো আয় দেখানো না হলেও এবার বলা হয়েছে, তিনি মৎস্য ও রেমিট্যান্স থেকে বছরে পেয়েছেন ১ কোটি ৪৪ লাখ ৬৩ হাজার ২২৭ টাকা। এ ছাড়া এ খাতে তার ওপর নির্ভরশীলদের বার্ষিক আয় দেখানো হয়েছে ১ কোটি ৭৩ লাখ ৩৯ হাজার ৬৫৫ টাকা। তবে, এ প্রসঙ্গে কোনো ব্যাখ্যা কিংবা মৎস্য ও রেমিট্যান্স থেকে পৃথকভাবে আসা টাকার হিসাব দেখানো হয়নি। বিদেশ থেকে কারা রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন তাও বলা হয়নি।

সম্পদের যেন শেষ নেই: গৃহায়ন প্রতিমন্ত্রীর দুর্নীতি সিন্ডিকেটের অন্যতম সহযোগী সাবেক পূর্ত সচিব ড. খোন্দকার শওকত হোসেন দুর্নীতি-লুটপাটের আলাদা ‘সাম্রাজ্য’ গড়ে তুলেছিলেন। প্রতিমন্ত্রীর পৃষ্ঠপোষকতায় মাত্র কয়েক বছরের মধ্যে তিনি কামিয়ে নেন অন্তত ১ হাজার ৮০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে বিদেশেই পাচার করেছেন ৮০০ কোটি টাকা। দুর্নীতি দমন কমিশনও তার বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ তুলে তিনটি মামলা করেছে। আরও সব দুর্নীতি-লুটপাট ও বেশুমার সম্পদ নিয়েও চলছে তদন্ত।

ক্ষমতার অপব্যবহার, নিয়মনীতি লঙ্ঘন, আমলা হয়েও রাজনীতিবিদদের মতো আচার-আচরণ, ভাষণ দেওয়াসহ অসংখ্য অভিযোগে অভিযুক্ত তিনি। এত কিছুর পরও শওকত হোসেন দাপুটে সচিব হিসেবেই দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন। ড. শওকত এখন প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব। এরই মধ্যে তিনি পরিচিত হয়ে উঠেছেন ‘মহাদুর্নীতিবাজ’ হিসেবে। অনেক মন্ত্রী, এমপি, প্রভাবশালী রাজনীতিবিদও তার দুর্নীতির কাছে শিশু।

দুদকের তিনটি মামলা, বিদেশে টাকা পাচারের স্পর্শকাতর তথ্য ও প্রতারণাসহ অসংখ্য অভিযোগ সত্ত্বেও ড. শওকত সপদে এবং দাপটের সঙ্গেই বহাল রয়েছেন। সচিব ড. শওকত হোসেনের বেশুমার সম্পদের যেন শেষ নেই। তার স্ত্রী আয়েশা খানমের নামে উত্তরা ৬ নম্বর সেক্টরে (রোড-৯, বাড়ি-১৩৪) ৬ কাঠা প্লটের ওপর ছয় তলা ভবন করেছেন, যার বাজারমূল্য প্রায় ৮ কোটি টাকা। গুলশান-১-এর ১২ নম্বর রোডের ২২০ নম্বর অ্যাপার্টমেন্টে একটি ফ্ল্যাট কিনেছেন। এর মূল্য সাড়ে ৩ কোটি টাকা। সাভার-আশুলিয়ায় রয়েছে ১২০ বিঘা জমি, যার মূল্য এখন শত কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে।

ময়মনসিংহের ভালুকা শিল্প এলাকায়ও শওকত হোসেনের রয়েছে ৪০ বিঘা জমি, যার মূল্য প্রায় ১৬ কোটি টাকা। নিজের ভাইদের নাম ব্যবহার করে তিনি কক্সবাজার সি-বিচ ঘেঁষে ৩ বিঘা জমি কিনেছেন, যার বাজারমূল্য প্রায় ২০ কোটি টাকা। রাজধানীর বনানীতে স্ত্রী ও শ্যালকের নামে ৮ কাঠার প্লট কিনেছেন।

