বাংলাভূমি২৪ ডেস্ক ॥ তিনি ছিলেন গরীব পরিবারের সন্তান। সংসারের অভাব-অনটনের কারণে লেখাপড়া করতে পারেননি বেশিদূর। কর্ম জীবনের শুরুতে কাজ করেছেন শ্রমিক হিসেবে। কখনো ছিলেন কুলির সরদার, আবার কখনো স্থানীয় বাজারে সবজি বিক্রি করেছেন। তবে অপরাধ জগতের রাজত্ব আলাদিনের চেরাগ এনে দিয়েছে তার হাতে। তিনি এখন শত কোটি টাকার মালিক। একে একে মালিক হয়েছেন এক ডজন বাড়ির। হয়েছেন ঢাকার ওয়ার্ড কমিশনার। গড়েছেন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানও।
অবশ্য অনেক টাকা আর ক্ষমতা হাতে এলেও সন্ত্রাসের অপবাদ তার পিছু ছাড়েনি। তাই এবার জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে গোছাতে চেয়েছেন সেই দুর্নাম। তবে সাইদুর রহমান ওরফে সহিদ কমিশনারের সে স্বপ্নে এখন চিড় ধরেছে। গত মঙ্গলবার র্যাব গ্রেপ্তার করেছে পুরান ঢাকার এ ‘গডফাদারকে’। সহিদ কমিশনার এখন পুলিশ হেফাজতে পাঁচ দিনের রিমাণ্ডে। র্যাব ও পুলিশের তদন্তে বের হয়ে আসছে তার অতীত জীবনের অনেক অভিযোগের খতিয়ান।
তবে সহিদ কমিশনারের মেয়ে সাহানা আক্তার বলছেন, তার বাবা কুচক্রী মহলের ষড়যন্ত্রের শিকার। নির্বাচনের আগে সহিদ কমিশনারও এই প্রতিবেদকের কাছে দাবি করেন, বেশিরভাগ মামলায়ই তাকে ষড়যন্ত্রমূলকভাবে আসামি করা হয়েছে। এবার নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে সহিদ কমিশনার ‘ক্লিন ইমেজের’ রাজনীতি করতে চেয়েছেন।
পুলিশ ও র্যাবের সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চাঁদাবাজি, জবরদখল, খুন, গুম থেকে শুরু করে সব অপকর্মেরই অভিযোগ আছে সহিদ কমিশনারের বিরুদ্ধে। পুরান ঢাকার সূত্রাপুর, গেণ্ডারিয়া ও শ্যামপুর এলাকার এক সময়ের মূর্তিমান আতঙ্ক ছিলেন তিনি। এলাকায় প্রচলিত আছে- সহিদ কমিশনারের বিদেশে অবস্থান মানেই পুরান ঢাকার কোনো এলাকায় হত্যাকাণ্ড ঘটবে। আদালতে ফাঁসির দণ্ডাদেশ নিয়ে প্রায় সাত বছর জেল খাটার পর মুক্তি পান তিনি। এরপর ছিলেন আত্মগোপনে। কয়েক বছর আগে হঠাৎ করেই প্রকাশ্যে আসেন সহিদ। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ঢাকা-৬ আসন থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে অংশ নিয়ে আবারও আলোচনায় উঠে আসেন সহিদ কমিশনার।
পুলিশের নথিপত্র ঘেটে দেখা গেছে, ঢালকানগরের সেলিম, ভাট্টিখানার মাহবুব, সূত্রাপুরের নাসির, মিল ব্যারাকের বুংগা বাবু, ফরিদাবাদের আনু, পিন্টু, পিন্টুর ভাই সেন্টু, পোস্তগোলার শাহাদাৎ কমিশনার ও তার সহযোগী সুমন, মিলব্যারাকের মাইকেল, ফরিদাবাদ আলমগঞ্জের বাদল এবং কেবি রোডের সেলিম হত্যা মামলার আসামি ছিলেন সহিদ কমিশনার। তার বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মামলার মধ্যে সেন্টু ও শাহাদাৎ হত্যা মামলায় রায় না হলেও উচ্চ আদালতে কার্যক্রম থেমে আছে। কয়েকটি হত্যা মামলায় তিনি জেলও খেটেছেন। বহুল আলোচিত অ্যাডভোকেট হাবিব মণ্ডল হত্যার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে নিম্ন আদালতে তার বিরুদ্ধে ফাঁসির দণ্ডাদেশ হয়েছিল। তবে আইনের ফাঁক-ফোকর দিয়ে উচ্চ আদালতে তিনি ফাঁসির দণ্ডাদেশ থেকে ঠিকই মুক্তি পান।
