আসিফ নজরুল ॥
ফরহাদ মজহারকে অবশেষে উদ্ধার করা গেছে। পুলিশ যখন তাঁকে হেফাজতে নেয়, ততক্ষণে অপহরণকারীরা তাঁকে ছেড়ে দিয়েছিল। খুলনা থেকে ঢাকাগামী বাসে ফিরছিলেন তিনি। পুলিশ অবশ্য এর আগেই তাঁকে উদ্ধারের কর্মতৎপরতা শুরু করেছিল। তাঁকে যেন সীমান্তের অন্য পাশে নিয়ে যাওয়া না হয়, তা নিয়েও কড়া নজরদারি শুরু হয়েছিল। নাহলে অন্য অনেক নিখোঁজ হয়ে যাওয়া মানুষের মতো খারাপ পরিণতি তাঁর হতে পারত। বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এমন আশঙ্কাও ব্যক্ত করেছেন যে অপহরণকারীরা সীমান্ত পার করেও তাঁকে নিয়ে যেতে পারত। তিনি বলেছেন, তখন পরিস্থিতি কতটা ভয়াবহ হতো, তা তাঁদেরও ভাবিয়ে তুলেছিল।
এসব থেকে বোঝা যায়, সরকারের চেষ্টা ছিল এ পরিস্থিতি না হতে দেওয়ার। সরকারকে আমরা এ জন্য ধন্যবাদ দিতে পারি। সরকার তৎপর না হলে ফরহাদ মজহার রেহাই পেতেন না—এটাও বলা যেতে পারে। কিন্তু তাই বলে সরকারের কর্তব্য এখানেই শেষ হয়ে যায় না। সরকারকে খুঁজে বের করতে হবে কারা তাঁকে অপহরণ করে নিয়ে গিয়েছিল। এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজাই সবচেয়ে জরুরি এখন।
ফরহাদ মজহারের আগে আরও কয়েক শ মানুষ অপহৃত বা গুম হয়েছেন। তাঁদের সিংহভাগের কোনো হদিস এখনো পাওয়া যায়নি। বাকিদের কেউ কেউ লাশ হয়ে ফিরেছেন, কাউকে কাউকে পরে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে, কেউ কেউ কয়েক দিন থেকে কয়েক সপ্তাহ পরে বিপর্যস্ত অবস্থায় ফিরে এসেছেন। গ্রেপ্তার দেখানো মানুষদের পুলিশই ধরে নিয়ে গিয়েছিল, তা আন্দাজ করা যেতে পারে। কিন্তু অন্যদের কারা তুলে নিয়ে গিয়েছিল, আজ পর্যন্ত এই প্রশ্নের কোনো সদুত্তর সরকার দিতে পারেনি।
ফরহাদ মজহারের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটবে না, তা বলা যায় না। তাঁকে উদ্ধার করার পর থানায় নিয়ে দীর্ঘ সময় রাখা হয়। সেখান থেকে সরাসরি আদালতে নিয়ে জবানবন্দি নেওয়া হয়। তারপর তাঁরই জিম্মায় তাঁকে মুক্তি দেওয়া হয়। তাঁকে সরকার ভিকটিম হিসেবে উল্লেখ করেছে। একজন ভিকটিমকে তাঁর আইনজীবীর সঙ্গে পরামর্শ না করতে দেওয়া আইনসম্মত নয়।
ফরহাদ মজহার এ পর্যন্ত যা বক্তব্য দিয়েছেন বলে প্রচার করা হচ্ছে—তা কতটা স্বাধীনভাবে তিনি দিয়েছেন, তা নিয়ে তাই প্রশ্ন তোলা যায়। তিনি আদালতে অপহরণের ঘটনার জন্য সরকারকে দায়ী করেননি। সরকারকে বিব্রত করার জন্য কেউ এ ঘটনা ঘটিয়েছে বলে তাঁর আশঙ্কা। সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীও বলেছেন ঘটনার কোনো পর্যায়ে ফরহাদ মজহারের কোনো দোষ তাঁরা এখনো খুঁজে পাননি। দুই পক্ষের চূড়ান্ত বা প্রকৃত বক্তব্য যদি এটি হয়, তাহলে বলা যায় যে তাঁরা অপহরণের জন্য তৃতীয় কোনো পক্ষকে ইঙ্গিত করছেন।
এই পক্ষটি কে তা খুঁজে বের করার দায়িত্ব সম্পূর্ণভাবে সরকারের। একমাত্র সরকারের।
২.