এর বাজারমূল্য ৩৮ কোটি টাকা। মোহাম্মদপুরে ১৪ কোটি টাকায় ৭ বিঘা জমি কিনেছেন, তা রেজিস্ট্রি করেছেন ভাইয়ের নামে। দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের আবদুল্লাহপুরে ১৫ বিঘা জমি কিনেছেন ৩৬ কোটি টাকায়। তার নিজ নামে প্লট-ফ্ল্যাট, বাড়ি-গাড়ি, জমি, ব্যাংক ব্যালান্স ছাড়াও স্ত্রী, শ্যালক ও ভাইদের নামে ৩০টি ট্রাক, শেয়ারসহ নানা সম্পদ রয়েছে।

এখানেই ড. শওকতের সম্পদের শেষ নয়, পুঁজিবাজারে স্ত্রী ও শ্যালকদের বিও অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে বিনিয়োগ করেছেন প্রায় ৩০০ কোটি টাকা। বিভিন্ন ব্যাংকে ৪০০ কোটি টাকার এফডিআর করে রাখা আছে। এসব ছাড়াও তার সম্পদের একটা বড় অংশ দেশের বাইরে পাচারের অভিযোগও পেয়েছে দুদক।

এসব জ্ঞাত সম্পদের বাইরে আরও না জানা প্রচুর সম্পদ রয়েছে বলে দুদক কর্মকর্তারা ধারণা করছেন। এসব সম্পদের খোঁজে সর্বত্র অনুসন্ধান চালানো হচ্ছে।

এ নিয়ে দুদক থানায় তিনটি মামলা রুজুর পাশাপাশি তাকে ২০ মে ও পরে ২৫ মে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তলব করে। একাধিক নোটিসও দেওয়া হয়। কিন্তু দোর্দণ্ড প্রতাপশালী সচিব ড. খোন্দকার শওকত সেসব নোটিসকে পাত্তাও দেননি।

সম্পদ লুটেরা দরবেশ: পূর্ত প্রতিমন্ত্রী ও সচিবের যাবতীয় দুর্নীতি-লুটপাটের প্রধান জোগানদাতা ছিলেন রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) সাবেক চেয়ারম্যান প্রকৌশলী নুরুল হুদা। তার স্বেচ্ছাচারিতা আর প্লট বাণিজ্যের দৌরাত্ম্য নিয়ে রাজউকে কর্মরতদের মাঝে ছিল চরম ক্ষোভ। কিন্তু প্রতিমন্ত্রী ও সচিবসহ একাট্টা থাকায় তার বিরুদ্ধে টুঁ শব্দটি করার সাহস পেত না কেউ। প্রায় পাঁচ বছর রাজউকের চেয়ারম্যান থাকা অবস্থায় নিজের নামে ১০ কাঠার প্লট, গুলশান, উত্তরা, পূর্বাচল ও ঝিলমিল প্রকল্পে পরিচিতদের মাঝে নিজের খেয়ালখুশি মতো প্লট বরাদ্দ দিয়ে হাতিয়ে নিয়েছেন কোটি কোটি টাকা। প্লট বরাদ্দ থেকে শুরু করে বিভিন্ন ঠিকাদার কোম্পানিকে কাজ দিয়ে হাতিয়ে নিয়েছেন মোটা অঙ্কের টাকা।

সর্বশেষ চলতি বছর ৩ নম্বর বোর্ড সভায়ও বেশ কয়েকটি প্লট ও খণ্ড জমি বরাদ্দ দিয়ে অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ ওঠে। রাজধানীর উত্তরার সরকারি আবাসন প্রকল্পের সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকার কাজ নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরেই পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন রাজউকের সাবেক এই চেয়ারম্যান।

লুটপাটের যত অভিযোগ: সাবেক গৃহায়ন ও পূর্ত প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আবদুল মান্নান খান এবং কর্মরত পূর্ত সচিব ড. খোন্দকার শওকত হোসেনের ক্ষমতার অপব্যবহারের কারণে ধানমন্ডির মতো অভিজাত এলাকায় সরকারের প্রায় আড়াই শ কোটি টাকা মূল্যের বাড়ি হাতছাড়া হতে বসেছে। মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের আপত্তি উপেক্ষা করে বাড়িটি সরকারের পরিত্যক্ত সম্পত্তির তালিকা থেকে ভুয়া ব্যক্তির অনুকূলে অবমুক্ত করে দেওয়া হয়।

