গোলাম মওলা রনি ॥ বাংলাদেশের রাজনীতি এখন কোথায়! কেউ বলেন মক্কা শরিফে। আবার কেউ বলেন লন্ডনের প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন ১০ নং ডাউনিং স্ট্রিটে। দেশের প্রধানতম রাজনৈতিক দলের সভানেত্রী এখন মক্কায়। সেখানে তার জ্যেষ্ঠপুত্র তারেক রহমানসহ আরও অনেকে থাকবেন। তার এই রোড টু মক্কা নিয়ে রাজনৈতিক মহলে জল্পনা-কল্পনার শেষ নেই। আওয়ামী লীগের মুখপাত্ররা বলছেন, উনি মক্কা গেছেন চক্রান্ত করার জন্য। অন্যদিকে বিএনপি বলছে, কীসের চক্রান্ত! উনি গেছেন আল্লাহর দরবারে দোয়া খায়ের করার জন্য। এবারকার মক্কা সফরটি দুটি কারণে ভিন্নতা পেয়েছেথ এক. উনি সাধারণ যেসব লোকজনকে সঙ্গে নিয়ে ওদেশে যান, তারা এবার বাদ পড়েছেন। বিশেষ করে জনাব ফালু এবং জনাব শিমুল বিশ্বাস। দুই. যাওয়ার আগে তিনি বহুদিনের পুরনো এবং বিতর্কিত ঢাকা মহানগরী কমিটি বাতিল করে দিয়ে নতুন কমিটি করে গেছেন। আর কমিটি গঠনের আগে ও পরে হুমকি দিয়ে বলেছেন, ঈদের পর দুর্বার গণ-আন্দোলন গড়ে তোলা হবে। বিএনপির সাম্প্র্রতিক কাজকর্ম দেখে আওয়ামী লীগের লোকেরা নানাভাবে ঠাট্টা-মশকরা শুরু করেছেন। অনেকে আকার-ইঙ্গিতে বলার চেষ্টা করছেন, ওভাবে হবে না! ইস্যু লাগবে। ইস্যু ছাড়া আন্দোলন হয় না। নিজেদের বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক অভিজ্ঞতার দোহাই দিয়ে তারা মাথা ঝুলিয়ে ঝুলিয়ে বিএনপির প্রতি সকাল-বিকাল অমৃতবাণী বর্ষণ করে যাচ্ছেন।
তবে সরকারি মহলের গলা কেন জানি অজানা কারণে দিন দিন দুর্বল থেকে দুর্বলতর হয়ে যাচ্ছে। তাদের মুখে আর আগের মতো খই ফোটে না। প্রধানমন্ত্রী নিজেও আগের মতো চটুল কথাবার্তা বলছেন না। এরই মধ্যে স্পিকার লন্ডনে গেলেন কি যেন একটি ডিগ্রি আনার জন্য। সুযোগ বুঝে সেখানকার এক হুইপের সঙ্গে সাক্ষাৎও নাকি করেছেন। আর শেষ-মেশ গেলেন প্রধানমন্ত্রী। এটা কোনো সরকারি সফর নয়। ইউনিসেফের একটি ঘরোয়া অনুষ্ঠান মাত্র।
তবে তিনি এই সফরের কোনো এক ফাঁকে প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরনের সঙ্গে দেখা করবেন। আওয়ামী লীগের নেতারা অধীর আগ্রহে বসে আছেন হাসিনা-ক্যামেরনের বৈঠকের ভিডিও ফুটেজের জন্য। তারপরই শুরু করবেন প্রধানমন্ত্রীর বিলেত জয়ের ইতিকথা নিয়ে নানা কল্পকাহিনী। বাংলাদেশের মানুষ রাজনৈতিক দলগুলোর বন্ধ্যত্ব এবং দিকনির্দেশনাহীন বক্তব্য এবং আচার-আচরণে দিশাহারা হয়ে পড়ছে। এ এক অদ্ভূত দিশাহারা। তারা কেউ নড়াচড়া করছে না। মনের দুঃখে আকাশের দিকে তাকায় আর আবোল-তাবোল চিন্তা করে। তাদের বাস্তব ভেদ বুদ্ধি দিয়ে বর্তমান অচল অবস্থা থেকে রেহাই পাওয়ার কোনো পথের সন্ধান তারা করতে পারে না ঠিকই কিন্তু অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে বিশ্বাস করে এভাবে চলতে পারে না কিছু একটা হবে মারাত্দক কিছু!
