সোমবার , ১১ই নভেম্বর, ২০২৪ , ২৬শে কার্তিক, ১৪৩১ , ৮ই জমাদিউল আউয়াল, ১৪৪৬

হোম > Uncategorized > কী হবে, কতদূর গড়াবে শিক্ষকদের আন্দোলন?

কী হবে, কতদূর গড়াবে শিক্ষকদের আন্দোলন?

শেয়ার করুন

বাংলাভূমি২৪ ডেস্ক ॥

ঢাকা: প্রস্তাবিত অষ্টম জাতীয় বেতন কাঠামো সরকারি চাকুরে মহলে আনন্দের দিশা এনে দিলেও ব্যতিক্রম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা। বেতন কাঠামো পুনর্র্নিধারণ ও স্বতন্ত্র বেতন কাঠামোর দাবিতে প্রায় সাড়ে তিনমাস ধরে আন্দোলন করে আসছেন সারাদেশের ৩৭টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা। তবে সরকারের তরফ থেকে এখনো পর্যন্ত তাদের জন্য আশাব্যঞ্জক কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। ফলে আন্দোলন আরো বড় পরিসরে নেয়ার চিন্তা-ভাবনা চলছে শিক্ষক নেতাদের মধ্যে। আর শিক্ষার্থীদের মধ্যে শঙ্কা বাড়ছে সেশনজটের কবলে পড়ার।

বিগত কয়েকমাসের টানা আন্দোলনে সরকারের উচ্চমহলে যুক্তি উপস্থাপনসহ নিয়মিতই কর্মসূচি পালন করছেন শিক্ষকরা। সর্বশেষ গত চার রোববার বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের আহ্বানে তিন ঘণ্টার কর্মবিরতি পালন করেছেন তারা। আসছে মঙ্গলবার পূর্ণদিবস কর্মবিরতিরও ঘোষণা রয়েছে।

মন্ত্রিসভায় নতুন বেতন কাঠামো অনুমোদন হলে তাৎক্ষণিক জাতীয় সম্মেলনের ডাক দেয়া হবে বলেও হুঁশিয়ারি দিয়েছেন শিক্ষক নেতারা। শুধু তাই নয়, প্রয়োজনে উচ্চ আদালতে রিট করারও ঘোষণা দিয়েছেন তারা।

শিক্ষকদের আন্দোলনে সরকার এ পর্যন্ত কোনো সাড়া দেয়নি বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের সভাপতি অধ্যাপক ড. ফরিদউদ্দিন আহমেদ। এজন্যে তিনি সরকারের উচ্চপর্যায়ের আমলাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন। তিনি বলেন, সরকারের কিছু আমলা ষড়যন্ত্র করে প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে আমাদের বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টা করছেন।

আন্দোলন শুরুর পর থেকেই বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের নেতারা অর্থমন্ত্রী, শিক্ষামন্ত্রী, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যান, প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা গওহর রিজভীসহ সরকারের উচ্চ মহলের ব্যক্তিদের সঙ্গে কয়েক দফা বৈঠকে বসেছেন এবং বিষয়টির সমাধানে বিভিন্ন যুক্তি তুলে ধরেছেন। কিন্তু সেখান থেকে তেমন আশা না পেয়ে এখন প্রধানমন্ত্রীর দিকে তাকিয়ে আছেন এই শিক্ষক নেতারা।

অর্থমন্ত্রীর বিরুদ্ধে অভিযোগ করে ড. ফরিদউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘আমাদের অর্থমন্ত্রী সকালে এক কথা বলেন, বিকেলে এক কথা বলেন। তার কথায় আমাদের আস্থা নেই। তিনি আমাদের আশ্বাস দিয়েছিলেন, কিন্তু পরে আবার কানপড়া পেয়ে তিনি সব ভুলে গেছেন। তবে আমরা আগেও বলেছি, আমরা এ বিষয়টি নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ চাই।’

তিনি আরো বলেন, ‘অর্থমন্ত্রী শিক্ষকদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন, কারণ তিনি তো আমলাদের লোক। তিনি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের উপরও ১০ শতাংশ ভ্যাট নির্ধারণ করেছেন যেটা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক। উনি শিক্ষকদের সম্মান দিচ্ছেন না।’

