বাংলাভূমি২৪ ডেস্ক ॥
নারায়ণগঞ্জ: শত শত মানুষের সামনে ‘গণধোলাই’ আর কান ধরে উঠবস করানোর পরেও শেষ রক্ষা হলো না নারায়ণগঞ্জের সেই প্রধান শিক্ষকের। এবার নানা অপবাদ দিয়ে তাকে বরখাস্ত করা হলো।
শিক্ষক নিয়োগের নামে অর্থ গ্রহণ, স্কুলে অনুপস্থিত ও দেরি করে আসার কারণ দেখিয়ে নারায়ণগঞ্জের পিয়ার সাত্তার লতিফ জামান উচ্চ বিদ্যালয়ের সেই প্রধান শিক্ষক শ্যামন কান্তি ভক্তকে সাময়িক বরখাস্ত করার সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিয়েছে বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।
মঙ্গলবার (১৭ মে) সকালে নারায়ণগঞ্জ ৩০০ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতালে চিকিৎসাধীন প্রধান শিক্ষক শ্যামল কান্তি ভক্ত বাংলামেইলকে বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, বরখাস্তের চিঠিটি হস্তগত হয়েছে। চারটি সুনির্দিষ্ট কারণ উল্লেখ করে সোমবার (১৬) বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি ফারুকুল ইসলামের স্বাক্ষর করা ওই চিঠিতে বরখাস্তের বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে।
একজন মহান শিক্ষককে এভাবে অপদস্থ করার ঘটনায় সোমবার (১৬) সচিবালয়ে নিজ দপ্তরে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে বিব্রতবোধ করেন শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ। তিনি বলেন, ‘একজন শিক্ষকের সঙ্গে এ আচরণ গ্রহণযোগ্য নয়।’ পরে তিনি বিষয়টি খতিয়ে দেখতে শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে তদন্ত কমিটি গঠন করার কথা বলেন। করেন।
শিক্ষামন্ত্রীর নির্দেশনার পরে তদন্ত সংশ্লিষ্টরা ঘটনাস্থলে উপস্থিত বিভিন্নজনের সঙ্গে কথা বলে প্রধান শিক্ষককে অপদস্থ করার নেপথ্যে ষড়যন্ত্রের তথ্য পান। যার মধ্যে একটি হচ্ছে- মসজিদের মাইকে মিথ্যা ঘোষণার মাধ্যমে পরিস্থিতিকে উসকে দেয়া হয়।
ঘটনা তদন্তে ঘটনাস্থলে যাওয়া বন্দর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মৌসুমী হাবিবও এমন তথ্য নিশ্চিত করেন। তিনি বলেছেন, আহত স্কুলছাত্রের অভিযোগে ধর্মীয় অনুভূতির বিষয়টি উল্লেখ ছিল না। এছাড়া ম্যানেজিং কমিটির বিরোধের বিষয়ে তথ্য পাওযা গেছে।
শিক্ষকে গণধোলাই আর কান ধরে উঠবস করানোর ঘটনায় তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ। তিনি বলেছেন, ‘এই সভ্য জগতে এটা ভাবাও যায় না, যেটা করেছেন ওই সংসদ সদস্য। কোন বিবেকে করেছেন এটা আমার কাছে বোধগম্য নয়। ওই সংসদ সদস্য (সেলিম ওসমান) লজ্জিত হয়েছেন কিনা জানি না। তবে তার এ কর্মকাণ্ডে আমি শুধু একজন সংসদ সদস্য হিসেবে নয়, একজন নাগরিক হিসেবেও আমি অত্যন্ত লজ্জিত এবং দুঃখিত। আমি আশা করি, ওই সংসদ সদস্য এ ঘটনার জন্য ওই শিক্ষকের কাছে ক্ষমা চাইবেন, জাতির কাছে ক্ষমা চাইবেন। যাতে ভবিষ্যতে যেন কেউ কোনো শিক্ষককে এ ধরনের অপমান করার সাহস না পায়।’
শিক্ষককে এভাবে প্রকাশ্যে অপদস্থ করার বিষয়ে মঙ্গলবার (১৭ মে) বেল ১১টায় রাজধানীর বিচার প্রশাসন ও প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটে বিশেষ জজদের নিয়ে আয়োজিত এক সভায় আইনমন্ত্রী আনিসুল হক মন্তব্য করেছেন, ‘শিক্ষককে কান ধরে উঠবস করার ঘটনাটি পেনাল কোড (দণ্ডবিধি) অনুযায়ী শাস্তিযোগ্য অপরাধ। যারা এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত, তারা শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছেন। জড়িতদের বিচারের আওতায় আনা হবে।’