সরকার ও জনস্বার্থের পরিপন্থী এ সিদ্ধান্ত ফাঁস হয়ে গেলে অবমুক্ত করার সিদ্ধান্ত পরে বাতিল করা হয়। কিন্তু পরে এ-সংক্রান্ত নোটিসটি ফাইল থেকে গায়েব করে স্থিতাবস্থার সিদ্ধান্ত দেওয়া হয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ এ ফাইলটি প্রতিমন্ত্রীর বাসায় পাঁচ মাস ধরে পড়ে ছিল।

সর্বশেষ জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের একটি প্রকল্পের সঙ্গে প্রতিমন্ত্রীর স্ত্রীকে সফরে নিতে ৪০ লাখ টাকা চাঁদা তোলা হয়েছিল। এ সফরে মান্নান খান প্রকল্প খাত থেকে ১১ লাখ ৪৩ হাজার ১৬ টাকা নিয়েছেন। এ ছাড়া মোহাম্মদপুরের অর্ধশত কোটি এবং মিরপুরে শত কোটি টাকা মূল্যের প্লট হাতিয়ে নেওয়া চক্রের সঙ্গেও ছিল মান্নান খানের যোগসাজশ। দায়িত্ব ছাড়ার শেষ মুহূর্তে জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের কাছে থাকা জটিল প্লটের ফাইলগুলো ছাড়ানোর লাভজনক বাণিজ্য হাতে নেন তিনি।

মিরপুর ১ নম্বর সেকশনের চিড়িয়াখানা রোডের ১/জি-১ নম্বরের ৯টি প্লটের প্রায় ৩০ শতাংশ জায়গা হাতিয়ে নিয়েছে একটি চক্র। আর এ কাজে সহায়তা করেছেন আবদুল মান্নান খান। চিড়িয়াখানা রোডের প্রধান সড়কসংলগ্ন হওয়ায় এ প্লটগুলোর বাজারমূল্য প্রায় শত কোটি টাকা। রাজউক, গণপূর্ত অধিদফতর ও জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের দুর্নীতির কারণে সরকারি ১ হাজার ৬৯টি বাড়ি অবৈধ দখলে চলে গেছে। এসব বাড়ি উদ্ধারে পূর্ত মন্ত্রণালয়ের নথিতেই ১ হাজার ৬৯টি বাড়ির মধ্যে ১ হাজার ১৯টির কোনো হদিস নেই।

রাজউক গুলশান-বনানী এলাকায় ৪২টি মূল্যবান বাড়ি উদ্ধারের চেষ্টা করলেও মন্ত্রণালয়ের হস্তক্ষেপেই তা ব্যর্থ হয়ে যায়। সম্প্রতি রাজউকের দুর্নীতি নিয়ে সরকারি হিসাব সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির প্রথম বৈঠকে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন কমিটির সদস্যরা। সভার কার্যপত্রে বলা হয়- মূল নথির অস্তিত্ব না রেখে গুলশান-বনানীতে ১৬২টি পরিত্যক্ত প্লট হস্তান্তর এবং বিভিন্ন এলাকায় অনিয়মের মাধ্যমে বহুতল ভবন নির্মাণের নকশা অনুমোদন করেছে রাজউক। এতে প্রতিষ্ঠানটি নিজস্ব আয় হারানোর পাশাপাশি সরকারও প্রায় ২০ কোটি টাকা রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হয়েছে। সংসদীয় কমিটি ওই ১৬২টি পরিত্যক্ত প্লট কোনোভাবেই হস্তান্তর না করারও সুপারিশ করে।

প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের উপসচিব আবু মুসাকে দুদকে তলব: প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের উপসচিব আবু মুসাকে জিজ্ঞাসাবাদ করবে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। বুধবার সকাল ১০টায় তাকে হাজির হওয়ার জন্য নোটিস বিশেষ বাহক মারফত পাঠানো হয়েছে। মঙ্গলবার দুদকের উপ-পরিচালক যতনকুমার রায় এ নোটিশ জারি করেছেন।