শিক্ষক নেতারা বলছেন, প্রস্তাবিত বেতন কাঠামোতে শিক্ষকদের সচিব, পদায়িত সচিবের নিচে মূল্যয়ন করার পেছনে রয়েছে সরকারের ভিতর থাকা বড় বড় কিছু আমলা। তারা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়কে চাঙ্গা করতে এমন অনৈতিক প্রস্তাব করেছে বলেও দাবি তাদের।

তাদের অভিযোগ, ফরাসউদ্দিন নিজেই একটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের মালিক। গতবছর যেটি প্রায় ৪০ কোটি টাকা আয় করেছে। সেজন্যেই তার নেতৃত্বাধীন কমিশন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে।

শিক্ষকরা বলেন, প্রস্তাবিত অষ্টম জাতীয় বেতন কাঠামোর মাধ্যমে শিক্ষকদের পদমর্যাদা একধাপ কমিয়ে আনা হয়েছে। তাই শুধু বেতনভাতা নয়, তারা আন্দোলন করছেন পদমর্যাদা নিয়ে। শিক্ষকদের মতে, পদমর্যাদা কমিয়ে আনা হলে শিক্ষকতার মতো মহান পেশায় আগ্রহ হারাবে নতুন প্রজন্ম। এতে জাতি মেরুদণ্ডহীন হয়ে পড়বে বলে আশঙ্কা তাদের।

জানা গেছে, অষ্টম জাতীয় বেতন কাঠামোতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মূলবেতন সপ্তম বেতন স্কেল থেকে এক ধাপ নিচে নামিয়ে প্রস্তাব করা হয়েছে। এছাড়া সিলেকশন গ্রেডপ্রাপ্ত (গ্রেড-১) জ্যেষ্ঠ অধ্যাপকদের (ন্যূনতম ২০ বছরের চাকরির অভিজ্ঞতা সম্পন্ন) বেতন কাঠামো পদায়িত সচিবদের এক ধাপ নিচে মূল্যায়ন করা হয়েছে। বর্তমানে গ্রেড-১ অনুযায়ী সরকারের সচিব, সেনাবাহিনীর মেজর জেনারেল এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের সিলেকশন গ্রেডপ্রাপ্ত অধ্যাপকদের বেতন স্কেল একই। কিন্তু অষ্টম জাতীয় বেতন কাঠামোতে ড. ফরাসউদ্দিন নেতৃত্বাধীন কমিশন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের গ্রেড-১ থেকে বাদ দেয়ার সুপারিশ করে।

বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে দেশের ৩৭টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে জ্যেষ্ঠ অধ্যাপক, অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপক, সহকারী অধ্যাপক, প্রভাষক মিলে সর্বমোট ১৪ হাজার ৬৮৫ জন শিক্ষক কর্মরত রয়েছেন; যার মধ্যে জ্যেষ্ঠ অধ্যাপক প্রায় ৪৫০ জন, অধ্যাপক ৫ হাজারের একটু বেশি। আর বাকীরা সহযোগী অধ্যাপক, সহকারী অধ্যাপক ও প্রভাষক।

এদের মধ্যে জ্যেষ্ঠ অধ্যাপকরা সরকারের সিলেকশন গ্রেড-১ অনুযায়ী প্রশাসনের সর্বোচ্চ বেতনধারীদের (সচিব) বেতন ভোগ করতেন। কিন্তু দুই বছর আগে নতুনভাবে সিনিয়র সচিব পদ চালু করা হলে এক ধাপ পিছিয়ে পড়েন শিক্ষকরা। আর প্রস্তাবিত অষ্টম জাতীয় বেতন কাঠামো নিয়ে সচিব কমিটির করা সুপারিশে পদায়িত সচিব ও মুখ্য সচিব নামে পৃথক দুটি স্কেল চালুর প্রস্তাব করে ফরাসউদ্দিন কমিশন। এতে করে আরো দুই ধাপ পিছিয়ে পড়বেন শিক্ষকরা। অন্যদিকে জ্যেষ্ঠ অধ্যাপকরা বেতন কাঠামোতে পিছিয়ে পড়লে ধারাবাহিকভাবে অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপক, সহকারী অধ্যাপক ও প্রভাষকরাও একইভাবে দুই ধাপ পিছিয়ে পড়বেন।

