স্টাফ রিপোর্টার ॥ চমক কিছুই দেখাননি জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। হঠাৎ হঠাৎ সিদ্ধান্ত পাল্টিয়ে দর কষাকষির চিরচেনা কৌশলের বৃত্তেই ঘুরপাক খাচ্ছে তার রাজনীতি। ক্ষমতা ও সুবিধাবাদের রাজনীতিতে সর্বোচ্চ সুবিধাটাই পেতে চান তিনি।
এই পর্যবেক্ষণে সবাই একমত না হলেও আপাতত আওয়ামী লীগ তেমনটাই ভাবছে। আর একারণে এরশাদকে নির্বাচনে ফেরাতে গোপনে জোর চেষ্টা চালাচ্ছে তারা। দলীয় সূত্রে জানা গেছে, এরশাদকে ম্যানেজ করার গুরুদায়িত্বটা দেয়া হয়েছে সবচেয়ে অভিজ্ঞ নেতা উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য আমির হোসেন আমুকে। তাকে এ কাজে সহোযোগিতা করছেন সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ওবাদুল কাদেরসহ আরো একজন নেতা।
এছাড়া তাদের পাশাপাশি এরশাদকে বিভিন্নভাবে প্ররোচিত করার কাজে নিয়োজিত আছে সরকারের গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন। যারা নিয়মিত তার ও তার দলের লোকজনের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছে, তার দাবি সম্পর্কে অবহিত হওয়ার পর দায়িত্বপ্রাপ্ত তিন নেতাকে জানাচ্ছে।
প্রধান বিরোধী দল বিএনপিকে বাদ দিয়েই নির্বাচন অনুষ্ঠানের সব প্রস্তুতি নিয়ে ফেলেছিল আওয়ামী লীগ। মহাজোট থেকে বের হয়ে গেলেও হিসাব মতোই ছয় মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী আর এক উপদেষ্টা পদের বিনিময়ে এরশাদকে ম্যানেজ করা গিয়েছিল। নির্বাচন গ্রহণযোগ্য করতে বিএনপির বিকল্প জাপাকে পেয়ে বেশ উৎফুল্লই ছিলেন শেখ হাসিনা। কিন্তু হঠাৎ নির্বাচন বর্জনের ঘোষণায় সব হিসাব ভেস্তে গেল। কিন্তু হাল ছাড়ছেন না প্রধানমন্ত্রী। এরশাদের সঙ্গে লেনদেনের অভিজ্ঞতা তার পুরনো। তাই সেভাবেই ম্যানেজ করার চেষ্টা করছেন।
আওয়ামী লীগের অনেক নেতা বলছেন, প্রধান বিরোধীদল বিএনপির নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করার ঘোষণায় যতটা না বিপদে আছেন তারা তার চেয়ে বেশি বিপদে ফেলেছেন এরশাদ। এরশাদবিহীন নির্বাচন জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক মহলে গ্রহণযোগ্যতা পাবে কি না তা নিয়ে সন্দেহ আছে। এ নিয়ে ইতিমধ্যে বিভিন্ন মহলে সমালোচনাও চলছে।
তবে আওয়ামী লীগ নেতাদের দৃঢ় বিশ্বাস, শনিবারের মধ্যেই এ সঙ্কটের একটা সমাধান হবে। আর কোনো সমাধান যদি না-ই হয় তারপরও গণতন্ত্রের অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখার স্বার্থে সঠিক সময়ে নির্বাচন করবে আওয়ামী লীগ ।
এদিকে গত বুধবার প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তরের (ডিজিএফআই) মহাপরিচালক মেজর জেনারেল আকবর হোসেন এরশাদের সঙ্গে তার প্রেসিডেন্ট পার্কের বাসায় দেখা করেছেন। পরেরদিন বৃহস্পতিবারও তিনি সকাল ১১টার দিকে এরশাদের বাসায় যান। সেখানে বেলা সাড়ে ৩টা পর্যন্ত অবস্থান করেন এবং বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে বেরিয়ে যান।
গত মঙ্গলবার এরশাদ নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দেয়ার পর থেকেই আওয়ামী লীগে উদ্বেগ উৎকণ্ঠা আঁচ করা যাচ্ছিল। ঘোষণার কয়েক ঘণ্টা পরেই প্রধানমন্ত্রী তার সরকারি বাসভবন গণভবনে আওয়ামী লীগ এবং নির্বাচনকালীন সরকারে থাকা জাতীয় পার্টির দুই মন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে বসেন। তার আগে আমির হোসেন আমুকে জরুরি তলব করা হয় ঢাকায়। তাড়াহুড়া করে হেলিকপ্টার যোগে নির্বাচনী এলাকা থেকে বৈঠকে অংশ নিতে গণভবনে আসেন তিনি। সেখানে দলীয়ভাবে তাকে এরশাদকে ম্যানেজ করার দায়িত্ব অর্পণ করা হয়।