এক সময়ের ত্রাস
সূত্র জানায়, সহিদ কমিশনারের ছত্রছায়ায় ডাকাত শহীদসহ বেশ কয়েকজন সন্ত্রাসীর উত্থান হয়। বহুল আলোচিত এ জনপ্রতিনিধি এবার গ্রেপ্তারের পর এলাকাবাসীর মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। এলাকার কেউ আছেন স্বস্তিতে। আবার কেউ কেউ নতুন অপরাধের আতঙ্কে ভুগছেন।
গেণ্ডারিয়ার মিলব্যারাক সিএসবি গোডাউনে কুলির কাজ করে কর্মজীবন শুরু করেন সাইদুর রহমান ওরফে শহীদ কমিশনার। পরে স্থানীয় বাজারে সবজি বিক্রি করেন। এরপর মিলব্যারাকে সামান্য বেতনে শ্রমিকের চাকরি নেন। একপর্যায়ে জড়িয়ে পড়েন অপরাধ কর্মকাণ্ডে। চাঁদাবাজি আর দখলদারীত্ব ছিল তার বাহিনীর প্রধান কাজ। ৮০’র দশকে ব্যাংক কলোনিতে ৮৩ নম্বর ওয়ার্ডের কমিশনার প্রার্থী সেলিমকে হত্যার অভিযোগ আছে সহিদের বিরুদ্ধে। কয়েক বছর পলাতক থাকার পর আভির্ভূত হয়ে হামলা চালিয়ে পঙ্গু করেন সন্ত্রাসী কালা বাবুকে। এ মামলায় গ্রেপ্তারের পর জামিনে এসে আরো বেপরোয়া হয়ে ওঠেন তিনি।
সূত্র জানায়, তিনি হত্যাকাণ্ডে ব্যবহার করেছেন কালা জাহাঙ্গীর আর ডাকাত শহীদ থেকে শুরু করে অনেক শীর্ষ সন্ত্রাসীকে। এলাকায় হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় তার বিরুদ্ধে মামলা হলেও অনেক মামলায় তার ভয়ে কেউ সাক্ষী দিতে পারেননি। তার অত্যাচারে অনেকেই এখনো এলাকাছাড়া।
পৈত্রিক সম্পতি বা নিজের কোনো সম্পদ ছিল না সহিদ কমিশনারের। এক সময় ঢালকানগরে তার ভাই আমির একটি জুয়ার বোর্ড চালাতেন। ছিল একটি রিকশার গ্যারেজ। অথচ দখল আর চাঁদাবাজির মাধ্যমে এখন আমিরের ভাই শত কোটি টাকার মালিক। রাজধানীতে তার নিজের নামে রয়েছে ১০টি বাড়ি। আমেরিকায় মেয়ের নামে বাড়ি ও বিভিন্ন ধরনের ব্যবসাও রয়েছে। গেণ্ডারিয়ায় কবরস্থানের জায়গা দখল করে প্লট বানিয়ে নাম দিয়েছেন সহিদ নগর। মিলব্যারাকের পাশে রেল লাইনের জায়গা দখল করে বিক্রি করছেন।
দখলদারিত্ব ছিল তার নিয়ন্ত্রণে
সহিদ কমিশনার কারাগারে আটক থাকাকালে পুরান ঢাকার অপরাধ জগতের পুরো নিয়ন্ত্রণ চলে যায় ডাকাত শহীদের হাতে। র্যাবের বন্দুকযুদ্ধে ডাকাত শহীদ নিহত হওয়ার পর সেখানে হয়েছে কয়েকটি উপদল। সহিদ ককিশনার ও তার সহযোগীরা সব সময়ই দখলদারিত্বে সক্রিয়।
