করোনা নিয়ন্ত্রণে নেই, বন্যা ও ঈদে সংক্রমণের নতুন ঝুঁকি

অনলাইন ডেস্ক ॥
দেশে এখন করোনা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে নেই। সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে বড় কর্মকাণ্ডও চোখে পড়ছে না। সাধারণভাবে মানুষের মধ্যে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার প্রবণতা কম দেখা যাচ্ছে। সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে অনির্দিষ্টকালের জন্য দৈনন্দিন জীবনযাপন মানুষের কাছে অসহনীয় হয়ে উঠছে। এরই মধ্যে শুরু হয়েছে বন্যা। তিন সপ্তাহ পরে পবিত্র ঈদুল আজহা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বন্যা ও ঈদকে ঘিরে সংক্রমণের ঝুঁকি বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা আছে।

সূত্রগুলো বলছে, কোরবানি ঈদের সময় সরকার, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও সাধারণ মানুষের করণীয় বিষয়ে ১ জুলাই একটি সভা করেছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পাবলিক হেলথ অ্যাডভাইজারি কমিটির সদস্যরা। সভায় বিশ্বের অন্যান্য মুসলিমপ্রধান দেশে ঈদ সামনে রেখে কী করছে, তা নিয়ে আলোচনা হয়। সরকারের জন্য কিছু পরামর্শ তৈরি করেছে কমিটি।

কমিটির সদস্য ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক অধ্যাপক শাহ মুনির হোসেন বলেন, ‘গত ঈদের পরপরই সংক্রমণ বেড়ে গিয়েছিল। এবারও আশঙ্কা আছে। সেই আশঙ্কা থেকে কিছু পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।’

গত ঈদের আগেও কমিটি কিছু পরামর্শ দিয়েছিল। চলাচল সীমিত করার জন্য প্রয়োজনে সান্ধ্য আইন জারির কথাও বলেছিল কমিটি। সূত্র বলছে, এবারও কমিটি মানুষের চলাচল সীমিত করার পরামর্শ দিয়েছে। কমিটি বলেছে, শহর থেকে গ্রামের বাড়িতে যাওয়া বন্ধ করার জন্য ঈদের আগের ও পরের তিন দিন চলাচল কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। পশুর হাটে স্বাস্থ্যবিধি মানা ও ভিড় কমানোর ব্যবস্থা করতে হবে। তবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে, সুপারিশ তাদের কাছে এখনো পৌঁছায়নি।

বন্যা ও সংক্রমণ

দেশের বড় বড় নদীতে ১৬টি স্থানে পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। দেশের ১২টি জেলায় বন্যা পরিস্থিতি খারাপ। জেলাগুলোর মধ্যে আছে কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, লালমনিরহাট, নীলফামারী, জামালপুর, বগুড়া, সিরাজগঞ্জ, রাজবাড়ী, মুন্সিগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, সিলেট ও সুনামগঞ্জ। এসব জেলায় প্রায় সাড়ে তিন লাখ মানুষ পানিবন্দী। অনেক মানুষ বাঁধে আশ্রয় নিয়েছেন, অনেকে উঁচু কোনো স্থানে। পূর্বাভাস বলছে, এই মাসের ৭ তারিখের পর থেকে পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে, নতুন নতুন জেলা বন্যাকবলিত হওয়ার আশঙ্কা আছে। পরিস্থিতি খারাপ থাকতে পারে তৃতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত।

গতকাল একাধিক গণমাধ্যমে দেখা গেছে বাঁধ, বাজার বা উঁচু কোনো জায়গায় অনেক মানুষ ঘেঁষাঘেঁষে করে বসে আছেন ত্রাণের অপেক্ষায়। তাঁদের কারও মুখে মাস্ক নেই। শারীরিক দূরত্বও বজায় থাকছে না।

