বাংলাভূমি২৪ ডেস্ক ॥
ঢাকা : ছাত্রদলের সদ্য ঘোষিত কমিটিগুলো নিয়ে ক্ষোভ-বিক্ষোভের মধ্যে সংগঠনটির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করেছে বিক্ষুব্ধরা। এ সময় তারা বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের ম্যুরাল ও ছাত্রদলের সাংগঠনিক নেত্রী খালেদা জিয়ার ছবি ভাঙচুর করে এবং তিনটি মোটরসাইকেলে আগুন ধরিয়ে দেয়।
রোববার বিকেলে রাজধানীর নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয় ও কার্যালযের সামনে এসব ঘটনা ঘটে। তবে এ সময় অদূরে পুলিশকে ‘নীরব ভূমিকায়’ থাকতে দেখা গেছে।
গত শনিবার রাতে কেন্দ্রীয় কমিটি পূর্ণাঙ্গ (৭৩৬ সদস্যবিশিষ্ট) হওয়ার পাশাপাশি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি), ঢাবির ছেলেদের ১২টি হল, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় (জবি), জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় (জাবি), ঢাকা মহানগর উত্তর-দক্ষিণ-পূর্ব-পশ্চিম, ঢাকা কলেজ, তিতুমীর কলেজ, তেজগাঁও কলেজ, সরকারি কবি নজরুল কলেজ, সরকারি বাঙলা কলেজ, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকা জেলা শাখা ছাত্রদলের কমিটি ঘোষণা করা হয়।
এরপর রোববার রাতে ঢাকা মহানগর এবং তিতুমীর কলেজ ছাত্রদলের বেশকিছু নেতা কমিটির বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে বিএনপি চেয়ারপারসনের গুলশানের রাজনৈতিক কার্যালয়ের সামনে স্লোগান দেয়। তাদের অভিযোগ, বিএনপির ছাত্রবিষয়ক সম্পাদক শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানী এবং সহ-ছাত্রবিষয়ক সম্পাদক সুলতান সালাউদ্দিন টুকু ব্যক্তিস্বার্থে ছাত্রদলের বিভিন্ন ইউনিটে ‘পকেট কমিটি’ দিয়েছেন। এ সময় তারা নতুন কমিটির দাবি জানান।
এরই ধারাবাহিকতায় ছাত্রদলের পদবঞ্চিত নেতা-কর্মীরা যেকোনো দিন নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনেও বিক্ষোভ প্রদর্শন করতে পারে, এমন আশঙ্কা ছিল। তবে সোমবার তারা আসতে পারেন, প্রবল ছিল এমন সম্ভাবনা।
সোমবার দুপুর দেড়টার দিকে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে গিয়ে দেখা যায়, চার থেকে পাঁচটি টিভি চ্যানেলের গাড়ি কার্যালয়ের সামনে অবস্থান করছে। কার্যালয়ের আশপাশে অবস্থান করছেন পোষাকধারী পুলিশ ও বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা। কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে তখন তেমন কোনো নেতা নেই। কার্যালয়ের সামনেও মোটামুটি স্বাভাবিক অবস্থা বিরাজ করছে, তেমন কোনো লোকজন নেই। খোলা রয়েছে কার্যালয়ের নিচতলায় অবস্থিত ‘বিএনপির সামগ্রী প্রদর্শনী ও বিক্রয়কেন্দ্র’।
দুপুর আড়াইটার দিকে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের চারতলায় অবস্থিত ছাত্রদলের কার্যালয়ের সামনে গিয়ে দেখা যায়, কার্যালয় খোলা রয়েছে। ভেতরে দুজন বসে আছেন। পরিচয় জানতে চাইলে, একজন নিজেকে ধানমণ্ডি থানা ছাত্রদলের নেতা পরিচয় দিলেও নাম প্রকাশ করেননি তিনি। বাকিজন পরিচয় দেননি।
বিকেল ৩টার দিকে কার্যালয়ে আসনে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আব্দুল্লাহ আল নোমান। একই সময় টিভি মিডিয়ার গাড়িগুলো কার্যালয়ের সামনে থেকে চলে যায়। কার্যালয়ের সামনে তখন ১৮-৩০ বছর বয়সী ২০-২৫ জন লোক দাঁড়িয়ে ছিলেন। রাখা ছিল তিনটি মটরসাইকেলও। কার্যালয়ের পশ্চিম পাশের হোটেল ভিক্টোরির গলির মুখে তখন পোষাকধারী পুলিশ সদস্যরা অবস্থান করছিলেন। বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে কার্যালয় ত্যাগ করেন নোমান।