অভিযোগ আছে, গেণ্ডারিয়া রেল স্টেশনের সামনে এক ব্যবসায়ীর বায়নাকৃত সাড়ে ১০ কাঠা সম্পতিসহ ২৫ কাঠা জমি অস্ত্র দেখিয়ে জোর করে দখল করে নেয় সহিদ কমিশনার। এই জায়গা কাঠা প্রতি ৫০ লাখ টাকা করে বিক্রি করে কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। গড়ে তুলেছেন মার্কেটও।
গেণ্ডরিয়ার ডিআইটি প্লটের বাসিন্দারা জানান, ডিআইটি প্লটের পুকুরটি সেখানকার সৌন্দর্য ও পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করছে। তবে সম্প্রতি সহিদ কমিশনার পুকুরটি দখলের পায়তারা করছেন। ইতিমধ্যে সেখানে নিজের নামে সাইনবোর্ডও টানিয়েছেন তিনি। তবে তিনি সব কাজ করেন সহযোগীদের দিয়ে।
স্থানীয় সূত্র জানায়, সহিদ কমিশনারের সহযোগীর মধ্যে সুন্দর শরীফ, ফেন্সি রমজান, হাপু, আসলাম, নাতি রানা ও জুয়েল অন্যতম।
এদিকে র্যাব সূত্র জানায়, স্ত্রী-সন্তানদের ইতোমধ্যেই নিরাপদে যুক্তরাষ্ট্রে পাঠিয়েছেন সহিদ কমিশনার। কিছুদিন আগে দেশত্যাগ করেন তার স্ত্রী ও ছেলে রবিন।
র্যাব-১০ এর অধিনায়ক লে. কর্নেল খন্দকার গোলাম সরোয়ার বাংলামেইলকে বলেন, ‘সহিদ কমিশনারকে অস্ত্রসহ গ্রেপ্তার করার পর তার অপরাধের অনেক ফিরিস্তি পাওয়া যাচ্ছে। তাকে রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদে আরো চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া যেতে পারে।’
র্যাবের এই কর্মকর্তা আরো জানান, সম্প্রতি সহিদ কমিশনার বড় ধরনের নাশকতামূলক কর্মকাণ্ডের পরিকল্পনা করেছিলেন বলে তাদের কাছে তথ্য ছিল।
এমপি হওয়ার খায়েস ছিল তার
গত মঙ্গলবার রাজধানীর গেণ্ডারিয়ার সতীশ সরকার লেনের নিজ বাড়ি থেকে তিনটি বিদেশি পিস্তল, তিনটি ম্যাগাজিন ও ৬২ রাউন্ড গুলিসহ তাকে গ্রেপ্তার করে র্যাব। এ ঘটনায় গেণ্ডারিয়া থানায় দায়েরকৃত অস্ত্র মামলায় বুধবার তাকে আদালতে হাজির করা হয়। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা গেণ্ডারিয়া থানার উপপরিদর্শক (এসআই) আতিকুর রহমান আদালতে আসামির ১০ দিন রিমান্ড চান। আদালত পাঁচ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন।
তদন্ত কর্মকর্তা জানান, অপরাধ কর্মকাণ্ড এবং অস্ত্র নিয়ে নাশকতার ব্যাপারে এ ক’দিন সহিদ কমিশনারকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্র জানায়, অতিসম্প্রতি সহিদ কমিশনার নিজেকে আওয়ামী লীগের লোক পরিচয়ে এলাকায় বিভিন্ন ধরনের ব্যানার প্রদর্শন শুরু করেন। তিনি ঢাকা-৬ আসনে আওয়ামী লীগ থেকে এমপি নির্বাচন করবেন বলেও ঘোষণা দেন। তিনি এবং তার ছেলে রবিন আওয়ামী লীগ থেকে নমিনেশন ফরমও কিনেছেন। এর আগে তিনি বিরোধী দলের ডাকা ৬০ ঘণ্টার হরতালের শেষ দিনে নিজের ক্যাডার বাহিনীর সহস্রাধিক সদস্য নিয়ে গেণ্ডারিয়া এলাকায় মহড়া দিয়ে নিজের উপস্থিতি জানান দেন। তবে অতীত কর্মকাণ্ডের রেকর্ডের কারণে সহিদ কমিশনার আওয়ামী লীগ থেকে মানোনয়ন না পাওয়ায় স্বতন্ত্র প্রার্থী হন। নির্বাচনে পরাজিত হয়েও মন্ত্রীদের ও সরকারকে শুভেচ্ছা জানিয়ে এলাকায় ব্যাপক পোস্টারিং করেছেন তিনি।