দুদক সূত্র জানায়, কৌশলে আইনুল হক নামে এক ব্যক্তির প্লট দখল করেছেন সাবেক গৃহায়ন ও গণপূর্ত সচিব ড. খোন্দকার শওকত হোসেন। উত্তরা ১৩ নম্বর সেক্টরের ৮৬ নম্বরের ৫ কাঠার প্লটটি দৃষ্টি কাড়ায় ৩ কাঠা প্লটের পরিবর্তে ওই ৫ কাঠা দখল করেন সচিব। এর আগে ছলচাতুরীর মাধ্যমে আইনুলের ওই ৫ কাঠার প্লট রাজউকের মাধ্যমে বাতিল করানো হয়। প্রবাসীকল্যাণ সচিব ড. খোন্দকার শওকত হোসেনের বিরুদ্ধে দুদকের দায়ের করা তিনটি মামলার তদন্তে বেরিয়ে আসছে এমন চাঞ্চল্যকর তথ্য।

মামলার তদন্তসূত্র আরও জানায়, ৩ কাঠার পরিবর্তে পরপর দুটি ৫ কাঠার প্লট দেখানো হলেও সচিব শওকতের তা পছন্দ হয়নি। আইনুল হকের প্লটটি তার
পছন্দ হয়। প্লটটি দখলের জন্য জীবিত আইনুলকে মৃত দেখিয়ে তার ভুয়া ওয়ারিশদের দিয়ে প্লটের মালিকানা দাবি করানো হয়েছে।এরপর প্লটটি মাদকসেবীদের আখড়া হিসেবে দেখানো হয়। আবার আইনুলকে সাত দিনের মধ্যে রাজউকে হাজির হওয়ার জন্য তার গ্রামের বাড়ির ঠিকানায় চিঠি দেওয়া হয়। যথাসময়ে যাতে না পৌঁছে সে জন্য চিঠি আটকেও রাখা হয়।

রাজউকের শুনানিতে হাজির না হওয়ার অজুহাতে আইনুলের প্লটটি বাতিল করা হয়। দুদকের উপ-পরিচালক প্রণবকুমার ভট্টাচার্য বাংলানিউজকে এসব তথ্য নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেছেন, ড. শওকতের প্লট কেলেঙ্কারির সঙ্গে রাজউকের সাবেক উপ-পরিচালক, বর্তমানে প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের উপসচিব আবু মুসার সম্পৃক্ততা রয়েছে।

দুদকের তদন্তসূত্র আরও জানায়, বর্তমানে প্রবাসীকল্যাণ সচিব খোন্দকার শওকতের বিরুদ্ধে প্লট বরাদ্দে অনিয়মের অভিযোগে দায়েরকৃত তিন মামলার অধিকতর তদন্তে উপসচিব আবু মুসাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। ২২ এপ্রিল স্ত্রী, মা ও নিজের নামে প্লট বরাদ্দে অনিয়মের অভিযোগে রাজধানীর মতিঝিল থানায় পৃথক তিনটি মামলা (নম্বর ৮, ৯, ১০) করে দুদক। ৮ নম্বর মামলার এজাহারে বলা হয়েছে- রাজউকের উত্তরা আবাসিক প্রকল্পের ১৪ নম্বর সেক্টরে খোন্দকার শওকত হোসেনের মা জাকিয়া আমজাদ প্রথমে এক ব্যক্তির লিজপ্রাপ্ত ৩ কাঠার প্লট কেনেন।

ওই প্লট বিমান উড্ডয়ন জোনের অন্তর্ভুক্ত উল্লেখ করে অন্যত্র ৫ কাঠার প্লট বরাদ্দ দিতে জাকিয়া আমজাদ রাজউকে আবেদন করেন। পরে তাকে ১৩ নম্বর সেক্টরে ৫ কাঠার একটি প্লট বুঝিয়ে দেওয়া হয়। যদিও রাজউকের বিধি অনুযায়ী, প্লট পরিবর্তন করে অন্যের স্থলে বরাদ্দ করার এবং প্লটের আয়তন বাড়ানোর কোনো নিয়ম নেই।৯ নম্বর মামলার এজাহারে বলা হয়েছে- খোন্দকার শওকত হোসেন ২০০১ সালে সম্প্রসারিত উত্তরা প্রকল্পে নিজের নামে ৩ কাঠার প্লট বরাদ্দ নেন। সেই প্লটকে অনিয়মের মাধ্যমে ৩ কাঠা থেকে ৫ কাঠায় রূপান্তরিত করেন। এখান থেকে ২ কাঠা জমি বিক্রি করে দেন।