আপনি যদি জিজ্ঞাসা করেন কেমন মারাত্দক? তারা বলবে আমরা জানি না। আল্লাহ জানে! আর জানেন বেগম জিয়া। তিনি মক্কা গেছেন ঈদের পরবর্তী আন্দোলন-সংগ্রামে রহমত ও বরকত লাভের জন্য। একথা শুনে আওয়ামী লীগের লোকেরা ক্ষেপে যায়। তারা বলে, দোয়া দরুদ পড়ে আন্দোলন-সংগ্রাম হয় না। উনি মক্কা গেছেন অন্য কারণে, মনে হয় বাদশাহের লগে কিছু তদ্বির আছে।
দেশের চলমান রাজনীতি নিয়ে প্রধান দুটি দল যে যাই বলুক না কেন, আমি কিন্তু নির্ঘাত কতগুলো অশনি সংকেত দেখতে পাচ্ছি। এসব অশনি সংকেত উল্কাপিণ্ডের মতো যে কোনো সময় বাংলাদেশের ভাগ্যাকাশে আঘাত হানতে পারে। আর তাতেই তছনছ হয়ে যেতে পারে অনেক কিছু। আওয়ামী লীগ জেনে হোক কিংবা না জেনে হোক, তারা দলের ভিতর ও বাইরে তাদের সব প্রতিদ্বন্দ্ব্বীকে শেষ করে দিয়েছে। দলটির বিরুদ্ধে টুঁ শব্দটি করার মানুষ আর এই বঙ্গে নেই। এখন যারা আছে তারা চোখে সারা দিন দুধ-মধু আর সরাবান তহুরার চশমা পরে থাকে। তারা যেদিকে তাকায় সেদিকেই দুধ আর মধুর নহর বইছে। তারা সারা দিন সেই দুধ মধু খায় আর ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়ে ডাক্তারের কাছে দৌড়ায়। অনেকের পেটে গ্যাসের সমস্যা স্মরণকালের সব রেকর্ড ব্রেক করেছে। তারা পেটভর্তি গ্যাস নিয়ে এদিক-সেদিক দৌড়ায়থ না পারে বর্জন করতে কিংবা না পারে ধারণ করতে! কী হবে ঈদের পর! কিংবা কী হতে পারে ঈদের পরের রাজনীতিতে।
আপনি যদি আমার মতামত জিজ্ঞাসা করেন তবে বলবথ অনেক কিছু হতে পারে; ঘটতে পারে যে কোনো অভাবনীয় ঘটনা। কারণ রাজনীতির সাধারণ সূত্র মতে, যখন কোনো সমাজ বা রাষ্ট্রে চাপা ক্ষোভ, বিক্ষোভ কিংবা অস্থিরতা চলতে থাকে তখন সেখানে যে কোনো সময় ঘটতে পারে যে কোনো জিনিস। আপনি যদি গাদ্দাফির শেষ কয়েকটি দিন পর্যালোচনা করেন কিংবা পর্যালোচনা করেন সাদ্দাম হোসেনের শেষ দিনগুলো, তবে উত্তর খোঁজার জন্য আপনাকে কনফুসিয়াস কিংবা সক্রেটিসের কাছে যেতে হবে না। আপনি কি একবারও ভেবে দেখেছেন শেয়ার মার্কেট কেলেঙ্কারির জন্য এই দেশের অর্থনীতিতে কত বড় ক্ষতের সৃষ্টি হয়েছে। এই কেলেঙ্কারির দায় নিতে গিয়ে কতটি পরিবার শেষ হয়ে গেছে কিংবা কতজন উদ্যমী তরুণের মন ভেঙে গেছে? এই কেলেঙ্কারির হোতাদের কেন রাষ্ট্র বার বার মদদ দিয়ে সাধারণ মানুষকে অপমানিত করছে? এসব প্রশ্নের জবাব না দিয়ে আপনি কোনোমতেই এগুতে পারবেন না।
