শনিবার , ২১শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ , ৬ই আশ্বিন, ১৪৩১ , ১৭ই রবিউল আউয়াল, ১৪৪৬

হোম > Uncategorized > কৃষি ব্যাংকে যত তুঘলকি কাণ্ড

কৃষি ব্যাংকে যত তুঘলকি কাণ্ড

শেয়ার করুন

বাংলাভূমি২৪ ডেস্ক ॥
ঢাকা: ১ লাখ কোটি টাকারও বেশি অর্থের হিসাব মেলাতে পারছে না একটি সরকারি বিশেষায়িত ব্যাংক! এই ভয়াবহ গরমিল ধরা পড়েছে ব্যাংকটির আন্তঃশাখা লেনদেনের ক্ষেত্রে। বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছে, ‘এত বিপুল অঙ্কের টাকা অসমন্বিত থাকা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ ও বিপজ্জনক’। ‘দারিদ্র্য বিমোচনে দেশের সর্ববৃহৎ রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান’ হিসেবে পরিচিত বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের (বিকেবি) আন্তঃশাখা লেনদেন পরিদর্শনকালে হিসাবের এ গণ্ডগোল দেখতে পায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী চলতি বছরের জুনভিত্তিক ব্যাংকটির আন্তঃশাখা লেনদেনে মোট ১ লাখ ১৬ হাজার কোটি টাকার অসমন্বিত হিসাব পাওয়া গেছে। এর মধ্যে অসমন্বিত ডেবিট এন্ট্রি-সংশ্লিষ্ট টাকার পরিমাণ ৫৮ হাজার ৪৬৬ কোটি ২৬ লাখ এবং অসমন্বিত ক্রেডিট এন্ট্রি-সংশ্লিষ্ট টাকা ৫৮ হাজার ৪৭৮ কোটি ৩৫ লাখ।বিপুল পরিমাণ এই টাকা অসমন্বিত থাকার অর্থ হচ্ছে, টাকাগুলো এখন কৃষি ব্যাংকের কোনো শাখাতেই নেই।