এ ব্যাপারে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য অ্যাডভোকেট ইউসূফ হোসেন হুমায়ুন বলেন, ‘এরশাদের বিষযটি খুবই ভিতরের বিষয়। তার এ সমস্যা নিয়ে দলীয়ভাবে যোগাযোগ করা হচ্ছে। আশা করি, কালকের (শনিবার) মধ্যেই এ বিষয়ে একটা সমাধান হবে।’
তিনি আরো বলেন, ‘আমাদের কাছে সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচনের বিকল্প নেই। তিনি সংসদীয় গণতন্ত্রের স্বার্থে নির্বাচনে ফিরে আসবেন বলে আমার বিশ্বাস।’
এছাড়া গত বৃহস্পতিবার রাতে ধানমণ্ডিতে আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর রাজনৈতিক কার্যালয়ে ১৪ দলের এক বৈঠক শেষে আমির হোসেন আমু বলেন, ‘এরশাদকে বুঝতে আরও দু’একদিন সময় লাগবে।’
সূত্রে জানা যায়, বৃহস্পতিবার দুপুর ১২টা ২০ মিনিটে পতাকাবিহীন গাড়িতে চেপে রওশন এরশাদ, রুহুল আমিন হাওলাদার ও মুজিবুল হক চুন্নু গণভবনে যান। সেখানে তারা প্রায় এক ঘণ্টা প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করেন। এরশাদের পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রীর কাছে তিনটি দাবি জানান তারা। দাবিগুলো হলো- এরশাদের বিরুদ্ধে থাকা জেনারেল মঞ্জুর হত্যা মামলা ও জনতা টাওয়ার মামলা প্রত্যাহার এবং নির্বাচনের তফসিল পেছানো।
এসময় প্রধানমন্ত্রী মামলার বিষয়ে তার ওপর আস্থা রাখতে বলেন। তবে তফসিল পেছানো কমিশনের এখতিয়ার এ কারণে সে ব্যাপারে তার অপারগতার কথা জানিয়ে দেন।
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে ফিরে জাপার তিন মন্ত্রী এরশাদের সঙ্গে বৈঠক করেন। তারা প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনার বিষয় এরশাদকে অবহিত করেন। এসময় চার মন্ত্রী এরশাদের কাছে পদত্যগপত্র জমা দেন। কিন্তু রওশন এরশাদ, ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ এবং উপদেষ্টা জিয়াউদ্দিন বাবলু এখনো পদত্যাগপত্র দেননি বলে জানা গেছে। আর নেতাদের নিয়ে দফায় দফায় বৈঠক করছেন এরশাদ। তাতে মনে হয়, পর্দার অন্তরালে অনেক কিছুই হচ্ছে।
শুক্রবার সকালে তেমনি ইঙ্গিত দিলেন আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য সুরঞ্জিত সেন গুপ্ত। তিনি বলেন, ‘এরশাদ নির্বাচনে ছিলেন, আগামীতে থাকবেন।’
যাইহোক, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা যদি হয় গণতন্ত্র আর রাজনৈতিক দলগুলোর সংজ্ঞা মতে, গণতন্ত্রের একমাত্র শর্ত যদি হয় নিয়মিত নির্বাচন তাহলে এরশাদের মতো এককালের ‘স্বৈরাচার’ হতে পারেন গণতন্ত্রের ধ্বজাধারী আর যুদ্ধাপরাধী জামায়াতও হতে পারে দেশপ্রেমিক। তাতে স্বাধীনতার পক্ষশক্তির চেতনাও যেমন অক্ষত থাকে তেমনি বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের আদর্শেরও কোনো বিচ্যুতি ঘটে না।
গণতন্ত্রের ধারা অব্যাহত রাখার অঙ্গীকার নিয়ে যারা গলা ফাটান তারাই এখন এরশাদকে নিয়ে যে টানাটানি শুরু করেছেন তাতে তার ‘স্বৈরাচারী’, ‘বিশ্ব বেহায়া’ এসব বিশেষণ অনেক আগেই ঘুচে গেছে। মুখ্য যখন ক্ষমতা তখন সুবিধাবাদী হলে দোষের কী?
অবশেষে বলতে হয়, এরশাদকে নিয়ে যারা হাস্যরস করেন, তাকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করেন তাদের মুখে চুনকালি পড়েছে। যে যাই বলুক, রাজনীতির মাঠে এখন সবচেয়ে দামি খেলোয়াড় হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। তিনি সেটা ভালো করেই বুঝতে পারেন। সুতরাং নির্বাচনী প্রতিযোগিতার বাজারে তিনি সর্বোচ্চ দামে বিক্রি হতে চাইবেন এটাই স্বাভাবিক!