এরপর পৌনে ৪টার দিকে পূর্বদিক দিকে একটি মিছিল এসে কার্যালয়ের সামনে দিয়ে পশ্চিম দিকে চলে যায়। ‘এলাকা প্রীতি,পদ-বাণিজ্য ও পকেট কমিটি মানি না,মানবো না’ লেখা ব্যানার নিয়ে ছাত্রদল কেন্দ্রীয় সংসদের নামে ৬০-৭০ জনের মিছিলটি যখন বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনের সড়ক অতিক্রম করছিল, তখন তাদের সঙ্গে আরও ২০-২৫ জন লোক যোগ দেয়, যারা সেখানে আগ থেকে অবস্থান করছিল। মিছিলকারীদের অনেককে এ সময় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদলের ব্যানারে ‘ছাত্রলীগ-শিবিরমুক্ত কমিটি চাই,দিতে হবে; অযোগ্যদের কমিটি বাতিল কর,করতে হব’- হাতে লেখা লেখা ছোট পোস্টারও বহন করতে দেখা যায়।
ঠিক ওই সময় ছাত্রদলের কার্যালয়ে ভাঙচুর চালিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়। তবে কে বা কারা আগুন দিয়েছে তা জানা যায়নি। এ সময় ‘বিএনপির সামগ্রী প্রদর্শনী ও বিক্রয়কেন্দ্র’র ভেতরে থাকা সেলসম্যান নাসির উদ্দিনকে তড়িঘড়ি করে সাটার টেনে বের হয়ে যেতে দেখা যায়।
মিছিলটি এরপর হকস বে’র (গাড়ির শোরুম) সামনে গিয়ে ইউটার্ন করে আবার কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের দিকে আসতে শুরু করে। ওই সময় বিএনপি কার্যালয়ের বিপরীতে অবস্থিত ভাসানী ভবনের পাশের গলি থেকে ৩০-৪০ জন লোক লাঠি-সোটা নিয়ে মিছিলে যোগ দেয়। মিছিলকারীরা তখন ‘এ্যানী-টুকু’র পকেট কমিটি মানি না, মানব না; এ্যানী-টুকুর পদত্যাগ চাই’ এমন স্লোগান দিতে থাকে। কার্যালয়ের সামনে এসে মিছিলকারীরা বিভক্ত হয়ে তাণ্ডব চালাতে শুরু করে। একটি অংশ সেখানে থাকা তিনটি মটরসাইকেলে আগুন ধরিয়ে দেয়।
এ সময় আগুন লাগা অবস্থায় একটি মটরসাইকেল সরিয়ে নেয়া সম্ভব হলেও বাকি দুটি মটরসাইকেল পুরোপুরি পুড়ে যায়। জানা যায়, এর একটির (ঢাকা মেট্রো-ল :২১-২৫৯০, পালচার) মালিক পল্লবী থানা স্বেচ্ছাসেবক দলের সাধারণ সম্পাদক আনোয়ার হোসেন। অন্যটি (ঢাকা মেট্রো-ল :১৯-৭৪৮৩, ওয়ালটন) যাত্রাবাড়ির ব্যবসায়ী জাবেদ চৌধুরীর। আর সরিয়ে নেয়া মটরসাইকেলটি পল্লবী থানা স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি মাহবুব আলম মন্টুর বলে জানা গেছে।
ছাত্রদলের বিক্ষুব্ধ নেতা-কর্মীদের আরেকটি অংশ বিএনপি অফিসের কলপসিপল গেইট খুলে জিয়াউর রহমানের ম্যুরালের গ্লাস ভাঙচুর করে। জিয়ার ভাস্কর্যেও আঘাতের চিহ্ন দেখা গেছে। অন্য অংশটি বিক্রয়কেন্দ্র’র সাটার খুলে লাঠি দিয়ে ভেতরের শোকেসের গ্লাস ভাংচুর করে। এছাড়া সেখানে ঢিল ছুঁড়ে ভাঙচুর করে খালেদা জিয়ার ছবি। বাকিরা নিচতলায় অবস্থিত ছাত্রদল ঢাকা মহানগর উত্তরের কার্যালয়ে ঢুকে টিভি ও আসবাবপত্র ভাংচুর করে। অন্য সদস্যরা ঢিল ছুঁড়ে বিএনপির কার্যালয়ের তৃতীয়তলার কনফারেন্স রুম ও মহাসচিবের রুমের গ্লাস ভাঙচুর করে।
বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের দ্বিতীয় তলায় দলীয় চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া এবং তৃতীয় তলায় ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও কেন্দ্রীয় দপ্তর রয়েছে। চতুর্থ তলায় রয়েছে ছাত্রদলসহ কয়েকটি অঙ্গ সংগঠনের কার্যালয়।
ছাত্রদলের বিক্ষুব্ধ নেতা-কর্মীরা যখন তাণ্ডব চালাচ্ছিল, তখন হোটেল ভিক্টোরির সামনে পোষাকধারী পুলিশকে অবস্থান করতে দেখা গেছে। এক পর্যায়ে তারা রাস্তা পেরিয়ে ভাসানী ভবনের সামনে গিয়ে অবস্থান করতে থাকেন। কিন্তু তাদেরকে ছাত্রদল নেতাকর্মীদের তাণ্ডব থামানোর কোনো উদ্যোগ নিতে দেখা যায়নি।