ইতিপূর্বে গুম হয়ে থাকা বহু মানুষের পরিবার এবং কিছু ক্ষেত্রে গুমের ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীরা এ জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে অভিযুক্ত করেছেন। কিন্তু অপহরণ বা গুম থেকে ফিরে আসা মানুষেরা এ নিয়ে কোনো উচ্চবাচ্য করেননি, কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ করার সাহস পর্যন্ত পাননি। তাঁদের পরিবার স্বজনকে ফিরে পাওয়াতেই তুষ্ট থেকেছে বা এ নিয়ে পরে সম্পূর্ণভাবে নীরব থেকেছে।
ফরহাদ মজহার অপহৃত অবস্থা থেকে ফিরে আসা একজন মানুষ। অপহরণের পর ফরহাদ মজহার মারধরের শিকার হয়েছেন। তাঁর চোখ বেঁধে রাখা হয়েছিল, তিনি মৃত্যুর আশঙ্কাও প্রকাশ করেছিলেন পরিবারের কাছে। হয়তো অন্য ফিরে আসা মানুষের মতোই তিনি তাঁর অপহরণ বা গুমের চেষ্টার বিষয়ে নতুন কোনো কথা বলবেন না। এমনকি এর বিচারও হয়তো আর চাইবেন না। কিন্তু এতে সরকারের দায়িত্ব শেষ হয়ে যাবে না।
কোনো অপরাধ ঘটলে তার জন্য দায়ী ব্যক্তিকে খুঁজে গ্রেপ্তার করা যেকোনো সরকারের মৌলিক দায়িত্ব। এই দায়িত্ব সাধারণত তাঁরাই পালন করেন না, যাঁরা নিজেরাই এসব অপরাধের জন্য দায়ী বা যাঁরা অপরাধীর সঙ্গে কোনো না কোনোভাবে স্বার্থের সম্পর্কে বাঁধা রয়েছেন। আমাদের দেশে সরকারের বিরুদ্ধে গুমের অভিযোগের দীর্ঘ কালিমা রয়েছে। গুম ও অপহরণের জন্য দায়ী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করতে পারলেই কেবল এ কালিমা দূর হবে। কারও বাক্চাতুর্য বা কোনো ভয়-ভীতি দেখানোর মধ্য দিয়ে নয়।
ফরহাদ মজহারের অপহরণের ঘটনার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের গ্রেপ্তার করে আইনের হাতে সোপর্দ করতে হবে। ফরহাদ মজহারের ফোন ট্র্যাক করে, তাঁকে তুলে নিয়ে যাওয়া মাইক্রোবাস থেকে ফরেনসিক আলামত গ্রহণ করে, প্রত্যক্ষদর্শী মানুষের সাক্ষাৎকার নিয়ে এটি করার সামর্থ্য অবশ্যই সরকারের আছে বলে আমরা বিশ্বাস করি।
ফরহাদ মজহারের ঘটনার পর সরকারের আরেকটি দায়িত্ব বেড়েছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, জনাব মজহারকে সীমান্ত পার করে দেওয়ার আশঙ্কা ছিল। ইতিপূর্বে আমার অন্তত একটি ঘটনায় নিখোঁজ হওয়া ব্যক্তিকে (বিএনপির নেতা সালাউদ্দিন) সীমান্ত পার করে ভারতে নিয়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটতে দেখেছি। এসব ঘটনা এই ইঙ্গিতই প্রদান করে যে ভিন্নমতাবলম্বী কাউকে বাংলাদেশ থেকে অপহরণ করে সীমান্ত পার করে ভারতে নিয়ে যাওয়ার মতো ইচ্ছে বা সামর্থ্য কোনো একটি মহলের রয়েছে। সরকারকে অবশ্যই খুঁজে বের করতে হবে এই শক্তি কারা এবং কেন তারা অপহৃত ব্যক্তিদের সীমান্ত পার করে দেওয়ার চেষ্টা করে থাকে।
তর্কের খাতিরে এ–ও বলে রাখি, ভিন্নমতাবলম্বী কেউ গুম নাটক সাজিয়ে পাসপোর্ট-ভিসা ছাড়া নিজে নিজেই সীমান্ত পার হতে পারেন। যদি এটি হয়ও, দুই দেশের সীমান্তরক্ষীরা কেন তা প্রতিরোধ করতে পারে না, তা–ও সরকারকে খুঁজে বের করতে হবে।
ভারত আমাদের বন্ধুরাষ্ট্র হিসেবে পরিচিত। ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের স্বার্থে হলেও এ বিষয়ে সরকারকে নজর দিতে হবে। এসব বিষয়ে প্রকৃত তথ্য জনগণকে জানাতে হবে।
৩.
