শনিবার , ২১শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ , ৬ই আশ্বিন, ১৪৩১ , ১৭ই রবিউল আউয়াল, ১৪৪৬

হোম > গ্যালারীর খবর > ইট ভাটার শিশু শ্রমিক

ইট ভাটার শিশু শ্রমিক

শেয়ার করুন

বাংলাভূমি২৪ ডেস্ক ॥ ‘ঝুঁকিপূর্ণ কাম বুঝি না; বুঝি পেটের ক্ষিদা। আমাগো বাচ্চাগো ইটেরই স্কুলে ভর্তি করাইছি। সকাল বিকাল অরা ইটের ভাটায় কাম করলে স্কুলে যাইবো কোন বেলা? আমাগো বাচ্চারাই স্কুলে গেলে প্যাটে ভাত যাইবো না’।

কথাগুলো বলছিলেন, শিশু শ্রমিক মিলন ও মোহনের মা মীনা বেগম। মিলন মিয়ার বয়স দশ, আর মোহন মিয়ার সাত। মা মীনা বেগম তার দুই শিশুপুত্রকে নিয়ে কাজ করেন ‘বি আর বি’ ইটভাটায়। তাদের কোন কর্মঘণ্টা করা নেই। সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত কাজ করে ইটভাটার শিশু শ্রমিকরা। সারাদিনে মিলন ও মোহন ইট টানার কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করে। শিশু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দীর্ঘ সময় শিশুরা এ ধরনের ভারি কাজ করলে বাধাগ্রস্ত হবে তাদের বেড়েওঠা, সেইসঙ্গে মারাত্মক কিছু রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশংকা থাকে।

রাজধানী থেকে ১০ কিলোমিটার দূরে কাঁচপুর ব্রিজ। সেখান থেকে আধা কিলোমিটার দক্ষিণে শ্রীরামপুর এলাকা। ওই এলাকায় অবস্থিত বিআরবি ইটভাটা। সেখানে এক সকালে কথা হয় এই মা ও সব শিশুদের স্কুলে যাওয়ার কোন সুযোগ নেই; নেই খেলাধুলা কিংবা অন্যকোন বিনোদনের সুযোগ। ইট টানাই যেন তাদের বিনোদন। যে শিশু যতবেশি ইট টানতে পারে সে তত বেশি বাহ্বা পায়। আর এই প্রশংসার জন্য তারা অতিকষ্টে পাল্লা দিয়ে করতে থাকে ইট টানার কাজ। শত শত শিশু ৮ থেকে ১০টি ইট মাথায় তুলে নিয়ে যায়। এই ইটভাটার কাজ করে ছয় বছর থেকে প্রায় সববয়সী শিশু। মজুরি তাদের যত্সামান্য। কোন কর্মঘণ্টা নির্ধারণ করা নেই। সূর্যোদয়ের আগেই তারা কাজ শুরু করে। সকালে নাশ্তা করার জন্য পায় এক ঘণ্টা বিরতি। এরপর আবার চলতে থাকে তাদের কাজ। দুপুরে পায় দেড়ঘণ্টা বিরতি। এভাবে দিনের আলো যতক্ষণ থাকে ততক্ষণ পর্যন্ত চলে তাদের কাজ। এমনি করে দিনে ১১ থেকে ১২ ঘণ্টা তারা ইট টানার কাজ করে।

দশ বছর বয়সের নিচের শিশুরা সারাদিনে ছয় থেকে সাতশ ইট টানতে পারে। আর ১২-১৪ বছর বয়য়ী শিশুরা দিনের ৮০০ ইট টানতে পারে। তারা প্রতি এক হাজার ইট টানার জন্যে মজুরি পায় ১০০ টাকা। সারাদিনের হাঢ়ভাঙ্গা খাটুনির পরেও তাদের ভাগ্যে জোটে না একশ টাকা। সপ্তাহে মজুরি পায় ৩ থেকে ৪শত টাকা। শিশুদের মধ্যে চলে, কে কত বেশি ইট টানতে পারে তার প্রতিযোগিতা। অতিরিক্ত ইট টানতে গিয়ে দুর্ঘটনারও শিকার হয়।