পরে তিনি ওই জমি ডেভেলপমেন্টের জন্য একটি নির্মাতা প্রতিষ্ঠানকে দায়িত্ব দেওয়ার সময় পুরো ৫ কাঠার আমমোক্তারনামা (পাওয়ার অব অ্যাটর্নি) দেন। ১০ নম্বর মামলার এজাহারে বলা হয়- পূর্বাচল প্রকল্পে ২০০৪ সালে তিনি স্ত্রী, ঢাকা কলেজের অধ্যক্ষ আয়েশা খানমের নামে সাড়ে ৭ কাঠার প্লট বরাদ্দ নিয়ে প্রথমে ১০ কাঠা এবং পরে তা সাড়ে ১২ কাঠায় উন্নীত করেন।

খোন্দকার শওকত হোসেন ক্ষমতার অপব্যবহার করে এসব অনিয়ম করেছেন বলে মামলাগুলোর অভিযোগে বলা হয়েছে। ওই সময় উপসচিব আবু মুসা রাজউকে উপ-পরিচালক পদে কর্মরত ছিলেন। কয়েক দিন আগে তার বিরুদ্ধে সম্পৃক্ততার অভিযোগ ওঠায় তলব করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

মামলার তদন্তে আরও দেখা গেছে, রাজউক বিধি দ্য টাউন ইমপ্রুভমেন্ট অ্যাক্ট, ১৯৫৩ ও দ্য ঢাকা ইমপ্রুভমেন্ট ট্রাস্ট (অ্যালটমেন্ট অব ল্যান্ড) রুলস, ১৯৬৯ অনুযায়ী যেসব কারণে একজনের নামে বরাদ্দকৃত প্লট চূড়ান্তভাবে বাতিল হতে পারে তার কোনোটিই ছিল না আইনুল হকের নামে দায়েরকৃত কথিত অভিযোগে। বিধি ও আইনের ব্যত্যয় ঘটিয়ে খোন্দকার শওকত রাজউকের ওপর একচ্ছত্র প্রভাব খাটিয়ে আইনুলের বরাদ্দ বাতিল করান। এ বরাদ্দ বাতিলে শওকত হোসেন কতটা প্রভাব বিস্তার করেছেন তদন্তে তার প্রমাণ মিলেছে।

ক্ষমতার অপব্যবহার করে রাজউক থেকে নামে-বেনামে একাধিক প্লট গ্রহণ করায় দুদক ২২ এপ্রিল তিনটি মামলা করে সচিব শওকতের বিরুদ্ধে। মামলাটি তদন্ত করছেন উপ-পরিচালক যতনকুমার রায়। মামলা দায়েরের আগে চলতি বছর জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত দীর্ঘ অনুসন্ধান হয়। অনুসন্ধানে ড. খোন্দকার শওকত হোসেন গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সচিব থাকাকালে পদ-পদবি ব্যবহার করে ক্ষমতার অপব্যবহার, অধীনস্থ প্রতিষ্ঠান রাজউকের ওপর প্রভাব বিস্তার, রাজধানীতে একাধিক প্লট-ফ্ল্যাট থাকা সত্ত্বেও সেই তথ্য গোপন করে উত্তরা আবাসিক প্রকল্প, উত্তরা সম্প্রসারিত আবাসিক প্রকল্প এবং পূর্বাচল প্রকল্পে একাধিক প্লট নেন।