এবার ফরহাদ মজহারের অপহরণ ঘটনার অন্য কিছু দিক নিয়ে বলি। গুম নিয়ে এই সমাজে বহু অস্বস্তি আগে থেকেই ছিল। তারপরও গুম বিষয়ে আন্দাজ করার মতো কিছু বিষয় ছিল। যেমন গুম হতেন সাধারণত সরকারবিরোধী রাজনীতিকেরা। আরও নির্দিষ্টভাবে বললে, রাজপথে আন্দোলনের উত্তাপ ছড়াতে পারেন এমন রাজনীতিকেরা। কিন্তু ফরহাদ মজহারের মতো একজন বর্ষীয়ান এবং বিভিন্নভাবে খ্যাতিমান ব্যক্তি হঠাৎ উধাও, অপহৃত বা গুম হয়ে যেতে পারেন, এটি বোধ হয় কারও কল্পনার মধ্যেও ছিল না।
ফরহাদ মজহার কোনো রাজনীতিক নন, রাজপথে আন্দালন করে সরকারকে বিপাকে ফেলে দেওয়ার মতো পরিস্থিতিও এখন নেই। তিনি ভিন্নমতের মানুষ। গুম-ক্রসফায়ার, ৫ জানুয়ারির নির্বাচন, ধর্মভিত্তিক রাজনীতির প্রতি সরকারের মনোভাব, ভারতনীতিসহ কিছু বিষয়ে সরকারের কঠোর সমালোচক। এসব বিষয়ে এ দেশের বাম-ডান-মধ্যপন্থী বহু মানুষ সরকারের কঠোর সমালোচনা করে থাকেন। ফরহাদ মজহারকে অপহরণ করে তাঁর মৃত্যু বা গুমের যে শঙ্কা সৃষ্টি করা হয়েছিল, তাতে হয়তো বহুদিনের জন্য তিনি বাক্রুদ্ধ হয়ে থাকবেন। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, অন্য ভিন্নমতাবলম্বী মানুষের জন্য এই অপহরণ কী বার্তা বহন করে?
ফরহাদ মজহারকে অপহরণের ঘটনায় আরও একটি ভয়াবহ বার্তা রয়েছে। সেটি হচ্ছে, একশ্রেণির মানবাধিকার কর্মী ও নাগরিক সমাজের দৈন্য। ফরহাদ মজহার নানা সময়ে বিতর্কিত কথা বলেছেন। তাঁর বক্তব্যকে উসকানিমূলক, এমনকি নৈরাজ্যকরও মনে হতে পারে কারও কারও কাছে। তাঁর বিরোধিতা করার বা এমনকি বিচার চাওয়ার অধিকারও যে কারও রয়েছে। কিন্তু তিনি বা অন্য কেউ গুম হয়ে যাবেন, এটি মেনে নেওয়ার মানসিকতা কোনো সুস্থ মানুষের থাকতে পারে না।
চরম নৈরাজ্যকর একজন ব্যক্তি, এমনকি একজন সিরিয়াল কিলারেরও রয়েছে সুষ্ঠু বিচার পাওয়ার অধিকার। এই সামান্য বোধটুকু থাকলে এ দেশের সব মানবাধিকার কর্মী ও সংগঠন তাঁর অপহরণ ঘটনার পর উদ্বেগ প্রকাশ করতে পারতেন। তাঁকে উদ্ধারের পরও এ ঘটনায় সরকারের ভূমিকা ও দায়দায়িত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারতেন। কিন্তু তাঁদের অনেকে তা করতে অতীতের কিছু ঘটনার মতো এবারও ব্যর্থ হয়েছেন।
সমাজের অন্য সব ক্ষেত্রে চরমভাবে বিভাজিত মানুষ থাকতে পারে। কেউ গুম হলেও তাঁরা নিরুদ্বিগ্ন, এমনকি পৈশাচিকভাবে আনন্দিত হতে পারেন। তাঁর সম্পর্কে নানা সত্য-মিথ্যা অভিযোগ করে তাঁর গুমকে জাস্টিফাই করার চেষ্টাও করতে পারেন। এ রকম বিকৃত চিন্তার মানুষ সমাজে থাকতে পারে। কিন্তু মানবাধিকার কর্মী হিসেবে যাঁরা নিজেদের পরিচয় দেন, মানবাধিকার রক্ষার কথা বলে যাঁরা দেশ-বিদেশ থেকে কোটি কোটি টাকা গ্রহণ করেন, তাঁদের দায়িত্ব হচ্ছে কারও মানবাধিকার ক্ষুণ্ন হলে বা এর আশঙ্কা দেখা দিলে তার প্রতিবাদ করা।
এই দায়িত্ববোধ সমাজ থেকে বিলীন হয়ে গেলে যেকোনো সরকারের জন্য বেপরোয়া আচরণ করা সহজ হয়ে যায়। দেশি-বিদেশি নানা চক্রান্ত সমাজে দানা বাঁধতে পারে। সমাজে যে কেউ একসময়ে বা অন্য সময়ে অনিরাপদ হয়ে যেতে পারে।
এটি আমাদের সবাইকে বুঝতে হবে। সবচেয়ে বেশি বুঝতে হবে মানবাধিকার ও আইনের শাসন নিয়ে কাজ করা মানুষের। না হলে গুম, অপহরণ, খুনের ভয়াবহ আতঙ্ক এ সমাজে আরও দানা বাঁধতে থাকবে।
আসিফ নজরুল: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। প্রথম আলো