র্যাব সূত্র জানায়, দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে গত ১ জানুয়ারি গভীর রাতে সহিদ কমিশনারের বাসা থেকে একটি বিদেশি রিভলবার, একটি পিস্তল, একটি শটগান, পিস্তলের ১২টি ও শটগানের ২৩টি গুলি উদ্ধার করা হয়। এ সময় তার ঘনিষ্ট সহযোগী হাফিজুরসহ গ্রেপ্তার করা হয়।
তাদের বক্তব্য
নির্বাচনের আগে সহযোগী হাফিজুর আটকের পর সহিদ কমিশনার এই প্রতিবেদককে বলেছেন, ‘আমার ইমেজ নষ্ট করতে আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র চলছে। আমি ক্লিন ইমেজের রাজনীতি করতে চাই। আমার বিরুদ্ধে দায়ের করা বেশিরভাগ খুনের মামলাই ভুয়া। কিছু ঘটনার সময় আমি দেশের বাইরে ছিলাম। কারাগারে ছিলাম।’
এদিকে গত শুক্রবার সাইদুর রহমান সহিদ কমিশনারের মেয়ে সাহানা আক্তার গণমাধ্যমে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলেন, ‘আমার বাবা সাইদুর রহমান সহিদ (দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ঢাকা-৬ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী)। নির্বাচনী প্রচারণার প্রথম দিক থেকেই তাকে নির্বাচন থেকে সরে যাওয়ার জন্য কুচক্রী মহলের সহযোগিতায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা ভয়ভীতি প্রদর্শন ও মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে হয়রানি ও নির্যাতনের হুমকি দিয়ে আসছিল। গত ২৮ ডিসেম্বর সকালে আমার পিতার নির্বাচনী প্রচারণার অফিস থেকে আমার আপন ফুফাতো ভাই জুয়েল ও অফিস স্টাফ লিখনকে কোনো সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ছাড়াই র্যাব সদস্যরা গ্রেপ্তার করে। পরে আবার র্যাব সদস্যরা গেণ্ডারিয়ার আমাদের বাড়িতে হানা দিয়ে আমার পিতার বাল্য বন্ধু হাফিজুর রহমান হাপুকে বৈধ লাইসেন্সকৃত অস্ত্রসহ আটক করে। পরে অবৈধ অস্ত্রসহ আটকের নাটক সাজায়।’
সাহানা আরো বলেন, ‘আমার পিতা সাইদুর রহমান সহিদকে র্যাব গত ১ ফেব্রুয়ারি দিবাগত রাত সাড়ে ৩টায় বৈধ লাইসেন্সকৃত অস্ত্রসহ আটক করে এবং পরে র্যাব সদস্যদের কাছে থাকা অস্ত্র দিয়েই তাকে অবৈধ অস্ত্রসহ আটকের নাটক সাজিয়ে অস্ত্র মামলা দায়েরের প্রচারণা চালায়। ওই রাতে র্যাব সদস্যরা দরজা-জানালা ভেঙে কমান্ডো স্টাইলে আমাদের বাড়িতে হানা দিয়েছিল। আমার পিতা সব সময় আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল এবং সাবেক ৮৩নম্বর ওয়ার্ডে ২৫ বছরের সফল কমিশনার ও রাষ্ট্রীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত। সে সব সময়ে সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজ, মাদকব্যবসা ও অনৈতিক কার্যকলাপের বিরুদ্ধে।’ বাংলামেইল২৪ডটকম