কাঁচা একেকটি ইটের ওজন তিন কেজি পরিমাণ। পোড়ানোর পর এর ওজন হয় আড়াই কেজি। একজন শিশু একবারে মাথায় নেয় ছয় থেকে আটটি করে ইট। আর এই ১৮ থেকে ২৪ কেজি ওজন বয়ে নিয়ে যায় প্রায় ৫০০ গজ দূরত্বে। এভাবেই তারা সারাদিন এই ভারি কাজ করে। যে শিশুরা নতুন ইট বা পোড়া ইট টানার কাজ করে তাদের ছোট্ট কোমল হাতে পড়ে শক্ত কড়া। কড়া পড়ার আগে তাদের হাত ইটের ঘঁষায় কেটেও যায়। সেই কাটা অবস্থায় চলতে থাকে কাজ। একপর্যায়ে এসব ছোট্ট কচি হাতে ফোসকা পড়ে শক্ত কড়া হয়ে যায়। এছাড়া এসব শিশুর সর্দি, শ্বাসকষ্ট লেগেই থাকে বলে জানান তাদের অভিভাবক।

সাত বছর বয়সী তাসনার। শ্যামলা ছিপছিপে দেহ। সে ছয়টি করে ইট মাথায় করে বয়ে আনে। এভাবে দিনে ৫০ বার সে ইট আনার কাজটি করে থাকে। এভাবে সে দিনে ৩০০ ইট টানতে পারে। মজুরি পায় সপ্তাহে ২০০ টাকা মাত্র। এভাবে সপ্তাহশেষে কেউ পায় ২০০ টাকা কেউ বা পায় ৩০০ টাকা। বড় শ্রমিকরা দিনে পায় ৪শ থেকে ৫শত টাকা। একটি ইটের ওজন তিন কেজি করে হলে প্রতিদিন তারা কমপক্ষে ৯০০ কেজি ওজন টেনে থাকে। ময়মনসিংহ জেলার ইটনা গ্রামের বাসিন্দা ওরা। বছরের টানা ছয় মাস এই কাজ করে থাকে ইটভাটার কাজে নিয়োজিত শিশুরা।

শিশুদের এই ভারী কাজ নিয়ে কথা হয় প্রবীণ শিশু বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. এমআর খানের সঙ্গে। তিনি বলেন, এসব কমবয়সী শিশু এ ধরনের ধুলাবালিতে দীর্ঘসময় ধরে কাজ করলে তাদের ত্বক ও নখ নষ্ট হওয়ার পাশাপাশি শ্বাসকষ্ট ও উচ্চরক্তচাপজনিত সমস্যা দেখা দিতে পারে।

সারাদিনের হাড়ভাঙ্গা খাটুনির পরে ঘুমই যেন তাদের জীবনের একমাত্র প্রশান্তির বিনোদন। তাইতো অধীর আগ্রহে তাদের অপেক্ষা থাকে সুর্য ডোবার। রাতে চারটা ডাল-ভাত খেয়ে বিছানায় যাওয়ার অপেক্ষা করতে থাকে শিশুরা। দিনের হাড়ভাঙ্গা খাটুনির ব্যথায় রাতে কিছুটা উহ.. আহ.. করলেও বিছানায় শুলেই গভীর ঘুমে তলিয়ে যায়।

শিশু হাসপাতালের হৃদরোগ বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. আব্দুল্লাহ শাহরিয়ার বলেন, ইটভাটায় দীর্ঘসময় কাজ করার ফলে বিষাক্ত ধোঁয়ার কারণে শিশুদের শ্বাসকষ্টজনিত রোগ হতে পারে। দীর্ঘ সময় ধুলাবালিতে কাজ করার ফলে শিশুদের রক্ত স্বল্পতা, অ্যাজ্মা, হাঁপানি, ব্রংকাইটিস রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে বলে জানান তিনি।