দেশের ব্যাংকিং খাতের প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা লোপাট হয়ে গেল। রাষ্ট্র কর্তৃৃক কয়েক দফায় ১০ হাজার কোটি টাকার মূলধন সরবরাহ করার পরও রাষ্ট্রীয় ব্যাংকগুলো দাঁড়াতে পারছে না। অযোগ্য, অদক্ষ, নীতিভ্রষ্ট রাজনীতির দুষ্টচক্রের ক্যান্সারে পক্ষাঘাতগ্রস্ত লোকজনকে দিয়ে কেন জনগণের আমানত নষ্ট করছেনথ এই প্রশ্নের জবাব না দিয়ে আপনি কতদিন চুপচাপ বসে থাকতে পারবেন? আজ দেশের সার্বিক প্রশাসন যন্ত্রে যে অরাজকতা দেখা দিয়েছে তা ইতিপূর্বে কোনো দিন ছিল না। নারায়ণগঞ্জের ৭ খুনের পর র্যাব-পুলিশের দ্বন্দ্ব্ব পরিষ্কার হয়ে উঠেছে। এ ঘটনার মাধ্যমে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনের সীমাহীন নোংরামি যেমন ফুটে উঠেছে, তেমনি রাষ্ট্রীয় প্রশাসন রাজনৈতিক দুরাচারের কবলে পড়ে কতটা নিচে নামতে পারে তার জঘন্যতম একটি উদাহরণ সৃষ্টি হয়েছে। আজ রাষ্ট্রযন্ত্রের একটি অঙ্গ অন্য অঙ্গের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে পুরো রাষ্ট্রব্যবস্থাকেই দুর্বল করে তুলছে। কর্মকর্তারা এখন আর নিজেদের রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি বা প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী মনে করেন না। তারা নিজেদের সরকারি সম্পত্তি বা সরকারদলীয় পাণ্ডা মনে করেন। আর নিজেদের বিরোধী দলের জন্য একেকটা আজরাইল বানানোর অবিরত চেষ্টায় তারা সারা দিন ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক মহলে ঘোরাফেরা করে রাজনৈতিক গরল পান করার জন্য।
আপনি যদি সন্ধ্যার পর ধানমন্ডির বত্রিশ নম্বর সড়ক কিংবা সুধা সদনের সামনে লেকের মধ্যে যে দ্বীপটি আছে সেখানে যান এবং চুপটি করে দাঁড়িয়ে থাকেন তবে কিছু সরকারি কর্মকর্তার চর্বি মিশ্রিত দেহ দেখার পাশাপাশি তাদের জবানবন্দি শুনতে পাবেন। আপনি যত বিকৃত রুচির মানুষ হোন না কেন, আপনি অবশ্যই মনে মনে আহত হবেন তাদের নিম্নমানের কথাবার্তা শোনার পর। অতি সম্প্রতি স্বরাষ্ট্র সচিবের পদ থেকে সি কিউ মুসতাক সাহেবের অবসর গ্রহণের পর পত্র-পত্রিকায় খবর বের হলোথ মন্ত্রণালয় এবং পুলিশ হেডকোয়ার্টারের মধ্যে মারাত্দক দ্বন্দ্ব্ব ছিল। যারা এসব বিষয়ে খোঁজখবর রাখেন তারা জানেন এই মুহূর্তে পুলিশ প্রশাসনে কী রকম ভয়াবহ অস্থিরতা চলছে।