তবে এতোসব ঘটনার পরেও কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি অপদস্থ হওয়া শিক্ষক শ্যামল কান্তি ভক্তের। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন শিক্ষককে আরেক দফা অপদস্থ করা হয়েছে। স্কুল ম্যানেজিং কমিটির সভায় তাকে ‘মিথ্যাসব’ অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়। ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি ফারুকুল ইসলামের স্বাক্ষর করা তাকে বরখাস্তের চিঠি পাঠানো হয়।
চিঠিতে শ্যামল কান্তি ভক্তকে উদ্দেশ করে লেখা হয়েছে, ‘আপনার বিরুদ্ধে আনিত নিম্ন বর্ণিত অভিযোগসমূহ অদ্যকার পিয়ার সাত্তার লতিফ স্কুলের ম্যানেজিং কমিটির সভায় উত্থাপিত হয়। (১) আপনি ছাত্রদের উপর শারীরিক নির্যাতন করেন। (২) বিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে চাকরি দেয়ার নাম করে অর্থ গ্রহণ করেছেন। (৩) ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য করেছেন ও (৪) বিদ্যালয়ের ছুটি ব্যতিরকে অনুপস্থিত থাকেন এবং প্রায়ই দেরি করে বিদ্যালয়ে আসেন।’
চিঠি আরো উল্লেখ করা হয়, ‘পূর্বেও এসব অভিযোগ আপনার বিরুদ্ধে উত্থাপিত হয়েছে এবং আপনাকে বহুবার সতর্ক করা হয়েছে। কিন্তু আপনি এরূপ অবৈধ কর্মকাণ্ড থেকে বিরত হননি। তাই ১৩ মে ম্যানেজিং কমিটির সর্ব সম্মত সিদ্ধান্ত মোতাবেক আপনাকে পিয়ার সাত্তার লতিফ উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের পদ থেকে সাময়িক বরখাস্ত করা হলো।’
গত ১৩ মে মানেজিং কমিটির নেয়া সিদ্ধান্তের বিষয়টি তিনি জানতে পারেন সোমবার (১৬ মে)। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তাকে বরখাস্ত করার চিঠি পাওয়ার পরও শ্যামল কান্তি ভক্ত তার বিরুদ্ধে আনা সব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তিনি বাংলামেইলের কাছে দাবি করে বলেন,‘এসবের কোনোটাই সত্য না। এসব কিছুর পক্ষে ছিলাম না বলেই আজ এতো আপমান অপদস্থ হতে হয়েছে।’
বরখাস্তের বিষয় জানতে চেয়ে বাংলামেইল থেকে ফারুকুল ইসলামের মোবাইল ফোনে বার বার কল দিলেও সেটা বন্ধ পাওয়া যায়। তবে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, তিনি দেশের বাইরে অবস্থান করছেন।
নারায়ণগঞ্জ বন্দর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মৌসুমি হাবিবের মন্তব্য, বিষয়টি স্কুল কর্তৃপক্ষ ও ম্যানেজিং কমিটির।
প্রশ্ন উঠেছে, কোনো বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটি কি আইনের ঊর্ধে? আইন সম্পর্কেই যাদের কোনো ধারণা নেই বা মানেন না, তারা কী করে অপর একজনকে আইনের দোয়াই দিয়ে বিচারের আওতায় আনতে পারে?
প্রসঙ্গত, ইসলাম ধর্মের বিরুদ্ধে কটূক্তি করার অপবাদে শুক্রবার (১৩ মে) পিয়ার সাত্তার লতিফ জামান উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে শত শত মানুষের সামনে প্রবীণ ওই শিক্ষককে কান ধরে উঠবস করতে বাধ্য করেন নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনের সংসদ সদস্য (এমপি) এ কে এম সেলিম ওসমান। শুধু তাই নয়, জনতার উদ্দেশে হাতজোড় করে ক্ষমা চাইতেও নির্দেশ দেন তিনি।
শিক্ষককে অপদস্ত করার সময় মোবাইল ও ভিডিও ক্যামেরায় সে দৃশ্য ধারন করা হয়। পরে তা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে (ফেসবুক) ছেড়ে দেয়া হয়। ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে, সেলিম ওসমানের নিজে দাঁড়িয়ে থেকে ওই শিক্ষককে কান ধরে তিনবার উঠবস করাচ্ছেন। আর এই দৃশ্য দেখে সামনের জনতা উল্লাস করছে। অনেকেই শিস দিচ্ছে। এর মধ্যে সমস্বরে ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ স্লোগান দিতেও শোনা যায়। বাংলামেইল২৪ডটকম