১২টি জেলাতেই করোনা সংক্রমণ আছে। লালমনিরহাট ছাড়া প্রতিটি জেলায় আক্রান্তের সংখ্যা এক শ র বেশি। সিলেট ও বগুড়ায় আক্রান্তের সংখ্যা আড়াই হাজারের বেশি। এসব জেলার বহু মানুষ রোগ শনাক্তকরণের জন্য নমুনা দিতে পারবেন না, পরীক্ষা করাতে পারবেন না। আক্রান্ত হলে চিকিৎসার সুযোগ কম পাবেন। এসব কারণে কোনো কোনো জেলায় সংক্রমণ পরিস্থিতি স্বাভাবিকের চেয়ে খারাপ হতে পারে বলে বিশষেজ্ঞরা মনে করছেন।

বন্যা সংক্রমণের ওপর দুই ধরনের প্রভাব ফেলতে পারে বলে মনে করছেন রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মুশতাক হোসেন। তিনি বলেন, বন্যার কারণে অনেকে বিচ্ছিন্ন থাকতে বাধ্য হবেন। তাঁরা সংক্রমণ থেকে দূরে থাকবেন। কিন্তু যাঁরা আশ্রয়কেন্দ্রে বা বেড়িবাঁধের ওপর থাকবেন, তাঁদের সংক্রমণের ঝুঁকি বেশি। তাঁদের পক্ষে সামাজিক দূরত্ব মানা সম্ভব নয়। তাঁদের কাপড়ের মাস্ক, সাবান সরবরাহ করার ব্যবস্থা করতে হবে। দুর্গত ব্যক্তিদের মধ্য থেকে স্বেচ্ছাসেবক নিয়োগ দিয়ে স্বাস্থ্যবিধি মানার ব্যাপারে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করতে হবে।

বর্তমান পরিস্থিতি

সব মানুষ স্বাস্থ্যবিধি মানছেন না। গতকাল রাজধানীর বাংলামোটর, কারওয়ান বাজার, মহাখালী, ভাটারা এসব জায়গা ঘুরে দেখা গেছে, অনেক মানুষ মাস্ক না পরেই রাস্তায় বেরিয়েছেন। সবজি–মাছ–মাংসের বাজারে অনেক দোকানির মুখে মাস্ক দেখা যায়নি। কেউ বলেন, সারা দিন মাস্ক পরে থাকা যায় না। কেউ উল্টো জিজ্ঞাসা করেন, মাস্ক পরে লাভ কী? কেউ কেউ মুখ–নাক ফাঁকা করে মুখের নিচে মাস্ক রাখেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক শাফিউন শিমুল সরকারি তথ্য বিশ্লেষণ করে বলেছেন, দেশের করোনা সংক্রমণ হার বা ইফেকটিভ রিপ্রোডাক্টিভ রেট এখন ১ দশমিক শূন্য ১। তিনিসহ চার বিশেষজ্ঞ দেশের সংক্রমণ পরিস্থিতি নিয়ে এপ্রিল থেকে পূর্বাভাস দিয়ে আসছেন। তাঁদের পূর্বাভাস স্বাস্থ্য অধিদপ্তর পরিকল্পনার কাজে ব্যবহার করছে।

শাফিউন শিমুল বলেন, ‘সংক্রমণ হার এক বা একের বেশি থাকা বিপজ্জনক। নিয়ন্ত্রণের কার্যকর উদ্যোগ না নিলে এই ধারা চলতে থাকবে। ঈদের পর সংক্রমণ হঠাৎ বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা আছে।’ তাঁদের পূর্বাভাস বলছে, বর্তমান ধারা চলতে থাকলে আগস্টের মাঝামাঝি আক্রান্ত ব্যক্তির সংখ্যা ৩ লাখ ৮০ হাজার ছাড়াবে। আর ঈদের সময় কঠোর ব্যবস্থা না নিলে আক্রান্ত পাঁচ লাখ ছাড়িয়ে যেতে পারে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সৌদি আরবসহ একাধিক দেশে সংক্রমণ হার একের নিচে এসেছিল। কিছুদিন পর সংক্রমণ বাড়তে দেখা গেছে। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড উন্মুক্ত করে দেওয়া এর অন্যতম কারণ হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