শিক্ষক নেতাদের দাবি, শুধু বেতন ভাতাদির বিষয়ে নয়, রাষ্ট্রীয় ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্সে শিক্ষকদের ‘মর্যাদাহানি’ করা হয়েছে। ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্সে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সিলেকশন গ্রেডপ্রাপ্ত অধ্যাপকদের অবস্থান ১৯তম, কিন্তু সমবেতনের সচিবদের অবস্থান ১৬তম। এমনকি উপাচার্যদের ১৭তম অবস্থানে রাখা হয়েছে। আমরা ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্সে পুনর্মূল্যায়ন করে বেতন কাঠামো অনুযায়ী শিক্ষকদের অবস্থান নিশ্চিত করার দাবি জানাই। অন্যথায় ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের অবস্থান বাদ দেয়ারও দাবি জানান তারা।

দাবি মেনে নেয়া না হলে কঠোর কর্মসূচীর হুঁশিয়ারি দিয়ে বাংলাদেশ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের মহাসচিব অধ্যাপক ড. এ এস এম মাকসুদ কামাল বলেন, শিক্ষকদের মর্যাদা ফিরিয়ে আনার জন্যে আমরা আরো কঠোর আন্দোলনের ডাক দেব। তার আগে আমরা প্রধানমন্ত্রী দিকে চেয়ে আছি। আশা করছি তিনি এ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করবেন। যদি তারা কিছু না করেন তাহলে আমরা শ্রীলঙ্কার শিক্ষকদের মতো টানা আন্দোলনে যাবো।

২০১২ সালের ৭ জুন থেকে প্রায় ১০০ দিন কর্মবিরতিসহ অন্যান্য কর্মসূচি চালিয়ে শ্রীলঙ্কার বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ফেডারেশন তৎকালীন সরকারকে তাদের দাবি পূরণে বাধ্য করেছিল। সেদিকে ইঙ্গিত করে অধ্যাপক মাকসুদ কামাল বলেন, আমাদের দাবি আদায়ে আমরা প্রয়োজনে তাদের থেকে বেশিদিন ধরে আন্দোলন চালিয়ে যাবো।

শিক্ষকনেতাদের এমন হুমকির বিপরীতে ভোগান্তিতে পড়ার আশঙ্কা করছেন শিক্ষার্থীরা। সপ্তাহে একদিন শিক্ষকদের তিন ঘণ্টার ক্লাস বর্জনেই ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। এরপর যদি আন্দোলন দীর্ঘায়িত হয় তবে অসম্পূর্ণ সিলেবাসে পরীক্ষায় অংশ নিতে হবে নতুবা পরীক্ষা পিছিয়ে সেশন জটে পড়তে হবে বলে আশঙ্কা করছেন তারা।

শিক্ষার্থীরা বলছেন, শিক্ষকদের ‘ন্যায্য’ দাবি মেনে নিয়ে প্রস্তাবিত অষ্টম জাতীয় বেতন কাঠামো পুনর্র্নিধারণ করে অনুমোদন করা হোক। তাহলে শিক্ষকদের আন্দোলনেও যেতে হবে না। আর শিক্ষার পরিবেশ বিঘ্নিত হওয়ারও কোনো সম্ভবনা নেই। আমাদেরও সেশন জটে পড়তে হবে না। আমরা চাই শিক্ষকদের দাবি যৌক্তিক হলে তা মেনে নেয়া উচিৎ।

এ বিষয়ে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী আরিফুল ইসলাম বাংলামেইলকে বলেন, ‘আমরা চাই বিষয়টির একটি সুরাহা হোক। সরকারও তাদের অবস্থান পরিষ্কার করে একটা বিহিত করুক। অন্যথায় আমরাই ভোগান্তিতে পড়বো।’

প্রসঙ্গত, ১৯৮৬ সালে সামরিক সরকার ক্ষমতায় থাকাকালীন সময়ে স্বতন্ত্র বেতন স্কেল ও মর্যাদার দাবিতে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশন প্রায় ৪২ দিন ধর্মঘট পালন করেছিল। বাংলামেইল২৪ডটকম