রবিবার , ২২শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ , ৭ই আশ্বিন, ১৪৩১ , ১৮ই রবিউল আউয়াল, ১৪৪৬

হোম > লাইফস্টাইল > এক চুমুকেই চনমনে ভাব

এক চুমুকেই চনমনে ভাব

শেয়ার করুন

লাইফস্টাইল ডেস্ব ॥ হাজার পাঁচেক বছর আগে চীনের সম্রাট শেন নুংয়ের পানি গরম করার পাত্রে গাছ থেকে একটি পাতা ঝরে পড়েছিল! ভাগ্যিস তিনি টের পেয়েছিলেন, পাতাটি পানিরঅভ্যস্ততা থেকে আমাদের এখানেও গড়ে উঠেছে চা পানের সংস্কৃতি স্বাদই শুধু বাড়ায়নি, শরীরকে চাঙাওকরেছে।ব্যবসার কারণে এ গাছটিকে ব্রিটিশরা এই উপমহাদেশে নিয়ে এসেছিল! না হলে অপূর্ব এক পানীয় থেকে যে বঞ্চিত হতাম আমরা!

এক কাপ চা না হলে সকালটাই শুরু করতে পারেন না অনেকে। পত্রিকার সঙ্গে ধোঁয়া ওঠা চায়ের কাপটা লাগবেই। সকালে একবার, অফিসে এসে একবার—এরপর কাজের শুরু। শুধু সকাল কেন, অফিসে কাজ করতে করতে বা বিকেলে অফিস থেকে ফিরে সন্ধ্যার আড্ডা অথবা আয়েশ করে টিভি দেখা—সেটাও কি চা ছাড়া চলে? বাংলাদেশের কোথায় চা নেই। শহরের মোড়ে মোড়ে, পাড়ার দোকানে, মহাসড়কের পাশে, গঞ্জে এমনকি গণ্ড গ্রামে আর কিছু না মিললেও, মিলবে চায়ের দোকান। শীত এসে গেছে, এখন চোখে পড়বে মাফলার জড়ানো মুখগুলো, দুই হাতে চায়ের কাপ ধরে উষ্ণতা নিচ্ছেন আর চা পান করছেন। কারা চা পান করেন? শ্রেণী বা পেশা—এসব দিয়ে ভাগাভাগি করা যাবে না। শহর বা গ্রাম-গঞ্জের লোক, ধনী-দরিদ্র, শিক্ষিত-অশিক্ষিত—সবাই। পানি ছাড়া জীবন চলে না। এরপরই আজকের দুনিয়ার মানুষ সবচেয়ে বেশি যে পানীয় পান করেন, তার নাম চা। গরম বা ঠান্ডা—সবভাবেই। দুনিয়ার সবচেয়ে গণতান্ত্রিক এক পানীয়!

কোনো খাদ্যাভ্যাস যখন প্রাত্যহিক হয়ে ওঠে, জীবনযাপনের অংশ হয়ে ওঠে, তখন একে কেন্দ্র করে সংস্কৃতিও গড়ে ওঠে। চীন বা জাপানের মতো দেশে চায়ের যে সংস্কৃতি কয়েক হাজার বছর ধরে গড়ে উঠেছে, সে তুলনায় আমাদের চা পান সংস্কৃতি হয়তো খুবই নতুন। আমাদের দেশে হয়তো নোবেল বিজয়ী জাপানি সাহিত্যিক য়াসুনারি কাওয়াবাতার মতো চা পানের আনুষ্ঠানিকতা নিয়ে হাজার সারস-এর মতো কোনো উপন্যাস লেখা হয়নি। কিন্তু এ দেশেও নিজেদের মতো করে এক চা পানের সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে। নানা ধরনের চায়ের স্বাদ নেওয়া, চা তৈরি বা পরিবেশন—সবকিছু মিলিয়েই চা সংস্কৃতি।

মানুষের রুচির ফারাকের শেষ নেই, চায়ের পদ আর বানানোর পদ্ধতির ইয়ত্তা নেই। কারও পছন্দ কড়া চা, কারও হালকা লিকার। দুধ-চিনি ছাড়া চা অনেকের মুখেই লাগে না। কারও একেবারে মালাই ধরনের চা। কেউ সঙ্গে মেশান আদা, কেউ দারুচিনি থেকে লবঙ্গ-এলাচ—সবই। দুনিয়ায় চায়ের পদও অনেক। কালো, লাল, সবুজ, হলুদ এমনকি সাদা চা-ও। চায়ের সাধারণ গুণাগুণ কমবেশি সব চায়েই মিলবে।

বাংলাদেশেও এখন নানা পদের চা মিলছে। দেশি কোম্পানিগুলোও চায়ে বৈচিত্র্য এনেছে, আনছে। সুপার স্টোরগুলোর র্যাক এখন দেশি-বিদেশি নানা পদের চায়ে ঠাসা। মিলবে ভেষজ চা-ও, তুলসী থেকে জিংসেন—সবই। বানানোরও নানা তরিকা। নামী-দামি কোম্পানিগুলোর প্যাকেটে চায়ের সঙ্গে বাড়তি কোনো কিছু যোগ করা হয়েছে কি না, তার যেমন উল্লেখ থাকে; তেমনি সেরা স্বাদটি পেতে গেলে কীভাবে বানাতে হবে, তার বর্ণনাও থাকে। পানি, তাপ, কতক্ষণ ফোটাবেন—এসব। যাঁরা এত দিন এতে মন দেননি, তাঁরা এখন আগ্রহ নিয়ে দেখতে পারেন। অভ্যস্ততা থেকে আমাদের এখানেও গড়ে উঠেছে চা পানের সংস্কৃতি

চা পানীয় হিসেবে স্বাস্থ্যকর, মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বেড়েছে, এর চেয়েও বড় কথা, চা পানে অভ্যস্ততা—সব মিলিয়েই চায়ের ব্যাপারে আমাদের দেশের মানুষের আগ্রহ বেড়েছে, বাড়ছে। বাংলাদেশ চা বোর্ডের (বিটিবি) তথ্যে এর প্রমাণ মেলে। ২০০১ সালে বাংলাদেশে জনপ্রতি চায়ের যে চাহিদা ছিল ২০১৩ সালে এসে তা ৩০ শতাংশ বেড়েছে। তবে চা উৎ পাদনে এখনো তেমন বৈচিত্র্য নেই।

বাংলাদেশে মূলত দুই ধরনের চা উৎ পাদিত হয়—ব্ল্যাক ও গ্রিন টি। এখন কিছু প্রতিষ্ঠান এর সঙ্গে অন্যান্য ভেষজ ও ফ্লেভার মিশিয়ে বৈচিত্র্য আনার চেষ্টা করছে। জানান ফিনলের সহকারী ব্যবস্থাপক ওমর ফারুক।

আমাদের জীবনযাপন, প্রাত্যহিকতা—এসবের সঙ্গে চা এখন মিলেমিশে একাকার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যাঁরা পড়েছেন, তাঁদের মধ্যে এমন কাউকে কি খুঁজে পাওয়া যাবে, যিনি কখনো হাকিম চত্বরে গিয়ে চা পান করেননি! ক্যাফে কালচার জোরালো হচ্ছে দেশে, সেখানেও তো নানা পদের চা নিয়েই বসছেন তরুণ-তরুণীরা। রাতে বাসায় ডিনার সেরে শুধু চা পান করতেই অনেকে যাচ্ছেন কোনো ক্যাফেতে, বন্ধুদের সঙ্গে মিলছেন আড্ডায়। উপলক্ষ চা, কিন্তু বাসা থেকে একটু বের হওয়াও হলো, আড্ডাও হলো।

যে পানীয় আমাদের সংস্কৃতির অংশ হয়ে গেছে, তা কীভাবে পান করছি বা পরিবেশনা কি গুরুত্বহীন থাকতে পারে! অফিসে যে চায়ের কাপ বা মগটি ব্যবহার করছি, সেটা নিয়েও কি আমরা বেশ সচেতন নই? বাসায় দুজন বসে যখন চা পান করছেন, তখন যে টি-সেটটি ব্যবহার করছেন, সেটাও তো চিন্তাভাবনা করে আর রুচির সঙ্গে মিলিয়েই কেনা। অতিথি এসেছে তো চা পরিবেশন হচ্ছে বাহারি কাপে, কেটলি, চিনি বা দুধের পট—এসবে রুচির কতই না বৈচিত্র্য!

চা প্রাত্যহিক। কিন্তু বিশেষ বলে কি কিছু নেই? মনে করে দেখুন, কোথায় কোনো একসময় বেড়াতে গিয়েছিলেন বা বিশেষ কেউ সঙ্গে ছিল; হতে পারে আমাদের বান্দরবান, কক্সবাজার বা শ্রীমঙ্গলে অথবা নাগরকোট, দার্জিলিং বা আরও দূরে অন্য কোথাও—সূর্যোদয় বা সূর্যাস্তের সময় চা পান করার কোনো না কোনো স্মৃতি নিশ্চয় আপনার কাছে বিশেষ হয়েই আছে!