আগুন, মিছিল ও ভাঙচুর শেষ করে বিকেল ৪টা ১০ মিনিটের দিকে বিক্ষুব্ধরা হোটেল ভিক্টোরির সামনে দিয়ে দ্রুত নিরাপদে চলে যায়।
এ ব্যাপারে পুলিশের মতিঝিল জোনের এসি সাইফুর রহমান সাংবাদিকদের বলেন, ‘শুনেছি, ছাত্রদলের পদবঞ্চিতরা ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটিয়েছে। খবর পেয়ে আমরা এখানে এসেছি। খোঁজ-খবর নিয়ে পরবর্তী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’ ঘটনার সময় পুলিশ কাছাকাছি ছিল না বলে জানান তিনি।
জানতে চাইলে সেখানে অবস্থানরত পল্টন থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোরশেদ আলম পিপিএম বাংলামেইলকে বলেন,‘কারা এ ঘটনা ঘটিয়েছে সে ব্যাপারে আমি কিছুই জানি না।’
আগুন লাগার পর বিকেল সোয়া ৪টার দিকে অগ্নিনির্বাপক বাহিনীর সদস্যরা ছুটে আসে। তবে নিয়ন্ত্রণে আনার আগেই ছাত্রদলের কার্যালয় পুড়ে ভস্মীভূত হয়ে যায়।
আগুনে পুড়ে গেছে জিয়াউর রহমান, খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের ছবি; পুড়েছে নতুনভাবে সাজানো ওই কক্ষের ৯টি ফ্যানও (সিলিং ফ্যান ৩টি, ওয়াল ফ্যান ৬টি), ভাঙচুর করা হয়েছে টেলিভিশনটিও। আংশিক অথবা পুরোপুরি পুড়ে গেছে ৫২টি চেয়ার, ভাঙচুর থেকে বাদ যায়নি টেবিলটিও। ছাদের নিচের ওয়ালের তিনপাশ দিয়ে টাঙানো ছাত্রদলের প্রথম থেকে বিগত কমিটির (জুয়েল-হাবিব) শীর্ষ নেতাদের (সভাপতি-সেক্রেটারি) ছবিগুলোও ভাঙচুর করেছে বিক্ষুব্ধরা। কেবল সাবেক সাধারণ সম্পাদক আমিরুল ইসলাম খান আলিম ও হাবিবুর রশিদ হাবিবের ছবি ঝুলে থাকতে দেখা গেছে।
ছাত্রদলের দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট কার্যালয়ে রাস্তা সংলগ্ন ছোট রুমটিতে দপ্তরের কাজ করা হয়। সেই কক্ষে ঢোকার কাচের দরজাও ভেঙে ফেলা হয়েছে। তবে ওই রুমটি তাদের ভাঙচুরের হাত থেকে রক্ষা পেয়েছে।
জানতে চাইলে ছাত্রদলের দপ্তর সম্পাদক আব্দুস সাত্তার পাটোয়ারী বাংলামেইলকে বলেন, দুপুরে খেতে আমি বাইরে গিয়েছিলাম। এ সময়ে দুষ্কৃতকারীরা ঘটনাটি ঘটিয়েছে। শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের ম্যুরাল এবং ছাত্রদলের সাংগঠনিক নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার ছবি যারা ভাঙচুর করতে পারে, তারা কখনোই ছাত্রদলের নেতা কিংবা কর্মী হতে পারে না।
বিকেল ৪টা ৫২ মিনিটে কাযালয়ে আসেন বিএনপির কেন্দ্রীয় দপ্তরের দায়িত্বপ্রাপ্ত যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী আহমেদ। রাত সোয়া ৮টার দিকে কার্যালয় ত্যাগ করেন তিনি।
এ হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় সন্ধ্যায় সাংবাদিকদের রিজভী বলেন,
সরকারের প্রশ্রয়ে বহিরাগত সন্ত্রাসীরা বিএনপি অফিসে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটিয়েছে।
‘কাঙ্ক্ষিত পদ না পেয়ে ছাত্রদল নেতারা এ ধরনের ভাঙচুর করেছে কি না’, এমন প্রশ্নের জবাবে বিএনপির এ নেতা বলেন, ‘গত শনিবার রাতে ছাত্রদলের পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা করা হয়েছে। প্রত্যেকেই এ কমিটি মেনেও নিয়েছে, নেতা-কর্মীরা খুশি। তবে কেউ কাঙ্ক্ষিত পদ না পেলে সে মনোক্ষুন্ন হতে পারে। কিন্তু ছাত্রদলের কেউ দলীয় চেয়ারপারসনের ছবি এবং জিয়াউর রহমানের ম্যুরাল ভাঙচুর করতে পারে না।’
ভাঙচুর ও আগুন লাগার পর থেকে অর্থাৎ বিকেল ৪টা থেকে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয় বিদ্যুৎবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। চার ঘন্টা অন্ধকারাচ্ছন্ন থাকার পর রাত ৮টার দিকে আবার আলোকিত হয় বিএনপি কার্যালয়। বাংলামেইল২৪ডটকম