আইজি সাহেব, প্রলয় জোয়ার্দারসহ আরও কয়েক কর্তা একদিকে, অন্যদিকে এডিশনাল আইজি শহিদুল হক তার লোকজন নিয়ে আলাদা বলয়ে রয়েছেন। ঢাকার কমিশনার বেনজীর এবং তার লোকজন নিয়ে যেমন ভিন্ন মেরুতে অবস্থান করছেন, তেমনি স্পেশাল ব্রাঞ্চের প্রধান জাভেদ পাটোয়ারিও তার নিজের অবস্থানে থেকে আলাদাভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। সবাই ঘোর সরকার সমর্থক, প্রধানমন্ত্রীর অনুরক্ত এবং একই সঙ্গে আইজি প্রার্থী। পুলিশের এই সমস্যা দূর করার জন্যই জরুরি ভিত্তিতে গরম রাজপথ দরকার। তাহলে এই শক্তিশালী বাহিনীটি সরকারের জন্য বুমেরাং হয়েই দেখা দেবে বলে সবার আশঙ্কা।
এতসব অবাঞ্ছিত এবং অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতির মধ্যে আগামী দিনগুলো ভালো যাবে না। সে ক্ষেত্রে ঈদের পর যে কোনো ওছিলায় মানুষ যদি সুযোগ পায় তবে রাজনীতির মাঠ হয়ে উঠতে পারে উত্তপ্ত। দেশীয় পরিস্থিতির সঙ্গে সঙ্গে আন্তর্জাতিক অঙ্গন এমনিতেই উত্তপ্ত হয়ে আছে। সাম্প্র্রতিককালে ইউক্রেনের ক্রিমিয়া নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র এবং রাশিয়ার সম্পর্ক তলানিতে পৌঁছেছে। তার ওপর রকেট হামলায় মালয়েশীয় যাত্রীবাহী বিমান ধ্বংস হয়ে ২৯৮ জন মানুষের মৃত্যুর পর সেই সম্পর্কে যে কোনো সময় আরও অবনতির আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। ইঙ্গ-মার্কিন মদদে এই পবিত্র রোজার মাসে ইসরায়েলি বাহিনী গাজা উপদ্বীপে যে ভয়াবহ নৃশংসতা চালাচ্ছে তাতে পুরো মুসলিম বিশ্ব ফুঁসে উঠেছে। পরিস্থিতি এতটাই ভয়াবহ যে শেষ পর্যন্ত বারাক ওবামা ইসরায়েলকে হুঁশিয়ার করতে বাধ্য হয়েছেন। ভারতে মোদি সরকারের ক্ষমতাগ্রহণ এবং বাংলাদেশের ব্যাপারে তার অদ্ভূত নীরবতা। আওয়ামী লীগকে শঙ্কিত এবং বিএনপিকে উল্লসিত করে তুলছে। সরকার নতুন বন্ধুর খোঁজে চীন-রাশিয়ার দ্বারস্থ হতে চাচ্ছে।
অন্যদিকে বিএনপিও বসে নেই। তাদের পুরনো মার্কিন লবি, পাকিস্তান-সৌদি লবি এবং চীনের লবিকে কাজে লাগিয়ে আওয়ামী লীগকে বিপদে ফেলে আটকানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। আর এরই অংশ হিসেবে বেগম জিয়া যেমন মক্কা সফরে গেলেন তেমনি প্রধানমন্ত্রীও গেলেন বিলেতে। দুজনেরই লক্ষ্য এক কিন্তু উদ্দেশ্য ভিন্ন। একজন চাচ্ছেন ঈদের পর সরকারবিরোধী আন্দোলন তীব্র থেকে তীব্রতর করে সরকারকে বিপদে ফেলতে। আর অন্যজন চাচ্ছেন পূর্বেকার মতো সফলতা। অর্থাৎ বিরোধী দলকে রাজপথে একদম দাঁড়াতে না দেওয়া। এই আশা-আকাঙ্ক্ষা আর আশঙ্কার মধ্যেই শেষ হতে চলছে রমজান। আসছে ঈদ। আর ঈদের পর বোনাস হিসেবে আসছে আন্দোলন। (বাংলাদেশ-প্রতিদিন)
লেখক : রাজনীতিবিদ।