ঈদের ভাবনা

ঈদের ভাবনা মানুষ এখনই ভাবতে শুরু করেছে। পবিত্র ঈদুল ফিতর মানুষ উদ্যাপন করেছিলেন কিছুটা ভয়ে, আতঙ্কে। তবে অনেকেই আশা করেছিলেন, পবিত্র ঈদুল আজহায় করোনা পরিস্থিতির উন্নতি হবে। ভয়হীন পরিবেশে পশু কেনা ও কোরবানি দেওয়া যাবে। পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি, উন্নতির লক্ষণ নেই। তিন সপ্তাহ পরে ঈদ।

বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, গরু-ছাগল কেনা ও কেনার পর পশু ব্যবস্থাপনা স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ায়। সংক্রমণের সবচেয়ে বড় ঝুঁকি পশুর হাটে। হাটে থাকে ভিড়। হাটে স্বাস্থ্যবিধি অনেকেই মানবেন না। আর সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে পশু কেনাবেচা কঠিন।

তারপরও বিশেষজ্ঞরা কিছু পরামর্শ দিয়েছেন। এখনই মানুষকে স্বাস্থ্যবিধি মানার ব্যাপারে সজাগ করার উদ্যোগ নিতে হবে। সচেতন করার নতুন পন্থা খুঁজতে হবে, নতুনভাবে বার্তা দিতে হবে। বিক্রেতাদের কিছু বিধিনিষেধের আওতায় আনা যায় কি না, তা ভাবতে হবে। সবচেয়ে বড় দায়িত্ব ইজারাদারদের। হাটে সাবান–পানির ব্যবস্থা করা, মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক করার ওপর জোর দিতে হবে। এসব ক্ষেত্রে সিটি করপোরেশন, পৌর মেয়র বা জনপ্রতিনিধিদের বড় ভূমিকা আছে।

সরকার কী করছে

বন্যার কারণে সংক্রমণ পরিস্থিতির অবনতি ঘটতে পারে, এ আশঙ্কা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের মধ্যেও আছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মুখপাত্র আয়শা আক্তার বলেন, ‘বন্যার্তদের সচেতন ও সহায়তা করার জন্য বিভিন্ন বিভাগীয় পরিচালক ও সংশ্লিষ্ট জেলার সিভিল সার্জনরা উদ্যোগ নিয়েছেন। মেডিকেল টিম গঠন করা হয়েছে। কেন্দ্রীয়ভাবে জেলাগুলোর পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে।’

এদিকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখার পরিচালক অধ্যাপক শাহনীলা ফেরদৌস বলেন, ‘ঈদের সময় সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে করণীয় নির্ধারণে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর কাজ করছে। সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ কী কী হবে, তারও খসড়া তৈরি হয়েছে। এখন তা সরকারের অনুমোদনের অপেক্ষায়।’

খসড়ায় বলা হয়েছে, প্রতিটি হাটের প্রবেশমুখে স্বাস্থ্যকর্মীরা থাকবেন। তাঁরা ক্রেতা–বিক্রেতার শরীরের তাপ মাপবেন। হাটে আসা প্রতিটি মানুষকে মাস্ক পরা নিশ্চিত করবেন। এ ছাড়া শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখার বিষয়টি নিশ্চিত করা হবে। সূত্র: প্রথম আলো।

শেয়ার করুন

Related News

সাম্প্রতিক সংবাদ

আর্কাইব

Sat Sun Mon Tue Wed Thu Fri
 1234
567891011
12131415161718
19202122232425
2627282930  

প্রধান সম্পাদক : সাঈদুর রহমান রিমন
সম্পাদক ও প্রকাশক : মোঃ নজরুল ইসলাম আজহার

সার্বিক যোগাযোগ : চৌধুরী মল (৫ম তলা), ৪৩ হাটখোলা রোড, ঢাকা-১২০৩॥

গাজীপুর অফিস : এ/১৩১ (ইকবাল কুটির) হাবিব উল্লাহ স্মরণী, জয়দেবপুর, গাজীপুর-১৭০০॥

হটলাইন: ০১৭৫৭৫৫১১৪৪ ॥ সেলফোন : ০১৭১৬-৩৩৩০৯৬ ॥ E-mail: banglabhumibd@gmail.com

© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত বাংলাভূমি ২০০৯-২০২৫