বাংলাভূমি২৪ ডেস্ক ॥
বাজিতখিলা (শেরপুর) থেকে: একাত্তরের আলবদর কমান্ডার কামারুজ্জামানের দাফন সম্পন্ন হয়েছে। রোববার (১২ এপ্রিল) ভোররাত পাঁচটা ১০ মিনিটে তার গ্রামের বাড়ি শেরপুর সদর উপজেলার বাজিতখিলা ইউনিয়নের মুদীপাড়ায় দাফন করা হয়েছে শীর্ষ এ যুদ্ধাপরাধীকে।
বাজিতখিলায় কামারুজ্জামানের গড়া এতিমখানার পেছনে কবর দেওয়া হয় কামারুজ্জামানকে। এর আগে চারটা ৫৫ মিনিটে এতিমখানার মাঠে তার নামাজে জানাজা সম্পন্ন হয়। এতে অংশ নেন স্বজন ও গ্রামের লোকজন।
রাত চারটা ৪০ মিনিটে কামারুজ্জামানের মরদেহ তার পরিবার পরিজনের কাছে হস্তান্তর করা হয়। তার বড় ভাই কফিলউদ্দিন মরদেহ গ্রহণ করেন।
এর আগে চারটা ২০ মিনিটে বাড়িতে পৌঁছে মরদেহবাহী গাড়িবহর। সঙ্গে আসা কারা কর্মকর্তারা তার স্বজনদের কাছে মরদেহ বুঝিয়ে দিয়ে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হন।
ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার পর কামারুজ্জামানকে দাফনের জন্য নেওয়া হয় বাজিতখিলায়। কারাগারের ভেতর থেকে বের করার পর প্রশাসনের কড়া নিরাপত্তায় অ্যাম্বুলেন্সে করে সেখানে পাঠানো হয় মরদেহ।
রাত এগারটা ৪০ মিনিটে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে মরদেহবাহী অ্যাম্বুলেন্স রওনা হয় শেরপুরের উদ্দেশ্যে। হাইকোর্টের সামনে দিয়ে শাহবাগ ও মহাখালী হয়ে গাজীপুর, ময়মনসিংহ ও শেরপুর জেলার বিভিন্ন উপজেলা পার হয়ে বাজিতখিলায় পৌঁছে।
রাত দশটার পরে এ ফাঁসি কার্যকর করার মধ্য দিয়ে দেশের জন্য আরও একটি নতুন ইতিহাস রচিত হয়েছে। এরপর প্রায় বিশ মিনিট ফাঁসির মঞ্চে ঝুলিয়ে রাখা হয় কামারুজ্জামানকে। পরে মরদেহ নামিয়ে তার মৃত্যু নিশ্চিত করা হয় দু’পায়ের রগ কেটে। সবশেষে মরদেহের ময়না তদন্ত সম্পন্ন করা হয়।
কিছুক্ষণের মধ্যেই কামারুজ্জামানের মরদেহ কারাগার থেকে অ্যাম্বুলেন্সে চড়িয়ে বের করে আনা হয়। এরপর আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কড়া প্রহরায় মরদেহবাহী অ্যাম্বুলেন্স রওনা হয় শেরপুরে। পুলিশের নিরাপত্তা দানকারী গাড়ি ছাড়াও আরও একটি অ্যাম্বুলেন্স ছিল মরদেহের সঙ্গে।
র্যাব, পুলিশ, ঢাকা মহানগর পুলিশ, ঢাকা জেলা পুলিশ, ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ, ঢাকা জেলা গোয়েন্দা পুলিশসহ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর দশটি গাড়ি যায় সঙ্গে।
রুটভুক্ত জেলা থেকে সংশ্লিষ্ট জেলা পুলিশের গাড়ি প্রটেকশন দিয়ে জেলার সীমানা পার করে দেয় মরদেহটিকে।
জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মোহাম্মদ কামারুজ্জামানকে দোষী সাব্যস্ত করা হয় মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে হত্যা-গণহত্যা, ব্যাপক নিধনযজ্ঞ, দেশান্তর, নির্যাতন, ধর্ষণ, ধর্মগত ও রাজনৈতিক কারণে নির্যাতন করে হত্যা, ষড়যন্ত্রের মতো বিভিন্ন ধরনের মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে। এর মধ্যে শেরপুরের সোহাগপুরে গণহত্যা-ধর্ষণের দায়ে ফাঁসির আদেশ পান তিনি। আরও কয়েকটি অপরাধে আদালত যাবজ্জীবনসহ বিভিন্ন মেয়াদের কারাদণ্ডাদেশ দিলেও সর্বোচ্চ সাজা কার্যকর হওয়ায় সেসব সাজা ভোগের প্রয়োজন পড়েনি।
