শনিবার , ২১শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ , ৬ই আশ্বিন, ১৪৩১ , ১৭ই রবিউল আউয়াল, ১৪৪৬

হোম > গ্যালারীর খবর > কষ্টে নিখোঁজদের পরিবার, আহতরা বোঝা

কষ্টে নিখোঁজদের পরিবার, আহতরা বোঝা

শেয়ার করুন

গাইবান্ধা প্রতিনিধি ॥

ঢাকার সাভারের রানা প্লাজা ভবন ধসের ঘটনার চার বছর আজ। ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল ওই ঘটনায় গাইবান্ধার ১২জন নিখোঁজ হন। নিখোঁদের রোজকারে চলতো অনেক পরিবার। রানা প্লাজা ধসে তাদেরকে হারিয়ে তাই এসব পরিবারের সদস্যরা অনেক কষ্টে দিনাতিপাত করছেন। নিখোঁজদের কয়েকটি পরিবার দাবি করছে, তাদেরকে এখনো আর্থিক কোনো সহায়তা প্রদান করা হয়নি। ফলে তাদের পরিবারের সদস্যরা মানবেতর জীবনযাপন করছেন। অপরদিকে রানা প্লাজা ধসে আহত শ্রমিকদের দিন কাটছে অনেক কষ্টে। আহতরা পাচ্ছেন না কোনো চাকরি। ফলে তারা কাজ করতে না পেরে এখন পরিবারের বোঝা হয়েছেন।

জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, রানা প্লাজা ভবন ধসে গাইবান্ধার ৪৯জন নিহত ও ১২জন নিখোঁজ হন। আহত হন আরও অনেকে। সেসময় বিভিন্ন সংস্থা ও প্রতিষ্ঠান থেকে কয়েকজনকে আর্থিক সহায়তা দেয়া হয়। এরপর গত চার বছরে আর কোনো আর্থিক সহায়তা মেলেনি।

ভবন ধসের ওই ঘটনায় জেলার নিখোঁজ ব্যক্তির মধ্যে সদর উপজেলায় তিনজন, পলাশবাড়ী উপজেলায় তিনজন, সাদুল্লাপুর উপজেলায় পাঁচজন ও সাঘাটা উপজেলায় একজন। এখনো তাদের কোনো খোঁজ মেলেনি।

নিখোঁজ ব্যক্তিরা হলেন- সদর উপজেলার কুপতলা ইউনিয়নের চাপাদহ বুড়ির খামার গ্রামের রমজান আলীর মেয়ে হালিমা খাতুন (রেশমা), ধাকুরাকুটি গ্রামের ইউনুস আলীর মেয়ে রিনা বেগম, বোয়ালি ইউনিয়নের মধ্য ফলিয়া গ্রামের মৃত কফিল উদ্দিনের মেয়ে মুক্তা বেগম, পলাশবাড়ী উপজেলার মনোহরপুর ইউনিয়নের কুমেদপুর গ্রামের শফিকুল ইসলামের মেয়ে শ্যামলী খাতুন, আব্দুল কাইয়ুম ওরফে জলিল ব্যাপারীর মেয়ে নুরুন্নাহার আক্তার শিল্পী ও সাতারপাড়া গ্রামের নুরুল ইসলাম বাটুর ছেলে জিল্লুর রহমান ওরফে রাফিউল, সাদুল্লাপুর উপজেলার দক্ষিণ ভাঙ্গামোড় গ্রামের আবদুল বারী আকন্দের মেয়ে বিথী খাতুন, দামোদরপুর গ্রামের তাজুল ইসলামের স্ত্রী বুলবুলি বেগম, পূর্বদামোদরপুর গ্রামের আনিছুর রহমানের মেয়ে রাশেদা বেগম, উত্তর দামোদরপুর গ্রামের সিদ্দিকুর রহমানের স্ত্রী নুরবানু আক্তার আশা ও কিশামত দশলিয়া গ্রামের সোনা মিয়ার স্ত্রী কামনা বেগম, সাঘাটা উপজেলার ধোপারভিটা গ্রামের মুছা মিয়ার স্ত্রী বিলকিস বেগম।

সাদুল্লাপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, রানা প্লাজা ধসে উপজেলার ২৪ জন শ্রমিক নিখোঁজ হন। এর মধ্যে ১৬ জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। পরে ডিএনএ রিপোর্টের মাধ্যমে আরও তিনজনের মরদেহ শনাক্ত হয়। এখনো পাঁচজন শ্রমিক নিখোঁজ রয়েছেন।