যে শাখায় টাকা জমা হয়েছে সে বলছে টাকা পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। আবার যে শাখার নামে পাঠানো হয়েছে সে বলছে টাকা আসেনি। অর্থাৎ লেনদেন প্রক্রিয়ার মধ্যে ‘রাস্তায় ঘুরছে’ টাকা।একটি ব্যাংকের ১ লাখ কোটির বেশি পরিমাণ টাকা রাস্তায় রাস্তায় ঘুরলেও ওই ব্যাংকটির বিরুদ্ধে কঠোর কোনো ব্যবস্থা নিতে পারছে না কেন্দ্রীয় ব্যাংক। কারণ, নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি পর্যালোচনা করে দেখেছে, নীতি অনুযায়ী অসমন্বিত হিসাবের বিপরীতে শতভাগ প্রভিশন রাখতে হবে ব্যাংকটিকে। অর্থাৎ ১ লাখ ১৬ হাজার কোটি টাকার বিপরীতে সমপরিমাণ অর্থ জমা রাখতে হবে। এটি করতে গেলে মূলধন ঘাটতি এমন অবস্থায় পৌঁছাবে যাতে ব্যাংকটির অস্তিত্ব নিয়েই সংকট দেখা দেবে। এ কারণে ২০১৫ সালের জুন পর্যন্ত ‘বিশেষ সময়’ দিয়ে ওই টাকা সমন্বয়ের সুযোগ দেওয়া হয়েছে ব্যাংকটিকে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক অবশ্য বলে দিয়েছে, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সমন্বয় না করতে পারলে তখন ‘শতভাগ প্রভিশন’ রাখতে হবে।
গত সপ্তাহে এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট ব্যাংককে নোটিস পাঠায় নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি।এ ব্যাপারে কৃষি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের কাছে পাঠানো এক চিঠিতে (প্রতিবেদন-সংবলিত) কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ব্যাংক পরিদর্শন বিভাগের উপ-মহাব্যবস্থাপক মো. মাহবুবউল হক উল্লেখ করেন, ‘ব্লক হওয়া অ্যাকাউন্টগুলোর অসমন্বিত এন্ট্রির সঙ্গে বিজড়িত অর্থের বিপরীতে সমপরিমাণ (১০০%) প্রভিশন সংরক্ষণ করা আবশ্যক। কিন্তু এ মুহূর্তে বিকেবির বিদ্যমান মূলধন ঘাটতি অধিকতর বৃদ্ধি পেলে তাদের সার্বিক কর্মকাণ্ডে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে এবং আরও খারাপ আর্থিক চিত্র প্রতিফলিত হবে।’জানা গেছে, এর আগেও ব্লক হওয়া অ্যাকাউন্টের অসমন্বিত টাকা সমন্বয়ে দুই মাস সময় দেওয়া হলেও তাতে সফল হয়নি ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। চলতি বছরের ৩ এপ্রিল অনুষ্ঠিত বিকেবি পরিচালনা পর্ষদের ৬১০তম সভায় ব্লক হওয়া অ্যাকাউন্টগুলোর অসমন্বিত লেনদেনের টাকা ৩০ জুনের মধ্যে সমন্বয় করার নির্দেশ দেওয়া হয়। কিন্তু নির্ধারিত সময়ে তা করতে পারেনি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। পরে এই সময় আগামী জুন পর্যন্ত বর্ধিত করা হয়। অসমন্বিত হিসাবের বিষয়টি ব্যাখ্যা করে ব্যাংক কর্মকর্তারা জানান, ধরা যাক কোনো একজন গ্রাহক একটি ব্যাংকের কারওয়ান বাজার শাখা থেকে নির্দিষ্ট অঙ্কের টাকা পাঠালেন একই ব্যাংকের ময়মনসিংহ শাখায়। এখন কারওয়ান বাজার শাখা ওই টাকা দিল আর ময়মনসিংহ শাখা টাকা পেল।
ব্যাংকের এই আন্তঃশাখা লেনদেন সমন্বয়ের জন্য প্রধান কার্যালয়ে একটি সমন্বিত হিসাব থাকে, যেখানে যে শাখা টাকা দেয় সে নোটিস পাঠায় আবার যে শাখা টাকা পায় সে একটি প্রতিবেদন পাঠায়। এখন ব্যাংকটির যে শাখায় গ্রাহক টাকা জমা দিলেন, সেই শাখা যতদিন টাকা না পাঠাবে ততদিন ওই টাকা প্রাপ্য শাখার হিসাবে সমন্বয় হবে না। এ টাকা তখন ঝুলে থাকবে। অর্থাৎ রাস্তায় (পাঠানোর প্রক্রিয়ার মধ্যে) থাকবে। এ ধরনের অর্থকে পরে অসমন্বিত হিসাবে দেখানো হয়। এর মানে হচ্ছে, গ্রাহকের টাকা ঠিকঠাকভাবে যাচ্ছে না কাক্সিক্ষত শাখায়। কোনো একটি জায়গায় আটকে রয়েছে।গ্রাহকদের লেনদেনের টাকা কেন সঠিকভাবে কাক্সিক্ষত শাখায় পাঠানো হচ্ছে না, এ বিষয়েও ব্যাংক কর্মকর্তাদের কাছে জানতে চাইলে একাধিক সরকারি ব্যাংকের কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, একটি শাখায় ১ কোটি টাকা অসমন্বিত থাকলে ওই টাকা যদি এক মাসও আটকে রাখা যায় তাহলে এটি অন্য কোনো খাতে বিনিয়োগ করলেও অন্তত কয়েক লাখ টাকা মুনাফা পাওয়া যাবে। যেহেতু কৃষি ব্যাংকের বেশির ভাগ শাখা গ্রামে-গঞ্জে আর ওইসব এলাকায় এমন কিছু ব্যবসা থাকে যাদের স্বল্পসময়ের জন্য টাকা দরকার হয়।
এমনও হতে পারে ওইসব ব্যবসায় এ টাকা খাটানো হচ্ছে। ব্যাংকটির ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্যানুযায়ী সারা দেশে (রাজশাহী ছাড়া) ৯৫২টি শাখা রয়েছে। সে হিসেবে যে পরিমাণ টাকা অসমন্বিত রয়ে গেছে তা সব শাখায় ভাগ করে দিলে প্রতি শাখায় অসমন্বিত টাকার পরিমাণ দাঁড়ায় ১২১ কোটির কিছু বেশি। একটি শাখা এ পরিমাণ টাকা এক মাস খাটালেও কোটি টাকা মুনাফা তুলতে পারে, যা ব্যাংকের কোনো হিসাবে যোগ হবে না, হবে কর্মকর্তাদের পকেট ভারী। বিশিষ্ট ব্যাংকার ডি আর মোহন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, কোনো ব্যাংকের টাকা দীর্ঘ সময় অসমন্বিত থাকার বিষয়টি খুবই খারাপ। এমনকি এতে টাকা মার যাওয়ারও আশঙ্কা থাকে। তিনি আরও বলেন, দেশের বেশির ভাগ ব্যাংক এখন ডিজিটাল পদ্ধতিতে লেনদেন পরিচালনা করছে। ইন্টারনেটের মাধ্যমে এক শাখা থেকে আরেক শাখায় মুহূর্তেই লেনদেন সমন্বয় করা যায়। এ যুগে একটি ব্যাংকে ১ লাখ কোটি টাকার বেশি অসমন্বিত থাকার পেছনে কোনো বড় ধরনের উদ্দেশ্য রয়েছে। এমনও হতে পারে বিপুল পরিমাণ এই টাকা সমন্বয় না করে কোনো না কোনো কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে, যার মাধ্যমে কিছু কর্মকর্তা কোটি কোটি টাকার মালিক হলেও ব্যাংকটি পড়ে গেছে ভয়াবহ ঝুঁকিতে।
হিসাবে লাখ কোটি টাকার এই গরমিলের বিষয়ে জানতে চাইলে বিকেবির এমডি কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি। প্রথমে তিনি জানান, এ ধরনের কোনো অনিয়মের বিষয়ে তিনি জ্ঞাত নন। পরক্ষণেই আবার বলেন, ‘এর পরও যদি এমন কিছু হয়ে থাকে আমরা দেখব’। এ বিষয়ে আবারও প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘আর আমরা বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে কাজ তো করছি’। (বিডি-প্রতিদিন)