স্বাধীনতার ৪৪ বছর পর এটি হচ্ছে মানবতাবিরোধী অপরাধ মামলার দ্বিতীয় ফাঁসির রায় কার্যকর, যার মাধ্যমে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড নিশ্চিত করা হলো একাত্তরে আলবদর বাহিনীর ডেপুটি চিফ অব কমান্ড দেশের এই শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীর।
এর আগে ২০১৩ সালের ১২ ডিসেম্বর রাতে ফাঁসি কার্যকর হয়েছিল জামায়াতেরই অপর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আব্দুল কাদের মোল্লার। ‘মিরপুরের কসাই’ আলবদর কমান্ডার কাদের মোল্লাকেও ফাঁসিতে ঝোলানো হয়েছিল রাত দশটা এক মিনিটেই।
বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চল জুড়ে নারকীয় সব যুদ্ধাপরাধের হোতা কামারুজ্জামানের ফাঁসির লিভারে টান দিয়ে ঐতিহাসিক এ দায়িত্ব পালন করেন প্রধান জল্লাদ রানা। অন্য তিনজন জল্লাদ ছিলেন তার সহযোগী। জল্লাদ রানা এর আগে আরেক শীর্ষ যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকরের সময় সহকারী জল্লাদের ভূমিকা পালন করেছেন।
এর আগে দুপুরে কারাগারে পৌঁছায় মুক্তিযুদ্ধের সক্রিয় ও সশস্ত্র বিরোধিতাকারী কামারুজ্জামানের ফাঁসি কার্যকর করতে সরকারের নির্বাহী আদেশ। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সে আদেশও তাকে পড়ে শোনানো হয়। এর পর থেকেই শুরু হয় ফাঁসি কার্যকরের চূড়ান্ত প্রস্তুতি।
দুপুরেই কামারুজ্জামানের স্ত্রী-পুত্র-পরিজনকে শেষবারের মতো তার সঙ্গে দেখা করার জন্য ডেকে পাঠায় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার কর্তৃপক্ষ। বিকেল চারটার পরপরই ২১ জন স্বজন কেন্দ্রীয় কারাগারে গিয়ে এক ঘণ্টার বেশি সময় ধরে শেষ সাক্ষাৎ করেন।
একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় শেরপুর জেলার সোহাগপুর গ্রামে ১৬৪ জনকে হত্যা ও নারী নির্যাতনের দায়ে ২০১৩ সালের ৯ মে কামারুজ্জামানকে মৃত্যুদণ্ড দেন ট্রাইব্যুনাল-২।
এ রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে আপিল করা হলে গত বছরের ৩ নভেম্বর কামারুজ্জামানের ফাঁসির আদেশ বহাল রাখেন আপিল বিভাগ।
গত ১৮ ফেব্রুয়ারি আপিল বিভাগের রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশিত হলে গত ৫ মার্চ তা পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) আবেদন করেন কামারুজ্জামান। ৬ এপ্রিল এ আবেদনও খারিজ করে দেন আপিল বিভাগ। গত বুধবার (৮ এপ্রিল) রিভিউ খারিজের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের পর তা পাঠানো হয় কারাগারে।
এরপর তার মৃত্যুদণ্ড রোধে একটাই পথ ছিলো রাষ্ট্রপতির ক্ষমা। ফাঁসির রায় পড়ে শোনানোর পর তাই তার কাছ থেকে জানতে চাওয়া হয়, তিনি দোষ স্বীকার করে রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমা চাইবেন কি-না। তখন থেকে সিদ্ধান্ত নিতে ‘যৌক্তিক সময়’ চেয়ে চারদিন কাটিয়ে দেন এই জামায়াত নেতা। পরে শুক্রবার (১০ এপ্রিল) তার কাছে আবারও শেষ সিদ্ধান্ত জানতে চাওয়া হয়। এ সময়ই সিদ্ধান্ত জানতে যাওয়া দু’জন ম্যাজিস্ট্রেটের মাধ্যমে কারা কর্তৃপক্ষ নিশ্চিত হয়, কামারুজ্জামান ক্ষমা চাইছেন না।
প্রাণভিক্ষা চাওয়ার বিষয়ে নেতিবাচক সিদ্ধান্ত দেওয়ার পরই কামারুজ্জামানের ফাঁসি কার্যকরের উদ্যোগ নেয় কেন্দ্রীয় কারাগার।
এভাবেই আইনগত সব ধরনের প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেই কার্যকর হলো তার মৃত্যুদণ্ডাদেশ।