নিখোঁজদের পরিবারে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নিখোঁজ শ্রমিকদের টাকায় চলতো অনেকের পরিবার। রানা প্লাজা ধসে তাদেরকে হারিয়ে সেসব পরিবারের সদস্যরা অনেক কষ্টে দিনাতিপাত করছেন।

বিথী খাতুনের মা আঞ্জুয়ারা বেগম জাগো নিউজকে বলেন, দুই বোন দুই ভাইয়ের মধ্যে বিথী সবার বড়। সংসারে অভাবের কারণে দুই মেয়ে রানা প্লাজার একটি পোশাক কারখানায় চাকরি করত। ভবন ধসে বড় মেয়ে নিখোঁজ হয়। এখনো তার কোনো সন্ধান পেলাম না। কোনো ধরনের আর্থিক সহায়তাও পাইনি।

হালিমা খাতুন রেশমার বাবা মো. রমজান আলী রোববার রাত সাড়ে ৯টায় মুঠোফোনে জাগো নিউজকে বলেন, পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে সবার ছোট রেশমা। আমার বয়স ৬০বছর পেরিয়ে গেছে। কাজ করতে পারি না। মেয়েটার টাকায় সংসার চলত। রানা প্লাজা ধসের দুইমাস আগে মেয়েটি ওখানকার একটি পোশাক কারখানায় চাকরি নেয়। সে এখনো নিখোঁজ রয়েছে। মেয়েটা নেই। খুব কষ্টে দিন কাটছে। কোনো সহযোগিতাও পাইনি কারও কাছ থেকে।

এই দুই পরিবারের মতো কোনো আর্থিক সহায়তা পাননি হালিমা খাতুন ও বিলকিছ বেগমের পরিবারের সদস্যরাও।

আহতরা পরিবারের বোঝা

রানা প্লাজা ধসে আহত শ্রমিক সাদুল্লাপুর উপজেলার দক্ষিণ দামোদরপুর গ্রামের সায়েব মন্ডলের মেয়ে সোনিয়া বেগম। তিনি ওই ঘটনায় ডান পা হারিয়েছেন। অভাবের সংসারে একটু সুখের আশায় সোনিয়া ও তার স্বামী মিজানুর রহমান চাকরি নিয়েছিলেন রানা প্লাজার একটি পোশাক কারখানায়। ২২ দিনের মাথায় ভবন ধসের ঘটনা ঘটে। মিজানুর সেদিন বাইরে থাকায় বেঁচে যান।

সোনিয়া বেগম জানান, এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আমার ডান পা কোমরের নিচ থেকে কেটে ফেলা হয়। সরকার ১০ লাখ টাকা অনুদান দেয়। ওই টাকা থেকে প্রতিমাসে ১০ হাজার টাকা করে লাভ পাচ্ছি। এই টাকায় এখনো চিকিৎসা ও সংসার চালাতে হচ্ছে। তার স্বামী মিজানুর রহমান বাড়িতে ছোট আকারের মনোহারি দোকান দেন। কিন্তু মূলধনের অভাবে সেটি বন্ধ। দেড় বছরের শিশু মিম্মি ও বাবা-মাকে নিয়ে কোনোরকমে সংসার চলছে। সরকার চাকরি দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিলেও অদ্যবধি চাকরি পায়নি পরিবারটির কেউই।

সাদুল্লাপুর উপজেলার ফরিদপুর ইউনিয়নের চকগোবিন্দপুর গ্রামের রিকতা খাতুন ২০০৯ সালে রানা প্লাজার ফ্যানটম পোশাক কারখানায় চাকরি নেন। ওই ভবন ধসের ঘটনায় তিনি ডানহাত হারিয়েছেন। তিনি বলেন, ডান হাতের উপরে ইটের দেয়াল ভেঙে পড়ে। চারদিন পর করাত দিয়ে হাত কেটে আমাকে বের করা হয়। পরে দুইমাস চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হয়ে বাড়িতে ফিরি।

এক বছর আগে তার দ্বিতীয় স্বামীও তাকে তালাক দেন। পোশাক কারখানায় চাকরির আগে রিকতা খাতুনের আরও একবার বিয়ে হয়েছিল। সেই পক্ষের একটি ছেলে সন্তানও রয়েছে। এখন তিনি ধাপেরহাট এলাকায় ভাড়া বাসায় ছেলে রিমন (১৩) ও মেয়ে মিমকে (২) নিয়ে বসবাস করছেন।

রিকতা খাতুন বলেন, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে পাওয়া ১২ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র থেকে পাওয়া মাসিক ১২ হাজার টাকার সুদ দিয়ে সংসার কোনোমতো চলছে। কিন্তু আজও চাকরি পাইনি।