কখনো নিজের নামে, কখনো স্ত্রী এবং মায়ের নামে এসব প্লট গ্রহণ করেন। পরে অবৈধ প্রভাব খাটিয়ে প্রতিটি প্লটের আয়তন বৃদ্ধি করেন। প্লটের বর্ধিত অংশ পরে বিক্রি করে দেন। এ ঘটনা অনুসন্ধানের পর ১৭ মার্চ প্রতিবেদন জমা দেন দুদক কর্মকর্তা। তাতে বর্তমান প্রবাসীকল্যাণ সচিব ড. খোন্দকার শওকত হোসেন, তার মা জাকিয়া আমজাদ, স্ত্রী আয়েশা খানম, প্লট বরাদ্দ ও আয়তন বৃদ্ধিতে সহায়তাকারী রাজউকের সাবেক চেয়ারম্যান এবং সংশ্লিষ্ট ২৩ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলা রুজুর সুপারিশ চাওয়া হয়।

পরে কমিশন শুধু ড. খোন্দকার শওকত হোসেনকে আসামি করে মামলা দায়েরের অনুমতি দেয়।মামলার তদন্তে বেরিয়ে আসে- উত্তরার ১৩ নম্বর সেক্টরে ড. শওকত হোসেন নিকটাত্মীয় আবু হামিদ মাহমুদের নামে ৩ কাঠার একটি প্লট বরাদ্দ নেন। হামিদ মাহমুদের নাম ব্যবহার করা হলেও মূলত শওকতই প্লটের অর্থ পরিশোধ করেন। পরে প্লটটি তার মা জাকিয়া আমজাদের নামে সাফকবলা দলিল করে নেন। ওই দলিলমূলেই বৈধ মালিকানা দাবি করে মাকে দিয়ে প্লটের আয়তন বৃদ্ধির আবেদন করান।

নথিতে দেখা যায়- আবু হামিদ মাহমুদের কাছ থেকে শওকত তার মায়ের নামে ক্রয় দেখান ১৯৯৩ সালে। ক্রয়কৃত প্লট ৫ কাঠায় উন্নীত করতে জাকিয়া আমজাদ আবেদন করেন ২০১১ সালের ১০ মে। অথচ তার আগেই ০৩.০৫.২০১১ তারিখে উপ-পরিচালক (এস্টেট-২) মোহাম্মদ মুসা ৫ কাঠার প্লট বরাদ্দ দেওয়ার কর্মপত্র তৈরির নির্দেশ দেন। ৩ কাঠার পরিবর্তে ৫ কাঠার আবেদনের পর ড. শওকতকে বিভিন্ন লোকেশনে আরও দুটি ৫ কাঠার প্লট দেখানো হয়। প্রথম দেখানো হয় উত্তরা ১৩ নম্বর সেক্টরের ৮ নম্বর রোডের ৪৬ নম্বর প্লটটি।

এটি তার পছন্দ না হওয়ায় বরাদ্দ নিতে নাকচ করে দেন। এরপর দেখানো হয় উত্তরা ১০ নম্বর সেক্টরের ১২ নম্বর রোডের ১১২ নম্বর প্লট। পছন্দ না হওয়ায় নাকচ করে দেন এটিও। এ পর্যায়ে তার লোলুপ দৃষ্টি পড়ে ১৩ নম্বর সেক্টরের ৮৬ নম্বর প্লটটির ওপর। কিন্তু শওকত যে প্লটটি পছন্দ করেন তা লয়েডস রেজিস্ট্রার অব শিপিং নামক বেসরকারি জাহাজ প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা মো. আইনুল হকের। জাহাজে চাকরি করেন বিধায় বছরের অধিকাংশ সময়ই তিনি থাকেন দেশের বাইরে।

আইনুল হক প্লটের সমুদয় কিস্তির টাকা পরিশোধ করে প্লটটির দখল নিলেও সেখানে কোনো অবকাঠামো নির্মাণ করেননি। খালি পড়ে থাকা এ প্লটটি ড. শওকত নিজের কব্জায় নিতে আশ্রয় নেন প্রতারণার। আইনুল হকের বরাদ্দ বাতিল করতে রাজউকে তার বিরুদ্ধে দায়ের করান বেনামি অভিযোগ। উত্তরা ১৩ নম্বর সেক্টরের সচেতন এলাকাবাসীর পক্ষে জনৈক মো. আবদুল করিম নাম দিয়ে অভিযোগ দায়ের করান। অভিযোগে জালিয়াত চক্রের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানানো হয়। এতে বরাদ্দপ্রাপ্ত আইনুল হকের বিরুদ্ধে সরাসরি কোনো অভিযোগ করা হয়নি। বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম