স্টাফ রিপোর্টার ॥ ৪৯ সদস্যের মন্ত্রিসভা নিয়ে গঠিত হলো নতুন সরকার। তবে নির্বাচন ও সরকার গঠন নিয়ে আপত্তি থেকে গেছে দেশি-বিদেশি উন্নয়ন ও দাতা সংস্থাগুলোর মধ্যে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে অনেক এগিয়েছে। তবে অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির ধারা অব্যাহত রাখতে বহির্বিশ্বের সঙ্গে সুসম্পর্ক রক্ষা করা গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু নির্বাচন ও সরকার গঠন নিয়ে বিদেশিদের মধ্যে যে অনাস্থা দেখা দিয়েছে তাতে করে উন্নয়ন সহযোগীদের ধরে রাখাই এই সরকারের বড় চ্যালেঞ্জ হবে।
নির্বচনকে কেন্দ্র করে গত এক বছর থেকেই রাজনীতির মাঠ ছিল অস্থিতিশীল। তাছাড়া বিদেশি সাহায্যে গৃহীত বেশ কিছু বড় বড় প্রকল্প যেমন: পদ্মাসেতু প্রকল্প থেকে বিদেশি সব দাতা সরে দাঁড়ানোর কারণে আগে থেকেই বিদেশি সহযোগিতা কমে গেছে। স্বাধীনতার ৪৩ বছরে অর্থনৈতিকভাবে অনেক এগিয়েছে বাংলাদেশ। তবে বড় বড় প্রকল্পগুলো বস্তবায়নের জন্য এখনো বিদেশি দাতাসংস্থার ওপর নির্ভর করতে হয়। তাছাড়া অর্থনীতির সবচেয়ে বড় দুই খাত রেমিট্যান্স (প্রবাসী আয়) ও তৈরি পোশাক দুই ক্ষেত্রই বহির্বিশ্বের সঙ্গে ওতোপ্রতোভাবে জড়িত। তাই উন্নয়নের জন্য এ সম্পর্ক ধরে রাখা অপরিহার্য।
ইআরডি সূত্র জানিয়েছে, ইতোমধ্যে ব্রিটিশ সরকার বলেছে, চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও একতরফা নির্বাচন করার কারণে তারা বাংলাদেশে চলমান কয়েকটি প্রকল্পে অর্থায়ন কমিয়ে দেবে। শুধু ব্রিটিশ সরকার নয়, বিশ্বব্যাংক ও আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিলের (আইএমএফ) মতো বড় উন্নয়ন সহযোগীরা নতুন সরকারের সঙ্গে ‘সংযুক্তি’ কমিয়ে আনতে পারে বলে শঙ্কা ব্যক্ত করেছে ওই সূত্রগুলো।
তাদের বক্তব্য- বিশেষ করে বিশ্বব্যাংক যদি সহায়তা কমিয়ে দেয় তবে তা হবে বাংলাদেশের জন্য মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ। ইতোমধ্যে পদ্মাসেতু দুর্নীতি বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে সরকারের বছরখানেক ধরে সম্পর্কের টানাপোড়েন চলছে। এখন এটি আরো বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
১৮ দলীয় জোট সব ধরনের কর্মসূচি স্থগিত করছে। তবে আগামীকাল বুধবার বিকেল ৪টায় রাজধানীর হোটেলে ওয়েস্টিনের বলরুমে সংবাদ সম্মেলন করে পরর্বতী র্কমসূচি ঘোষণা করার কথা রয়েছে খালেদা জিয়ার। তাই দেশের সুশীল সমাজ ও বিদেশিরাও ১৮ দলকে আলোচনায় এনে সবার অংশগ্রহণের নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য দ্রুত মধ্যবর্তী সরকার গঠনের তাগিদ দিয়ে আসছে।
৫ জানুয়ারির পর গত কয়েক দিনে জাতিসংঘ ছাড়াও দুই আন্তর্জাতিক সংগঠন ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) ও কমনওয়েলথ, গুরুত্বপূর্ণ দেশগুলোর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জাপান, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া ও দক্ষিণ কোরিয়া, মানবাধিকার সংগঠনগুলোর মধ্যে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ এবং এশিয়ান হিউম্যান রাইটস ওয়াচের বক্তব্য-বিবৃতিতে এই নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছে। একই সঙ্গে তারা ১৮ দলীয় জোটের সঙ্গে আলোচনা করে একটা সমঝোতায় আসতে বলেছে।
এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, চলতি ২০১৩-১৪ অর্থবছরের ৪ মাসে (জুলাই-অক্টোবর) বাজেট অর্থায়নে বিদেশি সাহায্য ব্যবহার করা সম্ভব হয়েছে ৮৫২ কোটি ৩২ লাখ টাকা। যেখানে গত অর্থবছরে (২০১২-১৩) একই সময়ে বাজেট অর্থায়নে বিদেশি সহায়তা পাওয়া গিয়েছিল ৪ হাজার ৫৩১ কোটি ২২ লাখ টাকা। এবার তা কমে গেছে ৪৩২ শতাংশ। টাকার অংকে যার পরিমাণ ৩ হাজার ৬৭৮ কোটি ৯০ লাখ টাকা।
এখানেই শেষ নয়, চলতি অর্থবছরে বিদেশি সাহায্য ছাড়ও আশঙ্কাজনকভাবে হ্রাস পেতে শুরু করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যানে দেখা যায়, জুলাই-অক্টোবর (২০১৩-১৪) বিদেশি সাহায্য অবমুক্তি বা ছাড় কমেছে ৩১ শতাংশ। গত অর্থবছরে এ সময়ে বিদেশি সাহায্য ছাড় হয়েছিল যেখানে ৮০ কোটি ৯৬ লাখ ডলার সেখানে একই সময়ে এবার ছাড় হয়েছে ৫৫ কোটি ৬৮ লাখ ডলার। আগামী মাসগুলোতে তা আরো কমে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
অর্থনীতিবিদরা বলেন, আগামী অর্থবছরের নতুন বাজেট প্রণয়ন করতে সরকারকে হিমশিম খেতে হবে। আর যেভাবে বিদেশি সহায়তা কমে আসছে তাতে প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী বিদেশি সহায়তা না পাওয়া গেলে সবচেয়ে বড় হোঁচট খাবে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাস্তবায়ন।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত নির্বাচন নিয়ে হয়তো আইনি কোনো ঝামেলা নেই তবে রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান হয়নি বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে। নির্বাচন পরবর্তী সময়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে সহিংসতা চলছ। তাই সমাজে একটা অস্থিরতা রিরাজ করছে। এরকম অস্থিরতা বিদ্যমান থাকলে দেশের উদ্যোক্তারা বিনিয়োগ করবে না। আরা বিদেশিরা ইতোমধ্যে বাংলাদেশ সম্পর্কে নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি দেখাতে শুরু করেছে। এ দৃষ্টিভঙ্গি আরো তীব্রতর হবে। একই সঙ্গে বিদেশি উন্নয়ন ও দাতা সংস্থাগুলো হাত গুটিয়ে নেবে। অর্থাৎ অর্থনৈতিকভাবে দেশে একটা দীর্ঘমেয়াদি সঙ্কট দেখা দেবে।’
তিনি আরো বলেন, ‘নির্বাচনের পর যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন যে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে তাতে মনে হচ্ছে, এর একটি প্রভাব আমাদের রপ্তানি খাত ও বিদেশি সাহায্যের ওপর পড়বে। পরিস্থিতির যদি দ্রুত উন্নতি করা সম্ভব না হয় তবে এসব দেশ থেকে সহায়তাপ্রাপ্তিতে অসুবিধা হতে পারে।’
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিপিডির নির্বাহী পরিচালক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘আমাদের দেশ গত কয়েকবছর ধরে বেশ কিছু বড় প্রকল্প যেমন: পদ্মাসেতু, মেট্রোরেল, ঢাকা-চট্টগ্রাম চার লেন রাস্তা এগুলোর ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখতে হবে। তার জন্য প্রয়োজন স্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিবেশ।’